কীভাবে হলো দেশের নাম
ড. মোহাম্মদ আমীন
ইতালি (Italy)
ইতালি পশ্চিম ইউরোপের একটি একীভুত প্রজাতান্ত্রিক সংসদীয় রাষ্ট্র। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত একটি দেশ। শেনঝেন চুক্তি স্বাক্ষরকারী বিধায় শেনঝেন ভিসা নিয়ে এ দেশে প্রবেশ করা যায়। ইতালির উত্তর সীমান্তে আল্পাস পর্বতমালা সংলগ্ন ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও স্লোভেনিয়া এবং দক্ষিণে সম্পূর্ণ ইতালীয় উপদ্বীপ, মেডিটারিয়ান সমুদ্র সংলগ্ন দুই মহাদ্বীপ সিসিলি ও সারদিনিয়া এবং আরও অনেক ছোট ছোট দ্বীপে পরিবেষ্টিত। সান মারিনো ও ভ্যাটিক্যান সিটি নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ইতালি অধিভুক্ত, অপরদিকে কাম্পিওনে দি’ইতালিয়া বহির্ভূত সুইজারল্যান্ড ধারন করেছে। ইতালির রাজধানী রোম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যময় শহর। ইতালির ম্যাপ দেখতে ঠিক বুট জুতার মতো। ইতালির সরকারি নাম ইতালিয়ান রিপাবলিক।
ওস্কান ভাষার শব্দ ভিটেলিও (Víteliu) প্রথম গ্রিকভাষায় এসে পরিবর্তিত হয়ে ল্যাটিনরূপ ইটালিয়া (Italia) ধারণ করে। বলা হয়, এ ল্যাটিন শব্দ ইতালিয়া (Italia) হতে ইতালিয়া (Italia) বা ইতালি নামের উদ্ভব। ওস্কান ভাষার সূত্র ধরে পরিবর্তিত ইতালিয়া শব্দের অর্থ অল্পবয়স্ক গবাদিপশুর চারণভূমি বা তাগড়া গবাদিপশুর চারণভূমি বা জোয়ান ষাড়ের চারণভূমি।
হ্যাসিচিয়াস (Hesychius) তার (collection of 51,000 unusual, obscure and foreign words) গ্রন্থে লিখেছেন, ইটালোস (Italos) হতে ইটালি নামের উদ্ভব। যার অর্থ ষাড় (bull)। ল্যাটিন ভাষার ভিটুলাস (vitulus) শব্দের অর্থ বাছুর (calf)। যা ওস্কান ভাষা হতে হতে আগত শব্দ ভিটেলিও (Víteliu) এর সামান্য পরিবর্তন। এ পবির্তনের ফলে যে অর্থ হয়েছে সেটি হচ্ছে ইয়াং কাপ বা তাগড়া ষাড় বা শক্তিশালী ষাড়।
“ইতালিয়া” (Italia) নামের ব্যুৎপত্তিটির পুর্বধারণা আছে এবং এর সমাধানের পথ নিয়ে ইতিহাসবিদ ও ভাষাবিদরা নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অনেকগুলো বর্ণনা থেকে অন্যতম ব্যাখ্যা হলো, ইতালিয়া শব্দটি ল্যাটিন ইতালিয়া থেকে এসেছে। যা গ্রিক শব্দ ওসকান (Oscan Víteliu) যার অর্থ “ছোট ছোট গবাদিপশুর চারণভূমি” (land of young cattle)। কথিত হয় শব্দগুচ্ছটি (cf. Lat vitulus “calf”, Umb vitlo “calf”); থেকে গৃহীত করা হয়েছে। ষাঁড় ছিলো একটি দক্ষিণ ইতালীয় উপজাতির প্রতীক এবং স্বাধীন ইতালির সামনিট যুদ্ধের সময় রোমান উদ্ধত নেকড়েকে রক্তাক্ত করে বলে প্রায়শ শোনা যায়।
গ্রিক ইতিহাসবিদ ডিওনিসিয়াস অব হালিকারনাসাস (Dionysius of Halicarnassus) লোককাহিনির বরাত দিয়ে ইতালিকে ইটালুস (Italus) আখ্যা দিয়েছিলেন। এরিস্টটল ও থুসিদিদেসও (Thucydides) অভিন্ন মত দেন। ইতালি নামটি প্রকৃত অর্থে বর্তমান দক্ষিণ ইতালির জন্য প্রযোজ্য ছিল; যা এন্টিওচুস অব সাইরাকাস এর মতে, ব্রুত্তিউম উপদ্বীপের দক্ষিণভাগ (বর্তমান কালাব্রিয়া)। তার সময়ে ইতালি ও এনোট্রিয়া (Oenotria) সমার্থক ছিল। এটি লুকানিয়ার কিছু অঞ্চলের জন্যও ব্যবহৃত হতো। যা বৃহত্তর অঞ্চলের জন্য গ্রিকরা ইতালিয়াতে ধীরে ধীরে প্রচলন করেন কিন্তু পুরো উপদ্বীপ রোমানরা জয়লাভের আগ পর্যন্ত এর ব্যাপকতা ছিল না।
