অ্যালামনাই আর এলামনাই

ড. মোহাম্মদ আমীন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উদ্‌যাপন করল ‘অ্যালামনাই’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় করল ‘এলামনাই’। ঢাকারটি রোমান-ইংলিশ শব্দের শুদ্ধ রূপ আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরটি হঠাৎ মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো একটি মারাত্মক ভুল। অ্যান্ড (and) আর এন্ড (end)- এর উচ্চারণ কি এক? তা যদি না হয় তো, ‘অ্যালাম’ আর ‘এলাম’ কীভাবে এক হয়? যদি ‘এলামনাই’ শুদ্ধ হয় তাহলে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিষদ’ ভুল করেছে এবং যদি ‘অ্যালামনাই’ শুদ্ধ হয় তাহলে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিষদ’ ভুল করেছে।
ইংরেজি `a’ বর্ণের উচ্চারণ বাংলা ‘এ’ বর্ণের মতো নয়; ‘অ্যা’-এর মতো। ড্যাড (dad) আর ডেড (dead)- উচ্চারণ এক হয় কীভাবে? দুটোর উচ্চারণ এক হলে ‘bad’ আর ‘bed’ শব্দের উচ্চারণও অভিন্ন হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে ‘a’ এবং ‘e’ বর্ণের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। অতএব, ‘এলামনাই’ শব্দটি alumni শব্দের প্রতিবর্ণীকৃত কোনো শব্দ হতে পারে না। ‘alumni’ শব্দের একমাত্র শুদ্ধ এবং প্রমিত রূপ ‘অ্যালামনাই’
ল্যাটিন ‘alumnus (অ্যালামনাস)’ শব্দ থেকে ‘alumni’ (অ্যালামনাই) শব্দের উদ্ভব। প্রথমে যার অর্থ ছিল পালকপুত্র, শিক্ষার্থী প্রভৃতি। সেকালে অধিকাংশ শিক্ষার্থী সাধারণত পালকপুত্র হিসেবে শিক্ষকের গৃহে অবস্থান করে অধ্যয়ন করত। এদের বলা হতো ‘alumni’। অন্যদিকে, অতি ধনী লোকের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিজেই শিক্ষার্থীর বাড়িতে অবস্থান করতেন।
রোমান আইনে প্রথম খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে ‘‍alumnus’ শব্দটি প্রাতিষ্ঠানিক শব্দ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন গুরুগৃহে অবস্থান করে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ‘অ্যালামনাই’ বলা হতো । সেকালে শব্দটি কেবল এই অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে ‍‘alumni (অ্যালামনাই)’ শব্দটি ‘প্রাক্তন শিক্ষার্থী’ অর্থ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়।
নবম শতকের প্রথম দিকে ‘alumni’ শব্দটির অর্থ পরিবর্তিত হয়ে ‘প্রাক্তন শিক্ষার্থী’ প্রকাশে ব্যবহৃত হওয়ার সূচনা ঘটে। University of Bologna in Italy-কে কেন্দ্র করে কয়েক জন প্রাক্তন শিক্ষার্থী ইউরোপে প্রথম অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বল্প পরিসরে একটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (Alumni Association) প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ইংল্যান্ডে প্রাতিষ্ঠানিক মাত্রা নিয়ে আধুনিক অল্যামনাই অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়। ষোড়শ শতকে ইংরেজি সাহিত্যে বর্তমান অর্থ (প্রাক্তন শিক্ষার্থী) প্রকাশে ‘অ্যালামনাই’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। ফলে শব্দটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং মর্যাদাকর প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান পেয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
এবার নতুন আবিষ্কৃত ‘এলামনাই’ কথায় চলে আসি। শব্দটি  ইংরেজি নয়, রোমানও নয়; বাংলা। ‘এলাম’ ও ‘নাই’ শব্দের মিলনে জন্ম নিয়েছে ‘এলামনাই’। ‘এলাম’ শব্দের অর্থ come, came, আসা, এলেম বা জ্ঞান এবং নাই শব্দের অর্থ not, নেই প্রভৃতি। সে হিসেবে, এলামনাই শব্দের অর্থ : আসিনি, এলেম নেই বা জ্ঞান নেই প্রভৃতি। হয়তো জ্ঞান নেই বলেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এলামনাই’দের পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট এবং গোষ্ঠী-যযাতির অনেক সাধারণ বাংলা বানানও ভুলে ভুলে ভরা। মনে হয়, কারো কার্যকর নেতৃত্ব নেই— যার যেমন খুশি লিফলেট-পোস্টার লিখে ছড়িয়ে দিচ্ছে গ্রুপে। এটি ভুল আর বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। খেয়াল করে দেখুন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোটিকেও বিকৃত করে একেক জায়গায় একেকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এত বড়ো স্পর্ধা! কেউ কিছু বলছে না, এটা কি মগের মুল্লুক? ফরিদুর নাহার লাইলী নামের একজন লিখেছেন ‘বাংলাদেশ আওয়ামীলিগ’ দেশে কি এই নামের কোনো দল আছে? একটা দল আছে সেটির নাম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।যিনি ক্ষমতাসীন দলের নামটি পর্যন্ত লিখতে পারেন না, তিনি না কি আবার ‘কৃষিবিষয়ক সম্পাদক’! এ কেমন কথা?
