বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকাতে না চুকাতেই পুলিশে এস আই পদে নিয়োগের সংবাদ পেলাম। রাজীব দা শুধু সংবাদই নিয়ে আসলেন না, সাথে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি।‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকাটিও যোগাড় করে নিয়ে এসেছেন। আবেদন, নিয়োগ পরীক্ষা শেষে চট্টগ্রাম জেলা থেকে আমরা আটজন মনোনীত হলাম। যোগদান করতে হবে ১৯৮৮’র জানুয়ারি নয় তারিখে। আমাদের জানান হয়েছিল সম্ভবত জানুয়ারির চার কিংবা পাঁচ তারিখ।
এরই মধ্যে সারতে হলো ডাক্তারি পরীক্ষা আর ডিএসবি ভেরিফিকেশন। বাবা শুনে বললেন – ভালো সংবাদ, জেনে খুশি হলাম, তবে যোগদান না করলেই খুশি হব। তারচেয়ে এম এ টা শেষ করে কলেজে মাস্টরি এবং ব্যবসা দেখাশোনা করাই ভালো।’ কিন্তু আমার ইচ্ছে যোগ দেওয়া। জানালাম, ব্যবসা বানিজ্যের ভবিষ্যতও একেবারে নিশ্চিত ভালো নয়। আমার সিদ্ধান্তেই পুলিশ একাডেমি যাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়।
পুলিশ হেড কোয়ার্টার চাকরির নিয়োগ পত্রের সাথে একটা তালিকা সংযুক্ত করে দিয়েছে একাডেমী যাওয়ার সময় কি কি জিনিসপত্র সাথে নিয়ে যেতে হবে। সে মোতাবেক তোষক-বালিশ থেকে শুরু করে সুঁইসুতো পর্যন্ত কিনে নিলাম। তখন সিএমপি-তে কর্মরত ছিলেন আমাদের আত্মীয় সহকারী পুলিশ কমিশনার শরণ বড়ুয়া। লালখান বাজার তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম উপদেশ নিতে। তিনি সম্ভবত ১৯৬৫ ব্যাচের ক্যাডেট ছিলেন। পুলিশ একাডেমি বিষয়ে অনেক আদেশ উপদেশ দিয়েছিলেন তিনি।
দামপাড়া পুলিশ লাইন স্কুলে নিয়োগ পরীক্ষা চলাকালে পরিচয় হয় বিপুল বড়ুয়ার সাথে। তাঁর বাড়ি পটিয়া। তার সাথে যোগাযোগ করে ঠিক করি আমরা একসঙ্গে সারদা পুলিশ একাডেমিতে যাব। দুজনই রাজশাহীর পথে নতুন। সে কারণে একসঙ্গে যাওয়ার জন্য আমরা একমত হই।
দিনটি ছিল ১৩ জানুয়ারি বুধবার ভোর। বুধবার আমার কেন জানি প্রিয়দিন। সে কারণেই রওয়ানা দিয়েছিলাম বুধবারে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিপুল পটিয়া থেকে এসে পড়েছিল আমাদের দেওয়ানজি পুকুর পাড়ের বাসায়। রাতে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। বাবা আমাদের দুজনকে অনেক উপদেশ দিলেন। আমি দু’ভাইয়ের মধ্যে ছোট এবং বাবার সঙ্গে একটু বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলাম। আমি এ প্রথম ঘর ছেড়ে দূরে যাচ্ছি , সে করণে বাবাও কিছুটা আমাকে নিয়ে চিন্তিত বুঝতে পারছিলাম। সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। নিশ্চয় ভালো ঘুম হয়নি বাবারও। বাবা হয়ে এখন সেটা বুঝতে পারছি। সকাল ৭ টায় মহানগর প্রভাতী ট্রেনে ঢাকা যাব। তারপর রাজশাহী। বাবা আমাদের দুজনকে আলো আঁধারী ভোরে একটা বেবী ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিয়েছিলেন।
