ইরান(Iran): ইতিহাস ও নামকরণ

কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)

ড. মোহাম্মদ আমীন

ইরান(Iran)

ইরান শব্দের অর্থ ল্যান্ড অব দ্যা অ্যারাইনস (Land of the Aryans) বা আর্যদের ভূমি। পোর্টে ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষা  আর্য(Arya) শব্দের উৎস। সাধারণভাবে এর অর্থ মহান বা মুক্তি। শব্দটি গ্রিক অ্যারিস্টোক্র্যাট (aristocrat), বাংলায় অভিজাত এর সমগোত্রীয়। ইরানের প্রাচীন নাম ছিল পারসিয়া বা পারস্য। পারস্য অর্থ অর্থ পার্সেসা বা পারস্যদের ভূমি (Land of Perseus)। বিস্তীর্ণ পারস্য এলাকার মধ্যখানে অবস্থিত একটি বিখ্যাত স্থানের নাম ছিল পারস বা পারসা(চধধৎংধ)। এখানে পুরো দেশের বিজ্ঞ লোকদের আবাস ছিল। পরবর্তীকালে পারসা নামটি পরিবর্তিত হয়ে পারস্য রূপ ধারণ করে এবং তা পুরো দেশ বুঝাতে ব্যবহৃত হতে থাকে। কথিত হয়, পারস বা পারসা শব্দের অর্থ বিজ্ঞদের আবাস।

খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে বর্তমান ইরান ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য পারস্যের কেন্দ্র। প্রায় ২০০০ বছর ধরে এ অঞ্চলের অধিবাসীরা নিজেদের দেশকে ‘ইরান’ (ইরন্) নামে ডাকত। ইরান নামটি এই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী আর্য গোত্রের নাম থেকে নেওয়া। কিন্তু গ্রিকরা এ অঞ্চলকে পাস্র্ (বর্তমান ইরানের ফার্স প্রদেশ) বলত। এবং সেখান থেকে ইউরোপীয় ভাষায় এর নাম হয় পার্সিয়া বা পেসিয়া হয়। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের শাসক দেশটিকে কেবল ‘ইরান’ বলার অনুরোধ জানানোর পর থেকে এখন কেবল ইরান নামেই এটি সারা বিশ্বে পরিচিত। ১৫০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজতন্ত্রী ইরান শাহ কিংবা রাজারা শাসন করতেন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটান হয় এবং ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। বাইবেলের বিখ্যাত চরিত্র ইস্তার, ডানিয়েল, সাইরাস দ্যা গ্রেট, দারিউস প্রমূখের কবর ইরানে অবস্থিত। তাই এটি বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের কাছে একটি পবিত্র স্থান।

ইরান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। ইরান বিশ্বের সবচেয়ে পর্বতময় দেশগুলির একটি; এখানে হিমালয়ের পরেই এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দামভান্দ অবস্থিত। ইরানের জনগণ জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র হলেও প্রায় সবাই মুসলিম। এখানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মওজুদ রয়েছে।

ইরানের মোট আয়তন ১৬,৪৮,১৯৫ বর্গ কিলোমিটার বা ৬,৩৬,৩৭২ বর্গমাইল। জলীয়ভাগের পরিমান ০.৭%। আয়তন বিবেচনায় ইরান পৃথিবীর ১৮-তম বৃহত্তম দেশ। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী ইরানের জনসংখ্যা ৭,৮১,৯২,২০০ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটার জনসংখ্যা ৪৮। জনসংখ্যা বিবেচনায় ইরানের অবস্থান বিশ্বে ১৭-তম কিন্তু জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় ১৬২-তম। ইরানের ১৪.২ ভাগ লোক স্থূলাকার। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইরান পৃথিবীর ৪১-তম স্থূলাকার মানুষের দেশ। আমেরিকান সামোয়ার ৭৫% লোক স্থূল আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩.৯ ভাগ (৬ষ্ঠ) মেদবহুল(ড়নবংব)। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুযায়ী ইরানের জিডিপি (পিপিপি) ১.২৮৪ ট্রিলিয়ন (১৮-তম), সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ১৬,৪৬৩ (৭২তম) ইউসএস ডলার। জিডিপি নমিনাল ৪০২.৭০০ বিলিয়ন (২৯-তম) এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৫,১৬৫ ইউএস ডলার। ইরানের মুদ্রার নাম রিয়াল।

