ড. মোহাম্মদ আমীন
আলেজেরিয়া (Algeria)
আলজেরিয়া উত্তর আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত একটি মুসলিম রাষ্ট্র। এর সরকারি নাম পিপস ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব আলজেরিয়া। সুদানের পর এটি আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। আলজেরিয়ার উত্তর-পূর্বে তিউনিসিয়া, পূর্বে লিবিয়া, পশ্চিমে মরোক্ক, দক্ষিণ-পশ্চিমে পশ্চিম-সাহারা, মৌরিতানিয়া ও মালি, দক্ষিণপূর্বে নাইজার এবং উত্তরে ভূমধ্যসাগর অবস্থিত। দেশটিতে ৪৮টি প্রদেশ ও ১,৫৪১টি প্রজাসভা (communes) রয়েছে।
আলজেরিয়া শব্দের বাংলা অর্থ আলজিয়ার্সদের দেশ। শব্দটি ল্যাটিন হতে এসে ফ্রেন্স ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স শহরটি দখল করে নিয়ে নাম রাখে লা আলজেরি (L’Algérie)। লা আলজেরি শব্দটি মূলত ক্যাটালান আল্ডজেরে (Aldjère), অটোমান তুর্কি সেজাইয়ার (Cezayir) এবং আরবি আল-জাজির (al-Jazāir) হতে গৃহীত হয়ে ফরাসি আলজের (Alger) শব্দে স্থিত হয়। এর প্রাচীন নাম জাজির বানি মাজঘান্না (sons of Mazgḥannā) বা মাজঘান্নার পুত্রগণের দ্বীপ। জনপদটি ছিল এ অঞ্চলের চারটি বিখ্যাত দ্বীপের অন্যতম। যা স্থানীয় ও প্রাচীন সানহাজা (Sanhaja) উপজাতীয়দের বাসস্থল ছিল। উল্লেখ্য, ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বীপটি মুল ভূখ-ের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
অনেকের মতে, বার্বার (Berber) ভাষার শব্দ লাজেয়ার (Ldzayer) হতে আলজেরিয়া নামের উৎপত্তি। জিরি ইবনে মানাদ (Ziri ibn-Manad) নামের এক লোক জিরিড নামের একটি সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। স¤্রাটের সন্তানগণ আলোচ্য শহরের গোড়াপত্তন করেন। তারা পিতার নাম অনুসারে শহরটির নাম দেন আলজিরি বা পবিত্র জিরি নগর। পরবর্তীকালে যা আলজেরিয়া নাম ধারণ করে।
অনেকে মনে করেন, বার্বার ভাষায়, জিরি শব্দের অর্থ চাঁদের আলো। দ্বীপটিতে চাঁদের আলো অত্যন্ত প্রকট হয়ে পড়তো এবং এমন ঔজ্জ্বল্য ছিল যে, রাতের বেলাও শহরের লোকজনের চলাফেরা করতে বেগ পেতে হতো না। কেউ কেউ বলেন, রাতের বেলা চাঁদের আলো ছাড়া পথ চলার বা দেখার অন্য কোনো উপায় ছিল না। তাই চাঁদের আলো ছিল স্থানীয়দের খুব প্রিয়। চাঁদের আলোয় ভূখ-টি অপূর্ব সাজে সজ্জিত হয়ে উঠত। তাই বার্বারভাষীর লোকজন জিরি নামে এবং তাদের শহরটি আলজিরি নামে পরিচিতি পায়। ঠিক একইভাবে আলজিয়ার্স নামের উৎপত্তি ঘটে।
মধ্যযুগের ভুগোলবিদ আল-ইদ্রিস বলেন, আলজেরিয়া শহর থেকে আলজিয়ার্স নামের উদ্ভব। আরবি আল-জাজির হতে আলজেরিয় নামটির উদ্ভব। যার অর্থ দ্বীপ। প্রাচীন আল জাজির বনি মাজঘান্না বাক্যগুচ্ছ এ নামের মূল উৎস। এর অর্থ মাজঘান্না উপজাতীয়দের দ্বীপ। এ বাক্যগুচ্ছের শেষ অংশ বাদ দিয়ে আলজেরিয়া নাম চয়ন করা হয়েছে।
আলজেরিয়ার মোট আয়তন ২৩,৮১,৭৪১ বর্গকিলোমিটার বা ৯,১৯,৫৯৫ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ প্রায় শূণ্য। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, জনসংখ্যা ৩,৯৫,০০.০০০ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটার লোকসংখ্যা ১৫.৯ জন। আয়তন বিবেচনায় এটি পৃথিবীর ১০-ম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় ৩৩-তম জনবহুল দেশ। আলজেরিয়ার মোট ভূখ-ের ৮০% সাহারা মরুভূমির অন্তর্ভুক্ত। মোট ভূমির মাত্র ১০-১২% বাসযোগ্য এবং ৪% উর্বর। উর্বর ভূমির পুরোটাই ভূমধ্যসাগর-উপকূলে অবস্থিত। তাই জনসংখ্যার ৯০% উপকূলে বাস করে।