শরণ দা বলে দিয়েছিলেন, আমাদের নামতে হবে রাজশাহীর আগে বানেশ্বর। সেখান থেকে টমটম বা ঘোড়ার গাড়িতে পুলিশ একাডেমি সারদা। সে অনুযায়ী বাসের হেল্পারকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলাম আমারা দু’জন বানেশ্বর নামব। কিন্তু বানেশ্বর নামটা ভুলে গিয়ে আমি বারবার বালেশ্বর বলছিলাম। আমার উৎকণ্ঠা দেখে বাসের হেল্পার বার বার আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছিলেন যে- ঠিকভাবেই আমাদের নামিয়ে দেওয়া হবে। চিন্তার কারন নাই।
টমটমওয়ালা আমাদের দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন, আমরা কোথায় নামব। সে অনুযায়ী তিনি আমাদের নামিয়ে দিলেন একেবারে ক্যাডেট ব্যারাকের সম্মুখে। ‘বয়’রা যেন অপেক্ষায় ছিল আমাদের জন্য। ওরা ছোঁ মেরে আমাদের বেডিং পত্র দোতলায় নিয়ে গেল। জানাল, তিন তলা থেকে দোতলা ভালো হবে। আমাদেরও মত তাই। কারণ তিন তলায় উপরে উঠতে হবে বেশি। যারা আমাদেরও পরে আসবে তারা উঠবে তিন তলায়।
মাইনুল আমাকে আর বিপুলকে নিয়ে গেল সারদা বাজারের সেলুনে। কারণ ব্যারাকে পুলিশের নাপিত আসে সকালে, বিকালে নয়। সেলুনে বসে আয়নায় নিজের মাথা ভর্তি চুল মন দিয়ে দেখে নিলাম একবার। ভাবলাম পুলিশী জীবনে আর মাথার চুল লম্বা রাখা যাবে
না। সেদিন সন্ধ্যা আমার লম্বা চুলের শেষদিন। সেলুনদার গছগছ করে আমার চুল কেটে ছোট করে ফেললেন। পাশে দেখলাম ট্রেনিং কনেসেটবলদের অবস্থা আরও খারাপ। তাদের দেওয়া হচ্ছে বাটিছাঁট। বাটিছাঁট মানে শুধু মাথার উপরে সামান্য চুল রাখা হচ্ছে। মাথার বাকি অংশ পুরোটাই সেভ করা।
চুল কাটার পর মাইনুল নিয়ে গেল পাশের চা দোকানে। বলল- এর পর রোল কল। তারপর আর মেইন গেটের বাইরে আসা যাবে না। চা পানি খেয়ে নিতে হবে এখনই। মনে মনে ভাবলাম, তাই ভালো, এমনিতেই ক্ষুধার্ত অনেকক্ষণ। সেখানে চুলখাট সুটাম দেহের এক ব্যাক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল মাইনুল। সেই জানাল লোকটাকে- ওস্তাদজি, ওরা আজ নতুন এসেছে। সেই ওস্তাদজি একটু মাথা নেড়ে চলে গেল অন্য টেবিলে। মাইনুল আমাকে জানাল- ইনি হাবিলদার আমাদের । এদেরকে শুধু ওস্তাদ বললে হবে না। বলবে ওস্তাদজি। বললাম ঠিক আছে। এরকম আরও টুকটাক কিছু নিয়ম কানুন মাইনুল জানিয়ে দিল।
সন্ধ্যায় যোগ দিলাম রোল কল প্যারেডে। আমারা যারা নতুন এসেছি সবাই চাকরিতে, মানে ট্রেনিঙে যোগদানের সরকারি চিঠি জমা দিলাম হাবিলদার মেজরের হাতে। জানলাম, তিনি সরোয়ার ওস্তাদ। খুব মাথা গরম লোক, কিন্তু মন ভালো। মাথা গরম লোকেরা আসলেই ভালো হয় মিনমিনেদের চেয়ে। সেটা সারদার এক বছরের ট্রেনিং এ বুঝে গিয়েছিলাম।
এভাবে আমার শুরু হল হুকুম শোনার এক বছর। ( চলবে )
লেখক : সনতোষ বড়ুয়া, কবি, ছড়াকার ও গল্পকার। প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পুলিশ।
গবেষণা, প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন, মাতৃভাষা জ্ঞান, প্রাত্যহিক প্রয়োজন, শুদ্ধ বানান চর্চা এবং বিসিএস-সহ যে-কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটি লিংক :
মানিকগঞ্জ জেলার নামকরণ ও ঐতিহ্য
হাতিয়া উপজেলার নামকরণ ইতিহাস ও ঐতিহ্য
পটুয়াখালী আগুনমুখা নদীর নামকরণ
ভেদরগঞ্জ উপজেলা ও ইউনিয়নসমূহের নামকরণ