আযারবাইজান (Azerbaijan) : ইতিহাস ও নামকরণ

কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)

ড. মোহাম্মদ আমীন

আযারবাইজান (Azerbaijan)

আযার (Azar) প্রাচীন পারসি শব্দ; এর অর্থ আগুন এবং পাইজান (Payegan) শব্দের অর্থ গার্ডিয়ান বা রক্ষাকর্তা। সুতরাং আযার-পাইজান শব্দের অর্থ আগুনের রক্ষাকর্তা বা গার্ডিয়ানস অব ফায়ার। পারস্য সাম্রাজ্য মুসলিম দখলে আসার পর অনেক পারসি শব্দ আরবি ভাষার প্রভাবে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এভাবে অনেক পারসি শব্দ তার মুল বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। আরবি ভাষায় G / P / ZH / CH প্রভৃতি চিহ্নের উচ্চারণ ছিল না। তাই আরবিয়দের কাছে এ সকল চিহ্ন সমন্বিত শব্দগুলো আরবীয় ঢঙে বিকৃতভাবে উচ্চারিত হতে থাকে। এভাবে পাইজান শব্দটি আরাবিয়ারা ‘বাইজান’ হিসাবে উচ্চারণ করতে শুরু করে। এভাবে ‘আজার-পাইজান’ নামটি রুক্ষ আরবীয় মুসলিমদের দখলে আসার পর আরবি ভাষা ও আরবীয়দের উচ্চারণের প্রভাবে তা ‘আযারবাইজান’ হয়ে যায়। পারস্যসহ আযারবাইজন ছিল অগ্নি উপাসকদের দেশ। আযারবাইজান ছিল অগ্নি দেবতার প্রধান প্রার্থনাগৃহ। তাদের প্রভু অগ্নিকে এ ভূখণ্ড হতে রক্ষা করতেন। তাই দেশটি আযারবাইজান নামে পরিচিত হয়ে যায়। দখলদার আরবীয়রা ছিল অর্ধশিক্ষিত। তাই তারা স্থানীয় ভাষায় আজার-পাইজান শব্দের অর্থ জানত না, জানার কোনো চেষ্টাও করেনি। জানলে নামটি তারা অবশ্যই পরিবর্তন করে দিত। কারণ অগ্নি উপাসকদের সঙ্গে মুসলিমদের দ্বন্দ্ব ছিল চরম।

কথিত হয়, জরোয়াস্ত্রিজম (Zoroastrism) ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা জরোয়াস্তার (Zoroaste) আজারবাইযানে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় এটি পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তার প্রভাবে এখানে অগ্নি-উপাসকদে প্রসার ঘটে এবং শহরটির নাম আজার-পাইজান রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। অনেকে মনে করেন, ‘এট্রোপ্যাটস’ শব্দ হতে আযারবাইজান শব্দের উৎপত্তি। ‘এট্রোপ্যাটস’ প্রাচীন মেডিয়ান ও পারস্য সাম্রাজ্যের গভর্নরদের উপাধি ছিল। বিভিন্ন প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থে ‘এট্রোপ্যাটস’ শব্দের উল্লেখ দেখা যায়। একসময় তারা প্রচ- ক্ষমতাশালী ছিলেন।

আযারবাইজানের আয়তন ৮৬,৬০০ বর্গকিমি বা ৩৩,৪৩৬ বর্গমাইল। তন্মধ্যে ১.৬ শতাংশ এলকা জলীয়। আয়তন বিবেচনায় এটি পৃথিবীর ১১৪-তম বৃহত্তম দেশ। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ৯,৬২৪,৯০০। প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১০৫.৮ জন। মোট জনসংখ্যা ও জনসংখ্যার ঘনত্ব হিসাবে আযারবাইজান পৃথিবীর যথাক্রমে ৮৯-তম ও ১০৩-তম জনবহুল দেশ। দেশটির জিডিপি (পিপিপি) ১৬৮.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ১৭,৫০০ ডলার। জিডিপি নমিনাল ৮৭.৭৬৩ বিলিয়ন ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৯,২৭৮ ইউএস ডলার। দেশটির এইচডিআই ০.৭৪৭ এবং গিনি ৩৩.৭। এইচডিআই বিবেচনায় এর স্থান পৃথিবীর ৭৬-তম। মুদ্রার নাম মানাত (Manat)। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ শে মে দেশটি ডেমোক্র্যাটিক রিপাবললিক এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ এপ্রিল সোভিয়েত সোসাইলিস্ট রিপাবলিকে রূপান্তরিত হয়। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ নভেম্বর এটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাাধীনতা লাভ করে। আজারবাইযানের সরকারি ভাষা আজারবাইযানি। এ ভাষায় দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ লোক কথা বলে। আজারবাইযানি ছাড়াও এখানে আরও ১৩টি ভাষা এখানে প্রচলিত আছে।

