[এটি গল্প নয়, নিরেট বাস্তবতা। ১২/৪/২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ তারিখ শুক্রবার সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চাকুরির সাক্ষাৎকার বোর্ডে উপস্থিত তরিকুল নামের এক চাকুরি প্রার্থীর ঘটনা অবিকল তুলে ধরলাম। সাক্ষাৎকার বোর্ডে আমি বিষয়-বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত ছিলাম।]
বারোই এপ্রিল, শুক্রবার।
চাকুরির সাক্ষৎকার-প্রার্থীরা সুপরিসর নান্দনিক অফিসের বিশাল ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমাণ।বোর্ডের চেয়ারম্যান সাহেব সিসিটিভি ক্যামেরায় তাদের পর্যবেক্ষণ করছিলেন। আমি, চা পানের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত প্রার্থীদের বায়োডাটা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। একজন প্রার্থী ইন্টারভিউ দিয়ে বের হয়ে গেলেন। ভালোই করেছে ছেলেটি এবং অসম্ভব ভালো। ছেলেটি বের হয়ে যাবর পর চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর পিএসকে ডেকে বললেন, মেয়েদের আগে ডাকো। তাদের আগে ছেড়ে দিতে হবে।কয়জন মেয়ে এসেছেন?
পিএস বললেন, একজনও না।
একজন যে দেখা যাচ্ছে? চেয়ারম্যান সাহেব প্রশ্ন করলেন।
“তিনি প্রার্থী নন”, পিএস বললেন “প্রার্থী হচ্ছেন তার স্বামী। তিনি স্বামীর সঙ্গে এসেছেন।
“ওই প্রার্থীকেই ডাকো”, চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, “ সঙ্গে তার স্ত্রীকেও আসতে বলো।”
কয়েক মিনিট পর সাক্ষাৎকার বোর্ডে ঢুকলেন ছেলেটি।শ্যামলা রঙের ছেলেটির মাথায় চুল নেই বললেই চলে। মুখে হতাশার মাঝে ক্ষোভ আর অভিমান দগদগ করছে গ্লানির কষ্টে। সস্তা দামের শার্ট-প্যান্টের আড়ালে যেন একটা বিশাল বিক্ষোভ বিস্ফোরণের অপেক্ষায়।মুখে হাসি দূরে থাক, চিহ্নমাত্র নেই।
চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে বললেন, আপনিই প্রশ্ন শুরু করুন।
ছেলেটির নাম তরিকুল ইসলাম, পিতার নাম- মো. বিল্লাল হোসেন, মায়ের নাম : মোসা: শরিফা বেগক, গ্রাম- চাকই, ডাকঘর : মির্জাপুর। ঢোকার আগে আবেদন থেকে নামধাম জেনে নিয়েছি। জেনে নিয়েছি শিক্ষাগত-যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য। ঢোকার আগে আবেদন থেকে নামধাম জেনে নিয়েছি। জেনে নিয়েছি শিক্ষাগত-যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য। অভয়নগর উপজেলার রাজঘাট জাফরপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০০ খ্রিষ্টা্ব্দে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেছেন।
তবু প্রথাগত ধারায় প্রশ্ন করলাম, আপনার নাম?
ছেলেটি কাতর ভঙ্গিতে মলিন গলায় বলল, তরিকুল ইসলাম।
বাড়ি?
নড়াইল, উপজেলা সদর।
শিক্ষাগত যোগ্যতা?
বিএসএস (অনার্স), এমএসএস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
কোন হলে সংযুক্ত ছিলেন?
