একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক অতুলপ্রসাদ সেন ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে অক্টোবর ঢাকায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার মগর গ্রাম। অতুলপ্রসাদ তাঁর বাসগৃহ ও গ্রন্থস্বত্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে দান করে দিয়েছিলেন। সমগ্র জীবনের উপার্জিত অর্থেরও বৃহদংশ স্থানীয় জনকল্যাণে ব্যয় করেন। লখনৌতে বসবাসকালে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে আগস্ট তিনি মারা যান। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য হয়। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন কাওরাইদ (কাওরাদি) ব্রহ্ম মন্দিরের পাশের সমাধিস্থলে তাঁর চিতাভস্ম সমাহিত করা হয়। এখানে একটি স্মৃতিফলক আছে। এতে লেখা ছিল ‘‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! / তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!” ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্মৃতিফলকটি পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে ধ্বংস হয়ে যায়। পরে নতুন করে করা হয়। নতুন স্মৃতিফলকে লেখা আছে:—— বিস্তারিত।
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে শুবাচের পক্ষ থেকে রইল গভীর শ্রদ্ধা। স্মরণ করি তাঁকে মাতৃভাষাসম অকুণ্ঠ মমতায়।
অতুলপ্রসাদ সেন বাংলা গানে ঠুংরি ধারার প্রবর্তক। বাংলা গানের ইতিহাসে তিনিই প্রথম বাংলায় গজল রচনা করেন। তার রচিত বাংলা গজলের সংখ্যা ৭। অতুলপ্রসাদের মোট গান ২০৮। তন্মধ্যে ৫০-৬০টি গান গীত হিসেবে বহুল প্রচলিত।অতুল প্রসাদের মামাতো বোন সাহানা দেবীর সম্পাদনায় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ৭১টি গান স্বরলিপি-সহ কাকলি নামে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। তাঁর অন্য গানগুলো গীতিপুঞ্জ এবং কয়েকটি গান নামে দুটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ১৯২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দে সাহানা দেবী ও হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কলকাতা থেকে প্রথম অতুল প্রসাদের গানের রেকর্ড বের হয়।
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গীতিগুঞ্জ গ্রন্থে তাঁর সমুদয় গান সংকলিত হয়। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে অনেকগুলো অপ্রকাশিত গান স্থান পায়। তাঁর লেখা “মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!!” গানটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অণুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এটি বাংলা ভাষার প্রশস্তি গেয়ে রচিত অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি দেশাত্মবোধক গান। “ উঠ গো, ভারত লক্ষ্মী! উঠ আদি জগত-জন-পূজ্যা!” এবং “বল, বল, বল সবে, শত বীণা-বেণু-রবে” এবং “হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর” তাঁর লেখা অন্য দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দেশাত্ববোধক গান। তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয়গানগুলো দেখুন:
আবার তুই বাঁধবি বাসা কোন সাহসে
আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে বিশ্ব-ঘরে পেতাম না ঠাঁই ।
আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার
আমার বাগানে এত ফুল তবু কেন চলে যাই
আমারে এ আঁধারে এমন ক’রে চালায় কে গো?
আমারে ভেঙে ভেঙে করহে তোমার তরী;
আর কতকাল থাকব ব’সে দুয়ার খুলে, বধূ আমার!
আজ আমার শূন্য ঘরে আসিল সুন্দর ওগো অনেক দিনের পর
উঠ গো, ভারত লক্ষ্মী! উঠ আদি জগত-জন-পূজ্যা!
ওগো নিঠুর দরদি, এ কি খেলছে অনুক্ষণ, তোমার কাঁটায় তোমার প্রেমে ভরা মন
ওগো আমার নবীন সাথী, ছিলে তুমি কোন বিমানে?
একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন জলে
এসো হে, এসো হে প্রাণে, প্রাণসখা।
কেন এলে মোর ঘরে আগে নাহি বলিয়া?