ভুল ধরিয়ে দিয়ে গত ১০/১১/২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ তারিখ সন্ধ্যায় cu alumni association  গোষ্ঠীতে (group) একটা যযাতি (post/status) দিয়েছিলাম। কয়েক ঘণ্টা পর তা নেই — মুছে দেওয়া হয়েছে। ভুল সবার হয়, সবচেয়ে বেশি হয় আমার, কিন্তু কেউ ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুদ্ধ করে নিই, রেগে যাই না, যযাতি মুছে দিই না। আমার যযাতি মুছে দেওয়ায় বুঝলাম, ওষুধে কাজ করছে। মাতৃভাষা মায়ের মতো। মায়ের অপমান কোনো সুসন্তান মেনে নিতে পারে না। মাতৃভাষার অপমান দেখলে আমি প্রতিবাদ করব, একা হলেও; না-থাকুক কেউ সঙ্গে। ভাষা ছাড়া আমার আর আছে কী? আমার একমাত্র অহংকার ভাষা, তাকে কেউ অবহেলা করলে তা কখনো মেনে নেব না। আমার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করে যাব। কারণ আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আমার মাতৃভাষা বাংলা। আমি গবেষণা করে পেয়েছি— বাংলা ভাষার অন্যতম উৎস চট্টগ্রাম। অধিকন্তু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিষদের নেতৃবৃন্দ মাতৃভাষায় অজ্ঞ হিসেবে পরিচিত হোক— এটি আমি চাই না।আশা করি তাঁরা ভুল বানানগুলো শুদ্ধ করে নেবেন এবং ভুল ‘এলামনাই’ শুদ্ধ হয়ে ‘অ্যালামনাই’ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ভুল বানানও শুদ্ধ করে নেবেন।
 shekhar sudipta নামের  একজন লিখেছেন, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই এসোসিয়েশন এর প্রোগ্রামে রেজিস্ট্রেশন করে না পেলাম লাইফ মেম্বার কার্ড, না হলো ডিরেক্টরিতে নাম এন্ট্রি, না পেলাম স্যুভ্যেনির গেঞ্জি; এই অবস্থা শত শত প্রাক্তনীর। জঘন্য ও ভয়ংকর অব্যবস্থাপনা। ক্যাপাসিটি নেই ভালো কথা এতজনের এত এত টাকা যে নিলেন! কেন নিলেন? এফডি আর করার জন্য কি? মোটেই না। একথা আগে জানলে তো রেজিস্ট্রেশনই করতাম না। আমি টাকা দিয়েছি একটা সুন্দর আয়োজনের অংশ হতে আর এলামনাই এর লাইফ মেম্বার হতে। সেই জায়গায় আমি-সহ বহু প্রাক্তনীর নামই আসেনি।২০ দিন আগে রেজিস্ট্রেশন করে ডিরেক্টরিতে নাম আসবে না এটা আজ শুনতে খুব খারাপ লেগেছে আমি সহ অনেকের। একথা খুব স্পষ্ট এই আয়োজকেদের ন্যূনতম দক্ষতা নেই এতবড় আয়োজনের। ছি!তীব্র নিন্দা আর ধিক্কার জানাই ! যাবই না আর প্রোগ্রামে।”  
“জাফর চৌধুরী নামের একজন লিখেছেন, “চবির অ্যালামনাই এসোসিয়েশনের প্রথম রিইউনিয়নের আইডি কার্ডে নিজের নামের তিন অংশই যখন ভুল দেখলাম খুব কষ্ট হচ্ছিল। তখন আমার এক বন্ধু আমাকে স্বান্তনা দিয়ে জানাল, কিছুক্ষণ আগে সে একজন জেসমিন আক্তারের আইডি কার্ডে দাড়ি-গোঁফ দেখেছে। সাথে সাথে সব কষ্ট পানি হয়ে গেল। নিজেকে ছবি না দেওয়ার জন্য বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিষদের উচ্চশিক্ষিত সদস্যবর্গের মাতৃভাষার প্রতি এমন অবহেলা এবং অজ্ঞতা মেনে নেওয়া যায় না। তাঁরা মাতৃভাষাজ্ঞানে এত দীন কীভাবে হয়ে গেল? তাহলে ভাষা আন্দোলন কি ব্যর্থ হওয়ার পথে?
Total Page Visits: 1388 - Today Page Visits: 3

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Language
error: Content is protected !!