হাজি মোহাম্মদ মোহসিন হল।
সাবজেক্ট দেখলাম- সোসিওলজি। এসএসসি প্রথম বিভাগ, এইচএসসি, অনার্স ও মাস্টার্সে দ্বিতীয় শ্রেণি। দুই হাজার আট খ্রিষ্টাব্দে অনার্স এবং দুই হাজার এগারো খ্রিষ্টাব্দে মাস্টার্স পাস করেছে তরিকুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সপ্তাহ-২০০৬ এ তরিকুল দাবা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন।
মুখটা এমন গোমড়া করে রেখেছেন কেন? হাসুন।
তরিকুল হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু ওটি হাসি হলো না। মনে হলো, দন্তচিকিৎসক অস্ত্রোপচরের জন্য তরিকুলকে ঠোঁট দুটি ফাঁক করে রাখতে বলেছেন এবং তরিকুল তা-ই করছে।
এতদিন কিছু করেননি? প্রশ্ন করলাম।
তরিকুল বললেন, বেক্সিমকোতে জয়েন করেছিলাম। ছয় মাস পর স্থায়ী করার কথা ছিল, কিন্তু ছয় মাস পর জানাল, আরো ছয় মাস পর স্থায়ীকরণ বিবেচনা করা হবে। এত বড়ো কোম্পানির এমন নড়চড় কথা ভালো লাগল না, ছেড়ে দিলাম চাকুরি। এখন বুঝতে পারছি, চাকুরিটা ছাড়া উচিত হয়নি। অনেক লুজার হয়ে গেলাম।
কয় মাস চাকুরি করেছিলেন? চেয়ারম্যান সাহেব প্রশ্ন করলেন।
ছয় মাস।
তারপর?
ঢাকার একটা শিশু বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি।
বিদ্যালয়টির নাম কী?
উন্নত বাংলাদেশ আইডিয়াল একাডেমী।
চাকুরি ছেড়ে দিলেন কেন?
বেতন ছিল গৃহকর্মীর চেয়ে কম। বাড়াতে বললাম, বাড়াবে বাড়বে করে দুই বছর পার করে দিল। একদিন রাগ করে ওই চাকুরিটাও ছেড়ে দিলাম । এরপর আর একটা শিশু স্কুলে যোগ দিলাম- এটির অবস্থা আরো খারাপ; এক মাস বেতন দেয় তো, দুমাস রাখে বাকি। ওটাও ছেড়ে দিলাম। অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছি, চাকুরি হয়নি। আমি, স্যার লেখালেখিও করি।
আবেদনের সঙ্গে যুক্ত অভিজ্ঞতা-সনদের সঙ্গে তরিকুলের কথার মিল আছে হুবুহু। হাতের লেখাও বেশ সুন্দর, আবেদনের ভাষাতেও কিছুটা নতুনত্ব আছে।অভয়নগর উপজেলায় তার স্কুল জীবন কেটেছে। আমি ওই উপজেলার ইউএনও ছিলাম শুনে অনেক স্মৃতিকে চারণ করলেন তরিকুল। বোর্ডকে আমি তার কাছে বন্ধু করে তুললাম। অবশ্য আমি যে-কোনো চাকুরির সাক্ষাৎকার বোর্ডে এমনই করি।
তরিকুলের স্ত্রীকে সোফায় বসতে দেওয়া হয়েছে। তার দিকে চোখ পড়তে আমি ভীষণ হোচট খেলাম। এখানে আসার পূর্বে নিশ্চয় ভালো পোশাকটিই পরে এসেছেন মহিল; তবু মনে হলো, কোনো গৃহকর্মী। আসলে এমন স্থানে আসার সময় কোনো গৃহকর্মীও এমন পোশাক পরবেন না। আমাদের গৃহকর্মী হনুফার কর্ম-পোশাক তরিকুলের স্ত্রীর চেয়ে অনেক ভালো। সবচেয়ে অবাকের বিষয়, পোশাকের আগে চোখে পড়ছিল তরিকুলের স্ত্রীর পুষ্টিহীন মুখে নৈরাশ্যের মেঘ। পুরো শরীরে অভাবের নেকড়ে নখর ভয়াবহ হয়ে চোখ দুটোকে পাণ্ডুর করে রেখেছে।
এখন কী করেন? তরিকুলের কাছে জানতে চাইলাম।
“রঙ মিস্ত্রির কাজ করি”, তরিকুল বলল,“ দেখুন, স্যার হাত; রঙের উপর রঙ লেগে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে । ক্যামিকেল না স্যার!