ইতালির মোট আয়তন ৩,০১,৩৩৮ বর্গকিলোমিটার বা ১,১৬,৩৪৭ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ ২.৪%। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, ইতালির মোট জনসংখ্যা ৬,০৭,৯৫,৬১২ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ২০১.৭। আয়তন বিবেচনায় ইতালি পৃথিবীর ৭২-তম এবং জনসংখ্যা বিবেচনায় ২৩-তম বৃহত্তম দেশ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনা করলেও এটি পৃথিবীর ২৩-তম জনবহুল দেশ। রাজধানী রোম ইতালির বৃহত্তম এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শহর।ইতালির অধিবাসীদের সরকারিভাবে ইতালিয়ান বলা হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের এ দেশটির অধিবাসীরা ইতালিয়ান নামে পরিচিত।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, ইতালির জিডিপি (পিপিপি) ২.১৭৪ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৩৬,৬৬৫ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ১.৮১৯ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ২৯,৮৪৭ ইউএস ডলার। মাথাপিছু আয় বিবেচনায় ইতালি পৃথিবীর ২৭-তম ধনী দেশ। মুদ্রার নাম ইউরো। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুন ইতালির পতাকা প্রথম গৃহীত হয়। যা ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি পুনরায় গৃহীত হয়।
ইতালির দাপ্তরিক নাম ইটালিয়ান রিপাবলিক। রাজধানী রোম। মিলান, নেপলস, তুরি ও পালেরমো অন্যান্য শহর। রোম প্রাচীন রোমান সভ্যতার কেন্দ্রভূমি ছিল। পাশ্চাত্য সভ্যতা মূলত রোমান নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত ও বিকশিত। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, ইটালির লোকসংখ্যা ৬,১২,৬১,২৫৪। ভ্যাটিকান সিটি ও স্যান ম্যারিনো নামের দুটি স্বাধীন দেশ পুরো ইটালির ভেতর অবস্থিত। ক্যাম্পোইন ডি ইটালিয়া ইটালির অংশ কিন্তু এটি সুইজারল্যান্ড সীমান্তের মধ্যে অবস্থিত। ইটালি ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত। ইটালি রেনেসাঁর জন্মভূমি। এ সময় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-সংস্কৃতি শিল্পকর্মের লালনভূমি হয়ে ওঠেছিল ইটালি। বিখ্যাত আর্টিস্ট মাইকেলাঞ্জেলো, র্যাপায়েল, ডোনাটেলো ও লিওনার্দো দা ভিঞ্চিসহ আরও অনেক খ্যাতিমান শিল্পীর জন্মস্থান ইটালি। গ্যালিও গ্যালিলি, আলসেন্দ্রো ভোল্টা, পিবোনাক্কিও মতো কালজয়ী বিজ্ঞানীর জন্ম ইটালি। ইটালির প্রধান ভাষা ইটালিয়ান। তবেএখানে জার্মান, ফ্রেঞ্চ ও সোলেভেন ভাষাও কিছু কিছু এলাকায় প্রচলিত আছে।
উারারি, ল্যাম্বোরগিনি, আলফা রোমিও ও ম্যাসেরাটি ইটালির গাড়ি প্রস্তুত প্রতিষ্ঠান। প্রিয় খেলা ফুটবল। বিশ্বকাপে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইটালি চার বার জয়লাভ করেছে। ইটালির পিজা বিশ্ববিখ্যাত। কলোসেয়াম, প্যান্থন ও পিসার হেলান টাওয়ারসহ আরও অনেক বিশ্ববিখ্যাত ভবনের জন্য ইটালি প্রাচীনকাল হতে বিখ্যাত।
জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় ইতালি ইউরোপের চতুর্থ জনবহুল দেশ। আয়তনে এটি যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনার সমান হলেও জনসংখ্যা আরিজোনার ১০ গুণ। ইতালির রাজধানী রোমকে ঝর্ণার শহর বলা হয়। এখানে ৫০টি বড় এবং আরও অনেকগুলো ছোট ছোট ঝরণা রয়েছে। ৮৬ ফুট উঁচু ত্রেভি সবচেয়ে প্রাচীন ঝরণা। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের অষ্টম পোপ আরবান এটি প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত হয়, এখানে কেউ মুদ্রা ছুড়ে দিলে তাকে আমার ইতালি ভ্রমণে আসতে হয়। প্রতিদিন এখানে ৩০০০ ইউরোর সমপরিমাণ মুদ্রা নিক্ষেপ করা হয়। প্রতি সপ্তাহে মুদ্রাগুলো সংগ্রহ করা হয়। দেশীয় ধাতবমুদ্রা ঝরণার উন্নয়নে ব্যয় করা হয় এবং বিদেশে মুদ্রাগুলো রেডক্রসে দান করা হয়।
১৫,৭৭১ ফুট উঁচু ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত মন্ট ব্লান্ট ইংরেজি ভাষায় সাদা পবর্ত নামে পরিচিত। আল্পস পবর্তমালার অংশ এ পর্বতটি ইতালিতে ফ্রান্সে সীমান্তের ওপর অবস্থিত। জাতীয় আয়ের ৬০% আসে পর্যটন হতে। ফুটবল ইতালির সবচেয়ে প্রিয় খেলা।
