কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)
ড. মোহাম্মদ আমীন
ইয়ামেন (Yement)
ইয়েমেন আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র। সুউচ্চ পর্বতমালা ইয়েমেনের উপকূলীয় সমভূমিকে অভ্যন্তরের জনবিরল মরুভূমি হতে পৃথক করেছে। দেশের অর্ধেকের বেশি অংশ বসবাসের অযোগ্য। প্রাচীনকালে এখানে অনেকগুলি সমৃদ্ধ সভ্যতা গড়ে ওঠেছিল। তবে নানা কারণে ধীরে ধীরে এলাকাটির গুরুত্ব হ্রাস পায়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র (উত্তর ইয়েমেন) এবং গণপ্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন (দক্ষিণ ইয়েমেন) একত্রিত হয়ে ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র গঠন করে। সানা ইয়েমেন প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। ইয়েমেনের পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং দক্ষিণে এডেন উপসাগর। এটি আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বাব এল মান্দেব প্রণালীর দ্বারা বিচ্ছিন্ন। দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বে সৌদি আরব এবং পূর্বে ওমান অবস্থিত। সৌদি আরব ও ওমানই ইয়েমেনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
ইয়ামিন (yamin) শব্দ হতে ইয়ামেন (Yemen) শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ ডান পাশে (on the right side)। যখন সূর্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো হয় তখন দক্ষিণ ডান দিকে থাকে। অন্য একটি প্রচলিত মতবাদ এ যে, ইয়াম্ন (yumn) শব্দ হতে ইয়ামেন নামের উৎপত্তি। এর অর্থ সুখ বা আশীর্বাদ। রোমানগণ আরব মরভূমির বিপরীতে অবস্থিত আলোচ্য এলাকটিকে অ্যারাবিয়া ফেলিক্স (Arabia Felix) নামে অভিহিত করেছিলেন। এর অর্থ সুখি বা সমৃদ্ধ আরব। এ নাম দিয়ে রোমানগণ উত্তর আরবকে বুঝাতেন। প্রাচীন দক্ষিণ অ্যারাবিয়ান হস্তলিপিতে ইয়ামাট (Yamnat) শব্দে ইয়ামেন নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন ইয়ামেনের চারটি বিখ্যাত শাসক বংশের একীকরণ হিসাবে ইয়ামেন নাম রাখা হয়। এর অর্থ দক্ষিণের ভূমি (the south-land)
খ্রিষ্টপূর্ব ২,০০০ অব্দের দিকে উত্তর ইয়েমেনে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে। সমুদ্রপথে একটি ব্রিটিশ জাহাজের ধ্বংসাবশেষ চুরি হয়ে যাওয়ার অজুহাতে ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটেন এডেন দখল করে নেয়। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ রাজশাসনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এডেন ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসাবে শাসিত হয়ে আসছিল। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর দক্ষিণ ইয়েমেন স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মে ইয়েমের বর্তমান পতাকা গ্রহণ করা হয়। ওইদিনই দুই ইয়েমেন একীভূত হয়েছিল।
লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পেরিম দ্বীপ এবং এডেন উপসাগরে অবস্থিত সোকোত্রা দ্বীপসহ ইয়েমেনের মোট আয়তন ৫,২৮,০৭৬ বর্গকিলোমিটার বা ২০৩,৭৯৬ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় অংশ খুবই নগন্য। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে মোট জনসংখ্যা ২,৫৪,০৮,০০০ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ৪৪.৭। আয়তন বিবেচনায় ইয়েমেন পৃথিবীর ৫০-তম বৃহত্তম দেশ। তবে জনসংখ্যা বিবেচনায় ৪৮-তম বৃহত্তম দেশ। অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় ইয়ামেন ১৬০-তম জনবহুল দেশ। দেশটির স্থলসীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য ১,৭৪৬ কিলোমিটার।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, ইয়েমেনের জিডিপি (পিপিপি) ৫৮.২০২ বিলিয়ন ইউএস ডলার, সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ২,২৪৯ ইউএস ডলার। অন্যদিকে জিডিপি (নমিনাল) ৩৬.৭০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ১,৪১৮ ইউএস ডলার। মুদ্রার নাম ইয়েমেনি রিয়েল। সরকারি ইয়েমেনের নাগরিকগণ ইয়েমেন নামে পরিচিত।
লোহিত সাগরের উপকূল ঘেঁষে প্রলম্বিত প্রায় ৪১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ অর্ধ-ঊষর উপকূলীয় সমভূমিটি তিহামাহ নামে পরিচিত। অভ্যন্তরভাগে অনেকগুলো পর্বত রয়েছে। সর্বোচ্চ পর্বত জাবাল আন নাবি শুয়াইব সমুদ্রতল থেকে ৩,৬৬৬ মিটার। উচ্চভূমিগুলির ভেতর দিয়ে বেশ কিছু ওয়াদি বা নদী উপত্যকা চলে গেছে। এগুলো গ্রীষ্মকালে শুষ্ক থাকে। ইয়েমেনের কোনো স্থায়ী নদী নেই।
সানা শহরটি সম্ভবত মনুষ্যনির্মিত প্রথম শহরগুলির অন্যতম। ইউনেস্কো শহরটিকে মানব জাতির ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে। রাব আল খালি মরুভূমির প্রান্তে অবস্থিত মারিব শহর ছিল শেবার রাণীর সাম্রাজ্যের রাজধানী। এখানে ৩০০০ বছর আগে নির্মিত বাঁধ এখনও দেখতে পাওয়া যায়।
সোমালিয়ার অতি সন্নিকটস্থ উপকূলে অবস্থিত সোকাত্রা দ্বীপ ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণে। ধর্মীয় কারণে ইয়েমেনে সর্বপ্রকার এলকোহল কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। মোচা (Mocha) নামের বিশ্বখ্যাত ও উৎকৃষ্ট কফি ইয়েমেনে উৎপাদিত হয়। ইয়েমেনের কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে। তাই এটি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র। তবে ইয়েমেন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এ দেশটি ওমান বন্দরের মাধ্যমে বাকি দেশের সকল তেলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। ইয়েমেন অত্যন্ত গোড়া একটি মুসলিম দেশ। এখানে সমকামিতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং মেয়েদের ছবি তোলা নিষিদ্ধ।
ইয়েমেন গরিব হলেও অনেক বিষয়ে তারা আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে গৌরবজনক রাষ্ট্র। প্রথম কারণ হচ্ছে গণতন্ত্র। মধ্যপ্রাচ্যে এ দেশটার জনগণই কেবল পূর্ণগণতন্ত্র উপভোগ করতে পারে। বাকিগুলোতে রাজতন্ত্র এবং আরব আমির একপরিবারের শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত। আর একটি কারণেও তারা গর্ব করতে পারেন এবং সেটি হচ্ছে বিবাহ অনুষ্ঠান। তাদের বিবাহ অনুষ্ঠান গড়ে ২১ দিন যাবত চলে। ইয়েমেন বাইবেলে বর্ণিত একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান। নুহ নবী এটাকে দুগ্ধ ও মধুর দেশ (the land of milk and honey) হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। এখানেই তিন জ্ঞানী শিশু যিশুকে পর্বত থেকে সংগৃহীত গন্ধরস ও ধুপধুনো উপহার দিয়েছিলেন।
ইউনাইটেড আরব আমিরাত (United Arab Emirates) : ইতিহাস ও নামকরণ
উজবেকিস্তান (Uzbekistan) : ইতিহাস ও নামকরণ
ভিয়েতনাম (Vietnam) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।