২০১৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, আলজেরিয়ার জিডিপি (পিপিপি) ৫৫১.৭২০ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ১৪,২৫৬ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ২২৭.৮০২ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৫,৮৮৬ ইউএস ডলার। মুদ্রার নাম দিনার। রাজধানী আলজিয়ার্স। আলজেরিয়ার অধিবাসীদের আলজেরিয়ান বলা হয়।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুলাই আলজেরিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুন আলজেরিয়ার বর্তমান জাতীয় পতাকাটি গৃহীত হয়। আরবি আলজেরিয়ার সরকারি ভাষা। তবে বার্বার ও ফ্রেঞ্চ ছাড়াও আরও কিছু স্থানীয় ভাষা প্রচলিত আছে। আলজেরিয়ার ৯৯% অধিবাসী মুসলিম। ছাড়া ইবাদি, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীও রয়েছে।
আয়তন বিবেচনায় আলজেরিয়া আফ্রিকা, আরব বিশ্ব এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বৃহত্তম এবং পৃথিবীর ১০ম বৃহত্তম দেশ। এ দেশের কোনো বৈদেশিক ঋণ নেই। যা ছিল তা পরিশোধ করে দেওয়া হয়েছে। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার পর থেকে আলজেরিয়া স্বাধীনতাকামী মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এখানে প্রচুর পরিমাণ চেরি ও খেজুর জন্মে। এ জন্য এটাকে চেরি ও খেজুরের দেশ বলা হয়। আলজেরিয়ার খেজুর ‘দেগলেত নুর’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেজুর হিসাবে খ্যাত। বিদেশি অতিথিদের তারা খেজুর ও দুগ্ধ দিয়ে স্বাগত জানায়।
বিখ্যাত ফরাসি লেখক আলবার্ট ক্যামু ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। আলজেরিয়ায় আঙুর ও আঙুর হতে প্রচুর মদ্য উৎপাদন করা হয়। ইসলামিক দেশ, তাই অ্যালকোহলিক পানীয় পাওয়া যায় না বললেই চলে। আলজেরিয়ার মোট জিডিপির ৯৮% আসে পেট্রলিয়াম ও গ্যাস হতে। এটি অত্যন্ত গরম দেশ। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৬০.৫ সেন্টিগ্রেড রেকর্ড করা হয়েছে। ইসলামি দেশ হলেও এটি অন্যান্য ইসলামিক দেশের মতো মধ্যযুগীয় নয়। এখানে নারী স্বাধীনতা রয়েছে। বিচাকরদের ৬০% ও আইনজীবীদের ৭০% নারী। তবু অনেক নারী এখনও গৃহবন্দি। এ দেশের আইন ফ্রেঞ্চ ও ইসলামিক।
প্রাকৃতি গ্যাস মজুদে বিশ্বে আলজেরিয়ার স্থান পঞ্চম এবং গ্যাস রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বে দ্বিতীয়। তেল হতেও প্রচুর আয় হয়। তাই জনগণের আর্থিক অবস্থা ভালো। এদেশে প্রচুর ধনী রয়েছে। রাজধানী আলজিয়ার্স পৃথিবীর কয়েকটি ব্যয়বহুল শহরের অন্যতম। তবু আলজেরিয়ার এক চতুর্থাংশ অধিবাসী এক পাউন্ডের কম অর্থ ব্যয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। শিক্ষিতের হার মাত্র ৫৭%। আলজেরিয়ানরা আতিথেয়তা ও মহানুভবতার জন্য বিশ্বে খ্যাত। প্রেপ্যান বা বুটেন (propane/butane) রপ্তানিতে আলজেরিয়া বিশ্বে এখনও প্রথম। ফ্রান্স হতে স্বাধীনতা পেতে আলজেরিয়ার ১ মিলিয়ন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। নর্থ আমেরিকায় আলজেরিয়ায় জীবনযাত্রার খরচ সর্বাধিক। বিশ্বের বৃহত্তম বালিয়াড়ি আলজেরিয়ার অবস্থিত। আফ্রিকার যব বিক্রির সবচেয়ে বড় বাজার এখানে অবস্থিত।
“ A sensible enemy is better than a narrow minded friend.” আলজেরিয়ার প্রবাদ। যা বিশ্বে কয়েকটি শ্রেষ্ঠ প্রবাদের অন্যতম।