ইতালির মোট আয়তনের চার-পঞ্চমাংশ হয়তো পাহাড় নয়তো পার্বত্য ভূমি। ইউরোপের তিনটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি হচ্ছে : ইতনা, স্ট্রমবোলি ও ভিসুভিয়াস। তিনটিই ইতালিতে অবস্থিত। এটি ইউরোপের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পণপ্রবণ দেশ। ১৬৯৩ খ্রিষ্টাব্দে এক ভূমিকম্পে ইতালির সিসিলি নগরের ১ লাখ লোক নিহত হয়েছিল। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ইতালির নেপলসে আঘাত হানা ভূমিকম্পে ৩,০০০ লোক মারা যায়। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ২৬ মিলিয়ন ইতালিয়ান ভালো জীবনযাত্রার সন্ধানে ইতালি ত্যাগ করে। তন্মধ্যে মাত্র ৪ জন আবার দেশে ফেরত এসেছিল।
পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট স্বাধীন দেশ ভ্যাটিকান সিটি (১০৮.৭ একর) ইতালির পেটের ভেতর অবস্থিত। এ ছাড়া আর একটি ছোট দেশ সান ম্যারিনো (২৫ বর্গমাইল) ইতালির মধ্যে অবস্থিত। এ দেশে ৫০টি ইউনেস্কো নির্ধারিত বিশ্ব ঐতিহ্য রয়েছে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এককভাবে এতটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য নেই। এটি পৃথিবীর চতুর্থতম পরিদর্শিত দেশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মদ রপ্তানি করে ইতালি। ইতালির জনগণের ৮৫ ভাগ রোমান ক্যাথলিক। বাকিদের মধ্যে প্রটেস্ট্যান্ট, ইহুদি ও মুসলিম অন্যতম।
১৬১২ খ্রিস্টাব্দো সান্তোরিও সান্তোরিও নামের এক ইতালিয়ান প্রথম থার্মোমিটার আবিষ্কার করেন। ইতালিয়ান আলস্যান্দ্রো ভোল্টা প্রথম ব্যাটারি আবিষ্কার করেন। বিশ্বখ্যাত চিত্রকর মাইকেলেঞ্জেলো (Michelangelo di Lodovico Buonarroti Simon) ইতালিয়ান। পঞ্চদশ শতকের দিকে ইতালির ক্রোমেনার অ্যান্ড্রেয়া আমাতাই (of Andrea Amati) বেহালা আবিষ্কার করেন। শহরটি বিখ্যাত বেহালা-নির্মাতা অ্যান্তনিও স্ট্রাডিভারির জন্মস্থান হিসাবেও খ্যাত।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে রকো নামের এক কুকুর ৩.৩ পাউন্ড ওজনের ট্রাফল (truffle) নামের এক ছত্রাক আবিষ্কার করে। যা নিলামে ৩,৩৩,০০০ ইউএস ডলারে বিক্রি হয়ে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করে। পৃথিবীর দীর্ঘত ভূমি-ট্যানেল লটসসেবার্গ বেজ টানেল (Lötschberg Base Tunnel)। ২২ মাইল দীর্ঘ এ টানেলটি রেল লাইনের মাধ্যমে ইতালির সঙ্গে সুইজারল্যান্ডকে যুক্ত করেছে। পিসার হেলান টাওয়ার ১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয়। সম্ভবত নির্মাণ ত্রুটির কারণে এটি হেলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি বাহিনী এটাকে নজর ঘঁটি (watch tower) হিসাবে ব্যবহার করে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে এটাকে সংস্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হলে ইঞ্জিনিয়ারগণ ঘোষণা করে যে, গত ২০০ বছর যাবত এটির অবস্থান পরিবর্তন হয়নি, অবিকল রয়ে গেছে।
ইতালির পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ় ও হদৃয়গ্রাহী। অনেক অবিবাহিত ইতালিয়ান ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি পেলেও বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে অবস্থান করে। কমপক্ষে আঠারো বছর বয়স হলে একজন ইতালিয়ান সংসদের নিম্নকক্ষে চেম্বার অব ডেপুটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারে। সিনেট নামের ৩১৫ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনে ভোট দিতে হলে বয়স কমপক্ষে ২৫ হতে হয়।
ইতালিয়ান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২) প্রথম ঘোষণা করেন যে, পৃথিবীর সূর্যের চারিদিকে ঘুরে। এ ঘোষণার পর ক্যাথলিক গির্জা তাকে নিজের বাড়িতে বন্দি করে রাখে। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে এজন্য গির্জা ক্ষমাপ্রার্থনা করে। ইতালির ভেনিস পৃথিবীর সুন্দরতম শহর।
হাঙ্গেরি (Hungary) : ইতিহাস ও নামকরণ
আইসল্যান্ড (Iceland) : ইতিহাস ও নামকরণ
আয়ারল্যান্ড (Irelan) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক