ইকুয়েটরিয়াল গিনি (Equatorial Guinea) : ইতিহাস ও নামকরণ

ড. মোহাম্মদ আমীন

ইকুয়েটরিয়াল গিনি (Equatorial Guinea)

দক্ষিণ আমেরিকায় প্রচলিত গিয়ানা (Guiana) স্থানীয় ভাষার শব্দ। এর অর্থ নদীর দেশ। কিন্তু আফ্রিকায় প্রচলিত গিনি (Guinea) শব্দটি এসেছে তুয়ারেগ (Tuareg) ভাষা হতে। এর অর্থ ভাষাহীন মানুষ (speechless people)। কারণ তুয়ারেগরা স্থানীয় ভাষা বুঝত না। সুতরাং দুটি নামের সামঞ্জস্যতা কেবল কাকতালীয়।

বিংশ শতকের প্রথমার্ধে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর উপকূলে তিনটি দেশ ছিল। যাদের নাম – British Guiana, Dutch Guiana  এবং French Guiana । ব্রিটিশ গিয়ানা স্বাধীন হওয়ার পর নাম হয় গিয়ানা। ডাচ গিয়ানার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্চ গিয়ানা এখনও ফ্রেঞ্চ এর অংশ।

আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূলে রয়েছে গিনি (Guinea), গিনি-বিসাউ (Guinea-Bissau), গিনি উপসাগর (the Gulf of Guinea) এবং ইকুয়েটরিয়াল গিনি (Equatorial Guinea)। প্রতিটি দেশ পৃথক হলেও নামটি এসেছে অভিন্ন উৎস হতে। যদিও নিউ গিনির কিয়দংশ ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে। এটাও আফ্রিকার দেশ গিনি হতে নামটি নিয়েছে বা পেয়েছে। কারণ অভিযাত্রীরা এ সকল ভূখ-ের আদিবাসীদের আচার-আচরণে সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিলেন।

গিনির ব্যুৎপত্তি কিন্তু অনশ্চিত। ইংরেজি শব্দ (Guinea সরাসরি পর্তুগিজ শব্দ (Guiné) হতে এসেছে। পঞ্চদশ শতকে শব্দটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এ শব্দটি দ্বারা (Guineus) অধ্যুষিত এলাকা বুঝাতে ব্যবহার করা হতো। এটি ছিল একটি জাতিবাচক পদ। যদ্দ্বারা সেনেগাল নদীর নিচের কৃষ্ণ লোকদের বুঝানো হতো। ইতিহাসবেত্তা ও ঘটনাপঞ্জী রচয়িতা (Gomes Eanes de Zurara) ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন।

১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন (Senhor da Guin) বা লর্ড অব গিনি (Lord of Guinea) পদবি ধারণ করেছিলেন। মনে করা হয়, পর্তুগিজরা এ শব্দটি বার্বার (Berber) পদ গিনিওয়েন (Ghinawen) হতে নিয়েছে। যার অর্থ পোড়া মুখ (the burned face)। কৃষ্ণাঙ্গদের মুখ পোড়ামুখের মতো ছিল। বার্বার ভাষায় (aginaw” or “Akal n-Iguinawen) অর্থ কৃষ্ণ বা কৃষ্ণদের দেশ (black or land of the blacks)।

আরেকটি বিপরীত তত্ত্ব আছে, যা ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে লিও আফ্রিকানাস (Leo Africanus দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গিনি (Guinea) শব্দটি (Djenné) শব্দ হতে এসেছে। (Djenné ছিল আপার নাইজার নদীর একটি বিখ্যাত ও সমৃদ্ধ শহর। একাদশ শতকে ঘানার পতনের পর থেকে ত্রয়োদশ শতকে, মালির আক্রমণে ব্যবসায় সংকট দেখা না দেওয়া পর্যন্ত শহরটি স্বর্ণ ও লবণ বাণিজ্যের জন্য পশ্চিম আফ্রিকায় একক আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এ সময় (Genewah) নামটা প্রভাব বিস্তারকারী হিসাবে আরব বিশ্বের মাধ্যমে (al-Sudan – Arabic for “blacks” – is used more commonly before) ছড়িয়ে পড়ে।

অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশ মুদ্রা ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিভিন্ন এলাকায় গিনি নামে পারিচিত ছিল। এখনও অনেক দেশে গিনি বলতে মূল্যবান মুদ্রা বুঝায়। কিন্তু ইকুয়েটরিয়াল গিনি হলো কেন? কারণ এ দেশটির জনগণ গিনির লোকের মতো ছিল বা দেশটির অবস্থান ও অন্যান্য ভৌগোলিক অবস্থান গিনি নামের অন্তর্ভুক্ত দেশের ন্যায় ছিল।

মধ্য আফ্রিকায় অবস্থিত ইকুয়েটরিয়াল গিনির সরকারি নাম রিপাবলিক অব ইকুয়েটরিয়াল গিনি। ইকুয়েটরিয়াল গিনির মোট আয়তন ২৮,০৫০ বর্গকিলোমিটার বা ১০,৮৩০ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ নগণ্য। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, ইকুয়েটরিয়াল গিনির জনসংখ্যা ৭,২২,২৫৪ জন এবং প্রতি বর্গকিলোমিটার লোকসংখ্যা ২৪.১ জন । আয়তন বিবেচনায় ইকুয়েটরিয়াল গিনি পৃথিবীর ১৪৪-তম বৃহত্তম দেশ এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় ১৫০-তম। কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এটি পৃথিবীর ১৮৭-তম জনবহুল দেশ।

২০১০ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, ইকুয়েটরিয়াল গিনির জিডিপি (পিপিপি) ১৯.২৮৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ২৫,৯২৯ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ১৫.৫৮০ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ২০,৫৮১ ইউএস ডলার। মুদ্রার নাম ফ্রাঙ্ক। রাজধানী মালাবো এবং বৃহত্তম শহর বাটা। সরকারিভাবে ইকুয়েটরিয়াল গিনির অধিবাসীদের ইকুয়েটরিয়াল গিনিয়ান বা ইকুয়েটোগিনিয়ান বলা হয়। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর দেশটি স্পেন হতে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ আগস্ট ইকুয়েটরিয়াল গিনির বর্তমানে প্রচলিত পতাকাটি গ্রহণ করা হয়।

ইকুয়েটরিয়াল গিনির সরকারি ভাষা স্পেনিশ। তবে ফ্রান্স ও পর্তুগিজ ভাষাও বহুল প্রচলিত। এ ছাড়া অন্যান্য কিছু আঞ্চলিক ভাষাও প্রচলিত আছে। জনসংখ্যার ৯৩% খ্রিস্টান, ২% সুন্নি মুসলমান এবং বাকিরা অন্যান্য ধর্মের অনুসারী।

ইকুয়েটরিয়াল গিনির প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে লৌহ আকরিক, টিটানাম, বক্সাইট, ম্যাঙ্গানিজ, ইউরেনিয়াম, অ্যালুভিয়াল গোল্ড রয়েছে। তবে এগুলো এখনও উত্তোলন প্রক্রিয়ায় যায়নি। দেশের অধিকাংশ এলাকা আফ্রিকার মূল ভূমিতে অবস্থিত। তবে রাজধানী মালাবো নর্দান উপকূলের বাইকু দ্বীপে অবস্থিত। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে বাইকু দ্বীপ খুঁজে পাওয়ার পর এর নাম রাখা হয়েছিল পোর্ট ক্লিয়ারেন্স।

দেশের বৃহত্তম শহর বাটা এর প্রাক্তন রাজধানী। এটি আফ্রিকার একমাত্র দেশ, যার অধিকাংশ এলাকা মূল মহাদেশে যুক্ত হলেও রাজধানী দ্বীপে। দোকান-পাট ও রাত্রিকালীন জীবনযাত্রার জন্য বাটা বিখ্যাত। ইকুয়েটরিয়াল গিনি আফ্রিকার একমাত্র দেশ, যার সরকারি ভাষা স্পেনিশ। এটি একটি গরীব রাষ্ট্র ছিল। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে তেল আবিষ্কারের পর রাতারাতি মাথাপিছু আয় ৫৯০ ডলার থেকে পাঁচগুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে এ দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ২০,৫৮১ ইউএস ডলার। নাইজেরিয়া ও অ্যাঙ্গোলার পর এটি সাব-সাহারান অঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। তারপরও সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাবে দারিদ্রতা রয়ে গেছে।

কীভাবে হলো দেশের নাম

মিশর

 

Language
error: Content is protected !!