ইরান ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সম্পর্কিত অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্যের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। এর উত্তরে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কাস্পিয়ান সাগর ও তুর্কমেনিস্তান; পূর্বে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান; দক্ষিণে ওমান উপসাগর, হরমুজ প্রণালী ও পারস্য উপসাগর এবং পশ্চিমে ইরাক ও তুরষ্ক। তেহরান ইরানের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী; শহরটি ইরানের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত। তেহরান শব্দের অর্থ উষ্ণঢাল। ১২ মিলিয়ন লোক এ শহরে বাস করে। ইরানের রাজধানী তেহরান পৃথিবীর সবচেয়ে বায়ুদূষনের শিকার। প্রতিদিন এ শহরে প্রায় ২৭ জন লোক বায়ুদূষণজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করে।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে গৃহীত সংবিধান এবং ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের সংশোধনী ইরানের রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করেছে। সংবিধানে ইসলাম ধর্মের শিয়া মতটিকে ইরানের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। আলি খামেনেই বর্তমানে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। আর মাহমুদ আহমেদিনেজাদ দেশটির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। আরও আছে ২৯০ সদস্যবিশিষ্ট এককাক্ষিক আইনসভা।

ইরান ৩০টি প্রদেশে বিভক্ত। ফার্সি ভাষায় এগুলোকে ওস্তান বলা হয়। প্রদেশের প্রশাসক হিসাবে থাকেন একজন গভর্নর। ফার্সি ভাষায় তাকে ওস্তানদার বলা হয়। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইরান ১২টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। সেগুলো হচ্ছে- আর্দালান, আজারবাইজান, বালুচিস্তান, ফারস, জিলান, আরাক-ই-আজম, খোরাসান, খুজেস্তান, কেরমান, লারেস্তান, লোরেস্তান এবং মাজান্দারান। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ইরানকে ১০টি প্রদেশে এবং তার অধীনে অনেকগুলো গভর্নরেটে ভাগ করা হয়। ১৯৬০ হতে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অনেকগুলো গভর্নরেটকে প্রদেশে উন্নীত করা হয়। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে খোরাসান প্রদেশকে তিন ভাগে বিভক্ত করে তিনটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়।

ইরান মোটামুটি ত্রিভুজাকৃতির, যার দীর্ঘতম বাহু প্রায় ২,৫০০ কিমি দীর্ঘ এবং যা উত্তর-পশ্চিমে তুরষ্কের সঙ্গে সীমান্তে শুরু হয়ে দক্ষিণ-পূর্বে পাকিস্তান সীমান্তে শেষ হয়েছে। ত্রিভুজের তৃতীয় শীর্ষটি উত্তর পূর্বে ইরানের সঙ্গে তুর্কমেনিস্তানের সীমানার মাঝামাঝি অবস্থিত। উত্তর-দক্ষিণে ইরানের সর্বোচ্চ বিস্তার ১,৬০০ কিমি, আর পূর্ব-পশ্চিমে ১,৭০০ কিমি। সিআইএ ফ্যাক্টবুক অনুসারে ইরানের জাতিগুলি হচ্ছে : পারসিক জাতি ৫১%, আজেরি জাতি ২৪%, গিলাকি জাতি ও মাজান্দারানি জাতি ৮%, কুর্দি জাতি ৭%,আরব জাতি ৩%, লুর জাতি২%, বেলুচি জাতি ২%, তুর্কমেন জাতি ২% এবং অন্যান্য ১% ।

জাফরি শিয়া ইসলাম ১৬শ শতক থেকে ইরানের রাষ্ট্রধর্ম। ইরানের প্রায় ৯৩% মুসলিম শিয়া ধর্মাবলম্বী এবং এদের প্রায় সবাই জাফরি শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী। জাফরি শিয়ারা মনে করেন মুহাম্মদের ১২ জন উত্তরাধিকারী ইমাম আছেন। ইরানের বাকি জনগণ সুন্নী ধর্মাবলম্বী। সুফিবাদ বা ইসলামী আধ্যাত্ম্যবাদ ইরানীদের মধ্যে জনপ্রিয়। এছাড়াও ইরানে আর্মেনীয় ও আসিরীয় খ্রিস্টান, ইহুদি ও জরথুস্ট্রবাদীদের ছোট ছোট সম্প্রদায় আছে। ১৯শ শতকে বাহাইবাদের আবির্ভাব ঘটে এবং এর বহু হাজার অনুসারী আছে।