চেয়ারম্যান সাহেব বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকালেন, আমি তাঁর দিকে। কর্মজীবনে অনেক ইন্টারভিউ নিয়েছি, অনেক করুণ অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে জমা হয়ে আছে, কিন্তু তরিকুলের অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকম মনে হলো। তরিকুলের পরাজয়, পরাজয়ের পর টিকে থাকার প্রয়াসে রাজমিস্ত্রি হওয়া- আমার কাছে ব্রুসলি আর মাকড়সার গল্পটাকে উদ্ভাসিত করে দিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোসিওলজিতে মাস্টার্স পাস করে রঙমিস্ত্রি? চেয়ারম্যান সাহেবের গলায় বিস্ময়, তবে অবিশ্বাসের কিছু নেই; আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া দুটি সনদ।
“জ্বি, স্যার”, তরিকুল বলল, “আমি রঙমিস্ত্রি নই, রঙমিস্ত্রির হেল্পার, দৈনিক সাড়ে চারশ টাকা করে পাই। আমার বস, মানে মিস্ত্রী পান ছয়শ থেকে সাড়ে ছয়শ টাকা। আমার বউ আমার পরিচয় দিতে লজ্জা করে, অথর্ব আর অপদার্থ গালি দেয়। তবু ছাড়ি না, ছাড়লে খাব কী? মাস্টারি করলে পাব ছয় হাজার টাকা; এখন পায় তেরো হাজার পাঁচশ টাকা।
আমি ভাবছিলাম তরিকুলের কথা, তার সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করছিলাম- যে চাকুরি জন্য সে এসেছে তার স্বরূপ; এমন ছেলেই প্রয়োজন, যে কারণেই হোক না; যে হতাশার গহ্বর থেকে উঠে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।
আমি বললাম, ছেড়ে দিন রাজমিস্ত্রির চাকুরি।
তারিকুল অবিশ্বাসের চোখে বললেন, তাহলে চলব কীভাবে?
“চেয়ারম্যান সাহেব বাস্তবতার কঠিন অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ কোনো প্রার্থীকে চাকুরি না-দিয়ে ছাড়বেন বলে মনে হয় না। আমি আপনার মাঝে এমন প্রত্যয় দেখেছি, যদি আপনি মিথ্যা না-বলেন; কথাগুলো বলে আমি চেয়ারম্যান সাহেবের দিকে তাকালাম।
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, তারিকুল, আপনি আগামী মাসে জয়েন করেন।
To provide the best experiences, we use technologies like cookies to store and/or access device information. Consenting to these technologies will allow us to process data such as browsing behavior or unique IDs on this site. Not consenting or withdrawing consent, may adversely affect certain features and functions.
Functional
Always active
The technical storage or access is strictly necessary for the legitimate purpose of enabling the use of a specific service explicitly requested by the subscriber or user, or for the sole purpose of carrying out the transmission of a communication over an electronic communications network.
Preferences
The technical storage or access is necessary for the legitimate purpose of storing preferences that are not requested by the subscriber or user.
Statistics
The technical storage or access that is used exclusively for statistical purposes.The technical storage or access that is used exclusively for anonymous statistical purposes. Without a subpoena, voluntary compliance on the part of your Internet Service Provider, or additional records from a third party, information stored or retrieved for this purpose alone cannot usually be used to identify you.
Marketing
The technical storage or access is required to create user profiles to send advertising, or to track the user on a website or across several websites for similar marketing purposes.
স্যার, তরিকুল সাহেবের পরবর্তী অবস্থা জানাবেন? সম্ভব হলে তাঁর হাসি মাখা একটি ছবি দিবেন।