চিত্ত দুয়ার খুলিবি কবে মা চিত্তকুটিরবাসিনী
জল বলে, চল মোর সাথে চল, কখনো তোর আঁখিজল হবে না বিফল।
তুমি মধুর অঙ্গে, নাচো গো রঙ্গে, নূপুরভঙ্গে হৃদয়ে
তুমি দাও গো দাও মোরে পরান ভরি দাও।
তোমার ভাবনা ভাবলে আমার ভাবনা রবে না
নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন
বল, বল, বল সবে, শত বীণা-বেণু-রবে
মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
মোরা নাচি ফুলে ফুলে দুলে দুলে,
যখন তুমি গাওয়াও গান তখন আমি গাই।।
যদি তোর হৃদ-যমুনা হ’লো রে উছল, রে ভোলা,
বাল্যকালে পিতৃহীন হয়ে অতুল প্রসাদ ভগ্দ্ভক্ত, সুকন্ঠ গায়ক ও ভক্তিগীতিরচয়িতা মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের আশ্রয়ে প্রতিপালিত হন। ফলে (বিস্তারিত:অতুল প্রসাদ সেন: আহ মরি বাংলা ভাষা) অল্প বয়সে মাতামহের সব গুণ তাঁর মাঝেও দেখা দিতে শুরু করে। অতুল প্রসাদ ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রবেশিকা পাশের পর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। তিনি ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনে গিয়ে আইন শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রথমে তিনি রংপুর ও কলকাতায় অনুশীলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে লখনউ চলে যান এবং সেখানে বার অ্যাসোসিয়েশন ও বার কাউন্সিলের সভাপতি হন। লখনউতে তিনি যেখানে বাস করতেন তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর নামে ওখানে একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়। তাঁর রচিত গানগুলোর মূল উপজীব্য দেশপ্রেম, ভক্তি, প্রেম ও সংসার জীবনের দুঃসহ যাতনা। পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুখী। জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলো গানের ভাষায় মূর্ত করেছেন। এজন্য বলা হয় “বেদনা অতুলপ্রসাদের গানের প্রধান অবলম্বন”। তাঁর গানগুলো কত জীবনমুখী এবং কত সর্বজনীন তা না শোনা পর্যন্ত অনুধাবন করা যাবে না। অতুলপ্রসাদের গানগুলো দেবতা, প্রকৃতি, স্বদেশ, মানব ও বিবিধ নামে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গানের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন।অতুলপ্রসাদের লেখা গানকে অতুলপ্রসাদী গান বলে।
অতুলপ্রসাদ বাংলা গানে ঠুংরি ধারার প্রবর্তক। বাংলা গানের ইতিহাসে তিনিই প্রথম বাংলায় গজল রচনা করেন। তার রচিত বাংলা গজলের সংখ্যা ৭টি। অতুলপ্রসাদের গানের সংখ্যা ২০৮। তন্মধ্যে ৫০-৬০টি গান গীত হিসেবে বহুল প্রচলিত। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গীতিগুঞ্জ গ্রন্থে তাঁর সমুদয় গান সংকলিত হয়। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে অনেকগুলো অপ্রকাশিত গান স্থান পায়। তাঁর লেখা মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! গানটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অণুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এটি বাংলা ভাষার প্রশস্তি গেয়ে রচিত অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি দেশাত্মবোধক গান।উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী এবং বলো বলো বলো সবে, হও ধরমেতে ধীর তার আরও দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দেশাত্ববোধক গান। মিছে তুই ভাবিস মন, সবারে বাস রে ভালো, বঁধুয়া, নিঁদ নাহি আঁখিপাতে, একা মোর গানের তরী, কে আবার বাজায় বাঁশি, ক্রন্দসী পথচারিণী ইত্যাদি।
লন্ডনে অবস্থানকালে অতুলপ্রসাদের বড়োমামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত সেখানে গেলে মামাতো বোন হেমকুসুমের সঙ্গে প্রেম হয় এবং তিনি হেমকুসুমকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন ভারতবর্ষের আইনে ভাই-বোনে এরকম বিয়ে গ্রহণযোগ্য ছিল না। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রবল আপত্তি ওঠে। ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ তাঁর কর্মগুরু সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের পরামর্শক্রমে স্কটল্যান্ড গমন করেন। কারণ সেখানে এরূপ বিবাহ আইনসিদ্ধ ছিল। স্কটল্যান্ডে গিয়ে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে মামাতো বোন হেমকুসুমকে বিয়ে করেন। বিলেতে পসার জমাতে পারেননি অতুলপ্রসাদ। ফলে মারাত্মক অর্থকষ্টের সম্মুখীন হন। বিলেতে থাকাকালীন তাঁর দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তন্মধ্যে একজন মারা যায়। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জীবিত সন্তান দিলিপ কুমারকে নিয়ে ভারতের কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় তিনি ছিলেন কপর্দকশূন্য। কোনো আত্মীয়স্বজন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি।
লখনউ বসবাস কালে অতুলপ্রসাদের মা হেমন্তশশীর দ্বিতীয় স্বামী দুর্গামোহনের মৃত্যু হয়। দুর্গামোহনের মৃত্যুর পর হেমন্তশশী ছেলের সংসারে চলে আসেন। শুরু হয় বউ শ্বাশুড়ি দ্বন্দ্ব। পরিণতিতে স্বামী-স্ত্রীর সাময়িক ছাড়াছাড়ি। হেমন্তশশীর মৃত্যুর পর ঘরে তাঁর ফটো টাঙানো ছিল। তা সরিয়ে ফেলার দাবি তোলেন হেমকুসুম। কিন্তু মায়ের ছবিকে এভাবে অসম্মান করতে রাজি ছিলেন না অতুলপ্রসাদ। ফলে হেমকুসুম চিরকালের জন্য স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যান। ১৯০২ থেকে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অতুলপ্রসাদ আইন ব্যবসা উপলক্ষ্যে লখনউ ছিলেন। অধিকাংশ গানই তিনি এখানে রচনা করেন।জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় তিনি উত্তর ভারতে কাটান। সেজন্য ওখানকার সাংগীতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে মিশে গিয়ে তিনি হিন্দুস্তানি গীত পদ্ধতিকে রপ্ত করতে সমর্থ হন। তাই বাংলা গানে হিন্দুস্তানি ঢঙের মিশ্রণ ঘটানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তার অন্যান্য কয়েকটি গান:
আয়, আয়, আমার সাথে ভাসবি কে আয়!
আমায় ক্ষমা করিয়ো যদি তোমারে জাগায়ে থাকি।
আনন্দে রুমক ঝুমু বাজে
আজি হরষ সরসি কি জোয়ারা
আজি স্বর্গ-আবাস তুমি এসো ছাড়ি
জাগো বসন্ত, জাগো এবে
অতুলপ্রসাদ তাঁর সমগ্র জীবনের উপার্জিত অর্থেরও বৃহৎ অংশ স্থানীয় জনকল্যাণে ব্যয় করেন। এমনকি তিনি তার বাসগৃহ ও গ্রন্থস্বত্বও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে দান করে যান। লখনৌতে বসবাসকালে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ আগস্ট তিনি মারা যান। সেখানেই তার শেষকৃত্য হয়। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন কাওরাইদ (কাওরাদি) ব্রহ্ম মন্দিরের পাশে সমাধিস্থলে তার চিতাভস্ম সমাহিত করা হয়। এখানে একটি স্মৃতিফলক আছে। এতে লেখা ছিল ‘‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! / তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!‘” ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্মৃতিফলকটি পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে ভেঙ্গে যায়। পরে নতুন করে করা হয়। নতুন স্মৃতিফলকে লেখা আছে:
অতুল প্রসাদ সেন
জন্ম – ১৮৭১ ২০শে অক্টোবর
মৃত্যু – ১৯৩৪ ২৭শে আগস্ট
শেষে ফিরব যখন সন্ধা বেলা সাঙ্গ করে ভবের খেলা
জননী হয়ে তখন কোল বাড়ায়ে রবে
আমার যে শূন্য ডালা, তুমি ভরিয়ো
আর তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।
গ্রন্থপঞ্জি : বাংলাপিডিয়া, সুধীর চক্রবর্তী, বাংলা গানের সন্ধানে, কলকাতা, ১৯০০; দিলীপকুমার রায়, সাঙ্গীতিকী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৮; ননীগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সঙ্গীতদর্শিকা, কলকাতা, ১৯৭৫।