পারস্য উপসাগরে বিশ্বের ৬০% তেল মওজুদ আছে। ইরান একারই মওজুদ আছে ১২৫ বিলিয়ন ব্যারেল তেল। যা বিশ্বের মোট তেল সম্পদের ১০ ভাগ। ইরান প্রতিদিন ৪ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করে। ইরানের প্রায় বাড়িতে কোনে চেয়ার টেবিল নেই। তারা মেঝে ছাটাই বিছিয়ে খাওয়া-দাওয়া গ্রহণ করে।

ইরানে কোনো মেয়ে যৌন হয়রানির শিকার হলে অপরাধীর চেয়ে মেয়ের মাকে বেশি দায়ী করা হয়, কেন সে তার মেয়েকে রক্ষা করতে সক্ষম হল না। এখানে কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে পুলিশ ওই মেয়ে সম্মতি না দিলেও ধর্ষনকারীর সঙ্গে জোরপূর্বক বিয়ে দিতে পারে। যদিও বিয়ের অব্যবহিত পর ওই পুরুষ নারীটাকে তালাক দিয়ে দিতে পারে। ইরানে বিবাহিত মেয়ে সতিচ্ছেদ ছিন্ন হওয়া অবিবাহিত মেয়ের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য। ইরানে স্ত্রী তার স্বামীর সম্পত্তি। তাই কোনো স্ত্রী স্বামীর দ্বারা অত্যাচারিত হলে পুলিশের কিছু করার থাকে না। পরিবার থেকে স্বামীকে সতর্ক করে দেওয়া যায়, এর বেশি না। ইরানে নয় বছরের অধিক বয়সী সকল মেয়েকে প্রকাশ্য স্থানে বের হলে হিজাব পরতে হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানে শিশুপতিতাবৃত্তি ৬৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু তেহরানে ৮৪ হাজার বালিকা ও নারী পতিতাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। এদের অনেকে ফ্রান্স, জার্মান ও যুক্তরাজ্য হতে পাচার হয়ে এসেছে। ইরানের বিভিন্ন শিয়া গোত্রে মুতাহ বিয়ে এখনও প্রচলিত। এ বিয়ের মেয়াদ চুক্তিমতে একঘণ্টা হতে একবছর পর্যন্ত হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র কনডম ফ্যাক্টরি ইরানে অবস্থিত। ইরানে বিয়ে করার জন্য দম্পতিদের লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। গর্ভনিরোধ বিষয়ে একঘণ্টা ধরে বক্তৃতা নেওয়ার পর লাইসেন্স প্রদান করা হয়। ইরানে যে লোক বিয়ে করে না এবং আজীবন জন্ম পরিবারের সঙ্গে থাকে, তাকে মানুষ বলে গণ্য করা হয় না। ইরানে প্রথম বিয়ের অনুমতি নেওয়ার পূর্বে মহিলাদের প্রায়শ ডাক্তারের নিকট থেকে সতীত্ব সনদ নিতে হয়, সনদ নিতে হয় যৌনাঙ্গ অক্ষত আছে। এজন্য ইরানে মিনস হওয়ার পরপরই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ইরানের আইন ইসলামি আইন। এ আইন অনুসারে নারী পুরুষের সমান নয়, অর্ধেক।

ইরানে প্রায় এক মিলিয়নের মতো শরণার্থী রয়েছে। এরা মূলত আফগান বা ইরাকি কুর্দ। এছাড়া ইরানে সস্তায় শ্রম ক্রয়ের জন্য পৃথিবীর নানা দেশ থেকে শ্রমিক নিয়ে থাকে। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের পুলিশ প্রধান বলেছিলেন, গুগুল গোয়েন্দার কাজ করে। তিনি জাতীয় ইন্টারনেট নাম দিয়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত একটি ইন্টারনেট ব্যবস্থা খোলারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইরানে কেবল একটি ছোট নদী রয়েছে। এটাতে নৌকা চলাচল করে। ক্যাভিয়ার, পেস্তাবাদাম ও জাফরান উৎপাদনে ইরান পৃথিবীর সেরা।

ব্রুনাই (Brunei) : ইতিহাস ও নামকরণ

চায়না (China) : ইতিহাস ও নামকরণ

কাম্বোডিয়া (Cambodia) : ইতিহাস ও নামকরণ

সাইপ্রাস (Cyprus) : ইতিহাস ও নামকরণ

জজিয়া (Georgia) : ইতিহাস ও নামকরণ

ইন্ডিয়া / ভারত (India) : ইতিহাস ও নামকরণ

ইন্দোনেশিয়া (Indonesia): ইতিহাস ও নামকরণ

সূত্র:  কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।

Language
error: Content is protected !!