আযারবাইজানের রাজধানী বাকু। বাকু ছিল একসময় চিনের সঙ্গে ইউরোপের সিল্ক রুটের অন্যতম কেন্দ্র। বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভ আজারবাইযানের রাজধানী বাকুর অধিবাসী। বিশ্বের কনিষ্ঠতম গ্র্যান্ড মাস্টার তৈমুর রাজাভবের জন্মস্থানও আজারবাইযান। উল্লেখ্য তিনি ১৪ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ড মাস্টার খেতাব অর্জন করেছিলেন।

আজারবাইযান পৃথিবীর প্রথম আদি মানব বসতি হিসাবে বিখ্যাত। মানব ইতিহাসের প্রথম জ্ঞাত অগ্নিকু- এবং নির্মাণ কর্মকাণ্ডের ভগ্নাবশেষ আজারবাইজানের বৃহত্তম গুহা আজিখে (Azikh Cave আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণের বিশ্বাস এগুলো ৭ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ বছর আগেকার মানুষের কর্মকাণ্ডের নমুনা। এমন কর্মকা- সম্পর্কিত প্রাচীন তথ্য আর পাওয়া যায়নি।

দেশটির মোট ভুখণ্ডের ৪০ ভাগ পর্বতাবৃত। আজারবাইযানের উপর দিয়ে প্রবাহিত ৮৩৫০টি নদীর সবকটি কাস্পিয়ান সাগরে মিলিত হয়েছে। সরকারিভাবে কোনো ধর্ম রাষ্ট্রীয় ঘোষণা করা না হলেও আজারবাইজানের ৯৫ ভাগ অধিবাসী মুসলিম এবং এর সিংহভাগ শিয়া। অষ্টাদশ শতকের আগে এটি ছিল খ্রিস্টান-রাষ্ট্র। এর অব্যবহিত পরে দেশের সকল অধিবাসী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আজারবাইযান হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র যেখানে অপেরা ও থিয়েটার চালু করা হয়। কালো চা এ দেশের সরকারি পানীয়।

আজারবাইযানকে ল্যান্ড অব ফায়ার বলা হয়। কারণ এর নিচে প্রচুর তেল রয়েছে। যা মাঝে মাঝে নানা কারণে জ্বলে ওঠে। এখানে এমন একটি পাহাড় আছে যাতে সারা বছর আগুন জ্বলে। তেলের প্রাচুর্য দেশটিকে আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। নোবেল পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড নোবেলর ভ্রাতৃবৃন্দ আজারবাইযানে তেল কোম্পানি খুলেছিলেন। এর নাম ছিল নোবেল ব্রাদার্স পেট্রেলিয়াম কোম্পানি। এখান থেকে তারা লাভের প্রচুর অর্থ সুইডেন নিয়ে গিয়েছিলেন।

ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বিশ্বের প্রথম তেলের খনি খনন করা হয় বাকুর নিকটবর্তী অঞ্চলে। অটোমান স্রামাজ্য, পারস্য স্রামাজ্য ও রাশিয়া এ তিন পরাশক্তি আজারবাইযানের দখল নিয়ে দীর্ঘদিন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। আজারবাইজান প্রাচীনকাল হতে তেলসমৃদ্ধতার কারণে আগুনের শিখা পাহাড়র ও মাটি ভেদ করে উপরে উঠে আসত। তাই আগুণ ছিল তাদের ভয়, অর্থাৎ শক্তি তথা ঈশ্বরের প্রতীক। আগুণ হতে বাঁচার জন্য তার আগুণের পূজা করত। এভাবে অগ্নিউপাসক দলের সৃষ্টি হয়। যার নেতৃত্ব দেন জোরোয়স্তার।

১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর আযারবাইজানের পতাকা প্রথম ব্যবহার করা হয়। তখন আযারবাইজান স্বাধীন ছিল। পরাধীন হওয়ার পর পতাকাটি বাতিল হয়ে যায়। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি এটাকে পুনরায় ব্যবহার করা হয়। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর পতাকাটি স্বাধীন দেশের পতাকা হিসাবে গৃহীত হয়।

মালি (Mali) : ইতিহাস ও নামকরণ

 মৌরিতানিয়া (Mauritania) : ইতিহাস ও নামকরণ

মরক্কো (Morocco) : ইতিহাস ও নামকরণ

মরিশাস (Mauritius) : ইতিহাস ও নামকরণ

মোজাম্বিক (Mozambique): ইতিহাস ও নামকরণ

আলবেনিয়া (Albania) : ইতিহাস ও নামকরণ

অ্যান্ডোরা (Andorra) : ইতিহাস ও নামকরণ

আর্মেনিয়া (Armenia) : ইতিহাস ও নামকরণ

সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।

Language
error: Content is protected !!