কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)
ড. মোহাম্মদ আমীন
ইন্দোনেশিয়া (Indonesia)
গ্রিক শব্দ ইন্দোস (Indos) ও নেসস (nesos) ইতে ইন্দোনেশিয়া নামের উদ্ভব। নেসস শব্দের অর্থ দ্বীপ। সুতরাং ইন্দোস-নেসস শব্দের অর্থ ইন্দো-দ্বীপ। মূলত ইন্ডিস আইল্যান্ডস (Indies Islands) হতে ইন্দোনেশিয়া নামের উদ্ভব। এর অর্থ ইন্ডিয়ান আইল্যান্ড। ইন্দোনেশিয়ার প্রাচীন নাম ছিল ইস্ট ইন্ডিস বা পূর্ব ইন্ডিয়া। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে এই নাম পরিবর্তন করো ইন্ডিস আইল্যান্ড রাখা হয়। ইন্ডিস আইল্যান্ড নাম ক্রমপরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান নামে স্থিতি পায়।
ইন্দোনেশিয়া ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ড হতে স্বাধীনতা লাভ করে। ডাচ শাসনকালে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার নাম ছিল বাটাভিয়া। এখানে প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে বসবাসরত হোমো ইরেকটাস শ্রেণির মানুষের জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার প্রথম পতাকা গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট তা কিছুটা পরিবর্তন করে গ্রহণ করা হয়।
ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। জনসংখ্যা বিবেচনায় এটি পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। এর রাজধানীর জাকার্তা। ইন্দোনেশিয়ার দাপ্তরিক নাম ইন্দোনেশীয় প্রজাতন্ত্র। ইন্দোনেশিয়া ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে একটি কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত। ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে পাড়ি দেওয়ার অধিকাংশ নৌপথ ইন্দোনেশিয়া হয়ে বিস্তৃত। ইন্দোনেশিয়া প্রায় সাড়ে সতের হাজার দ্বীপ রয়েছ। তন্মধ্যে মাত্র ৬ হাজার দ্বীপে মনুষ্যবসতি আছে। সুমাত্রা, জাভা, সুলাওয়েসি, বোর্নিও ও নিউ গিনি পাঁচটি প্রধান দ্বীপ।
ইন্দোনেশিয়ায় বর্তমানে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু রয়েছে। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান। এথনোলগ অনুসারে ইন্দোনেশিয়ায় ৭৪২টি ভাষা আছে। তন্মধ্যে ৭৩৭টি জীবিত, ২টি দ্বিতীয় ভাষা যাদের কোনো মাতৃভাষী জীবিত নেই, এবং ৩টি বর্তমানে বিলুপ্ত। ইন্দোনেশিয়ার সরকারি ভাষার নাম বাহাসা ইন্দোনেশিয়া। এটি মূলত মালয় ভাষার একটি পরিবর্তিত রূপ। তবে অধিকাংশ লোক স্থানীয় জাভানীয় ভাষায় কথা বলে।
ইন্দোনেশিয়ার মোট আয়তন ১৯,০৪,৫৬৯ বর্গকিলোমিটার বা ৭,৩৫,৩৫৮ বর্গমাইল। জলীয়ভাগের পরিমাণ ৪.৮৫%। আয়তন বিবেচনায় ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর ১৫-তম বৃহত্তম রাষ্ট্র। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ার মোট জনসংখ্যা ২৫,৫৪,৬১,৭০০ এবং প্রতিবর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১২৪.৬৬। মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর ৪র্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং জনঘনত্ব বিবেচনায় ৮৪-তম জনবহুল দেশ। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে ইন্দোনেশিয়ার মোট জিডিপি (পিপিপি) ২.৮৪০ ট্রিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ১১,১৩৫ ইউএস ডলার, যা বিশ্ব বিবেচনায় ১০২-তম। জিডিপি (নমিনাল) ৮৯৫.৬৭৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং এ হিসাবে মাথাপিছু আয় ৩,৫১১ ইউএস ডলার। দেশটির গিনি ৩৫.৬ এবং এইচডিআই ০.৬৮৪ (১০৮-তম)।
