ড. মোহাম্মদ আমীন
চোখ মারা, পকেট মারা এবং গণপিটুনি
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এবং জামিল চৌধুরী সম্পাদিক “বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান”-এ “চোখ মারা” শব্দের একটাই অর্থ এবং সেটি হচ্ছে, “এক চোখ বন্ধ করে অশালীন ইঙ্গিত করা”। তার মানে, ইঙ্গিত অন্ধকারে করলেও এমনকি নিজে নিজে করলেও অশালীন হয়ে যাবে। আমি আমার মেয়েকে শিশুকালে ‘চোখ মারা’ দিয়ে আদর দিতাম, কাছে ডাকতাম; রাস্তায় কখনও কখনও শিশু দেখলে ওই লক্ষে ‘চোখ মারা’ দিতাম; এখন দিই নাতি-নাতনিদের। জামিল চৌধুরীর অভিধান মতে, এসব অশালীন। তাহলে“চোখ মারা” কি বন্ধ করে দিতে হবে? তা যদি হয় তো চোখ রেখে লাভ কী?
অন্যের অলক্ষে কাউকে কিছু ইঙ্গিত করার জন্য ‘চোখ মারা’ বহুল প্রচলিত একটা মধুর, শালীন এবং ধ্রুপদী বিষয়। এমন করেননি এমন কেউ নেই। জামিল চৌধুরী নিজেও করেছেন, এখন বুড়ো বয়সে এসে এগুলোকেও অশালীন করে দিলেন! এজন্য অনেক ভাষাবিদ ও বৈয়াকরণের কাছে “বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান” একটি “অবিধান”।পৃথিবীতে এমন কোনো খ্যাত লোক নেই, যারা চোখ মারেননি, কিন্তু এজন্য তাদের অশালীনত্বে পড়তে হয়ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওমাবা আর জর্জ বুশের চোখ মারা তো ভূবনজয়ী। কই তাদের কি এজন্য অশালীন অপবাদ পেতে হয়েছে? তার মানে, “ চোখ মারা”কে কেবল অশালীনত্ব দিয়ে প্রকাশ করা সমীচীন হয়নি।
পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় ‘চোখ মারা’ কথার অনেকগুলো অর্থ; যেমন : বাঁকা চাউনি, কটাক্ষ করা, কামাতুর বা লালসাপূর্ণ চাহনি, শিশুদের প্রতি আদুরে ইঙ্গিত, অন্যের অলক্ষে কাউকে কিছু ইঙ্গিত করা, ইশারা হানা, শিশুদের সঙ্গে আনন্দ করা, প্রেমময়তা,অনুভূতির মুগ্ধ প্রকাশ, বিহ্বল হয়ে পড়ার ইঙ্গিত, প্রেমের আহ্বান ইত্যাদি ছাড়াও আরও অনেক বিষয় যুক্ত দেখা যায়। বাংলায় কেন ‘চোখ মারা’ কথাটাকে কেবল অশালীন ইঙ্গিতে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তা জানি না। বাঙালিরা বুঝি ক্রমশ বুড়ো, অথর্ব, নপুংসক, একরোখা এবং বৈচিত্র্যহীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দশ-পনের বছর আগেও “চোখ মারা” ছিল অনেক মজার কাণ্ডকারখানায় ভরপুর একটি বহুমুখী প্রৈমিক বিষয়। “চোখ মারা” না-থাকলে তো চলচ্চিত্রই হতো না, চোখেরই বা কী প্রয়োজন? জামিল চৌধুরীর অর্থ অনুযায়ী আকাশ লক্ষ করে “চোখ মারা”ও অশালীন, কোথায় যাবেন এখন? চোখ খুলে ঘরে রেখে যান।
একসময় “পকেট মারা” অপরাধ ছিল, সাধারণত “চোখ মারা” নয়। ‘চোখ মারা’ দিয়েই শুরু হতো প্রেম। এখন অবশ্য প্রেমের সুচনার জন্য ‘চোখ মারা’র প্রয়োজন পড়ে না, সোজা ‘শরীর মারা’ দিয়ে শুরু করার ইচ্ছা ও সুযোগ প্রবল। তাই “চোখ মারা” এখন অপরাধ; নীতিমতো- পকেট মারার চেয়ে জঘন্য। অবশ্য মেয়েদের
“চোখ মারা” অপরাধ নয়, কেবল মেয়েদেরকেই “চোখ মারা” অপরাধ। “চোখ মারা” নিয়ে কত কবিতা হয়েছে, গান হয়েছে, সিনেমা হয়েছে, কিন্তু কোনো মামলা হয়নি। এখন “চোখ মারা” নিয়ে মামলাও হয় বিস্তর, অহরহ।
চিরন্তন বাংলা সিনেমায় “চোখ মারা” একসময় অশীতিপর বুড়োবুড়িকেও জাগিয়ে তুলত, কিছুক্ষণের জন্য হলেও। এখন মানুষ সভ্য হচ্ছে, যত সভ্য হচ্ছে তত বেশি চোখ ফুটছে। যত বেশি চোখ ফুটছে ‘‘চোখ মারা’’ তত ভয়ঙ্কর অপরাধে পরিণত হচ্ছে। এখন হাওয়ায় “চোখ মারা” নয়, সোজা লক্ষ শরীর। তাই ‘চোখ মারা’ এখন পকেট মারা, বারি মারা, লাথি মারা, হাতি মারা, গুলি মারা, ধাক্কা মারা , এমনকি কখনও কখনও মানুষ মারার চেয়েও মারাত্মক। যদি কাজটি মেয়েদের, বিশেষ করে যুবতী, আরও বিশেষ করে সুন্দরী যুবতী, আরও বিশেষ-বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত ধনেমানে শ্রেষ্ঠ যুবতী-সুন্দরী মেয়েদের লক্ষ করে বর্ষিত হয়।
সাবধান, আগে যতই চোখ মারুন না কেন, এখন কিন্তু ভুলেও চোখ মারবেন না। প্রয়োজন হলে, চোখ দুটো অন্ধ করে দিন, নিজেকে মেরে ফেলুন। চোখ মারালে যে-কোনো মুহূর্তে নারী নির্যাতন হয়ে যেতে পারে, মামলা হয়ে গেলে নব্বই দিনের আগে জামিন নেই। অতএব, আপনিই যাই মারুন, মেয়েদেরকে “চোখ মারা” থেকে বিরত থাকুন। মেয়েরা আপনাকে যতই “চোখ মারা” দিক না কেন। কী অভাগ্য আমাদের ভাগ্য! আমরা আমাদের আচরণ দিয়ে ‘চোখ মারা’র মতো রোমান্টিক একটা বিষয়কে জামিন-অযোগ্য অপরাধ বানিয়ে ফেলেছি।