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জ। এখানে ১৭,৫০৮টি দ্বীপ রয়েছে। তন্মধ্যে কেবল ৬০০০ দ্বীপে লোক বসবাস করে। দেশের একপ্রান্ত উত্তর সুমাত্রা হতে অন্যপ্রান্ত পশ্চিমে পাপুয়া নিউগিনি পর্যন্ত যেতে হলে ১২ ঘণ্টা উড়তে হয়। ইন্দোনেশিয়া তিনটি টাইমজোনে বিভক্ত। এটা পৃথিবীর অন্যতম একটা দেশ যার আয়তন পুরোপুরি পরিমাপ করা এখনও যায়নি। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দ্বীপ। এ দ্বীপে ২৫০ মিলিয়ন লোক বসবাস করে। মার্কোপোলো প্রথম ইউরোপিয়ান, যিনি ইন্দোনেশিয়া যান। তিনি মসলার খোঁজে ইন্দোনেশিয়া গিয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রায় ৩৫০ বছর ইন্দোনেশিয়া ডাচদের অধীনে ছিল। এজন্য ইন্দোনেশিয়ার অনেক নাগরিক সাবলীলভাবে ডাচ ভাষায় কথা বলতে পারে। ডাচ ভাষার অনেক শব্দ ইন্দোনেশিয়ান ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে।
বিষুবরেখা ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার উপর দিয়ে গিয়েছে। তাই এটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। এর তাপমাত্রা ২০-৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে বলে খুবই আরামদায়ক। ভাত ইন্দোনেশীয়দের প্রধান খাদ্য। যতই খাবার খাওয়া হোক না কেন, ভাত না হলে তাকে তারা সম্পূর্ণ খাদ্য বলতে নারাজ। তারা মসলাপ্রধান খাদ্য খেতে পছন্দ করে। মরিচ সহযোগে নারিকেল, দুগ্ধ, মাছ ও চিকেন প্রভৃতি খাবারের প্রধান উপাদান। ব্যাঙ ইন্দোনেশিয়ার মুসলিমরা খায় না তবে প্রতিবছর ৩ হাজার টন ব্যাঙের পা ফ্রান্সে রপ্তানি করে।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি বিবেচনায় ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর দ্বিতীয় আকর্ষণীয় দেশ। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে এখানে ১০ মিটার লম্বা একটা সাপ পাওয়া গিয়েছে। এ পর্যন্ত এত লম্বা সাপ আর কোথাও পাওয়া যায়নি। ৫ ফুট উঁচু ও ৪ ফুট প্রশস্ত রাফেলসিয়া আর্নল্ডি পৃথিবীর বৃহত্তম ফুল। কোমোডো দ্বীপ আকর্ষণীয় কোমোডো ড্রাগনের জন্য বিখ্যাত। এটা এক ধরনের সরীসৃপ, যা ৩ মিটার লম্বা। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর একমাত্র ড্রাগন হাউস।
ইন্দোনেশিয়া দ্যা রিং অব ফায়ার (The Ring of Fire) আগ্নেয়গিরি দলের একটি অংশ। রিং অব ফায়ার গ্রুপের ৭৫ ভাগ আগ্নেয়গিরি ইন্দোনেশিয়ায় অবস্থিত। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে তাম্বারো পর্বতে অগ্নুৎপাত হয়েছিল। এর প্রচ-তা বৈশ্বিক আবহাওয়াকে এতই প্রবাহিত করেছিল যে, এটাকে ‘year without summer’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল।
ধর্মপালনে ইন্দোনেশিয়া অত্যন্ত কঠোর। ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, প্রোটেস্টানিজম, ক্যাথলিক ও কনফুসিয়ানিজমÑ এ ছয়টি ধর্ম এখানে স্বীকৃত। একজন নাগরিককে পরিচয় দেওয়ার সময়, সে বিশ্বাস করুক বা না করুক যে কোনো একটি ধর্ম লিখতে হয়। তবে এর বাইরে কোনো ধর্মের নাম লেখা নিষিদ্ধ। এ ছয়টি ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের লোক ধর্মপরিবর্তন করা ছাড়া সে দেশে বিয়ে করা নিষিদ্ধ। ইন্দোনেশিয়ায় ৩০০ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী, ৫৮৩টি ভাষা এবং তাদের আরও অসংখ্য উপভাষা রয়েছে। দেশের আনুষ্ঠানিক ভাষা বাহাসা।
ইন্দোনেশিয়ায় পৃথিবীর ১২.৭% মুসলিম বাস করে। দেশটির ৮৭ভাগ নাগরিক নিজেদের মুসলিম হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। মোট জনসংখ্যার দিক থেকে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পর ইন্দোনেশিয়ার স্থান। ইন্দোনেশিয়ার অধিকাংশ লোক মুসলিম হলেও বালি দ্বীপে প্রচুর হিন্দু রয়েছে। এ দ্বীপের হিন্দুরা অনেকে প্রাচীন কুসংস্কারে আবদ্ধ। জন্মের ছয়মাস পর্যন্ত শিশুর পা মাটিতে পড়তে দেয় না। তাদের বিশ্বাস মাটিতে পড়লে শয়তান শিশুর দেহে প্রবেশ করবে এবং জন্ম-জন্মান্তর পর্যন্ত তা ঘটবে। এখানে বৌদ্ধ ধর্মের অনেক নিদর্শন রয়েছে। বরোবুদুর (Borobudur) মন্দির পৃথিবীর বৃহত্তম বৌদ্ধ মন্দির। এটি একসময় পৃথিবীর সপ্তাচর্যের একটি ছিল।
ব্রুনাই (Brunei) : ইতিহাস ও নামকরণ
চায়না (China) : ইতিহাস ও নামকরণ
কাম্বোডিয়া (Cambodia) : ইতিহাস ও নামকরণ
সাইপ্রাস (Cyprus) : ইতিহাস ও নামকরণ
জজিয়া (Georgia) : ইতিহাস ও নামকরণ
ইন্ডিয়া / ভারত (India) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।