ভাষা শহিদদের স্মৃতিচারণ
ড. মোহাম্মদ আমীন
বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনে কয়জন শহিদ হয়েছিলেন এরে যথার্থ হিসাব পাওয়া যায় না।ছাত্রবিক্ষোভের পর পুলিশের গুলিতে নিহত অনেকের লাশ রাতেই পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর লোকজন মর্গ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গুম করে ফেলে। তবে বিভিন্ন তথ্যসূত্র হতে প্রাপ্ত ভাষাশহিদদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকা এবং ওই তালিকায় রক্ষিত শহিদদের সংক্ষিপ্ত জীবনী নিচে দেওয়া হলো :
রফিকউদ্দিন আহমেদ [১৯২৬-১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ]
আবুল বরকত [১৯২৭-১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ]
শফিউর রহমান [১৯১৮-১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ]
আব্দুল জব্বার [১৯২২-১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ]
আব্দুস সালাম [১৯২৫-১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ]
অহিউল্লাহ [১৯৪৪-১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ]
রফিকউদ্দিন আহমেদ
রফিকউদ্দিন আহমদ ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার পারিল বলধারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম রফিক। তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনে নিহত প্রথম শহিদ। রফিক উদ্দিনের পিতার নাম আবদুল লতিফ ও মাতার নাম রাফিজা খাতুন। তাঁর পিতা আবদুল লতিফ কলকাতায় ব্যবসা করতেন। রফিকরা পাঁচ ভাই ও দুই বোন। রফিকের ভাই আবদুস সালাম বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। কলকাতা নিবাসকালীন রফিক সময়মিত্র ইনিস্টিটিউশনে শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের পর রফিকউদ্দিনের পিতা ঢাকায় এসে বাবুবাজারে আকমল খাঁ রোডে পারিল প্রিন্টিং প্রেস নামে একটি ছাপাখানা চালু করেন। রফিক, বায়রা স্কুল থেকে ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বায়রা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে মানিকগঞ্জ ‘দেবেন্দ্র কলেজে’ বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। আইকম ক্লাস পর্যন্ত পড়লেও পরে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় এসে তিনি পিতার সঙ্গে প্রেস পরিচালনা শুরু করেন। পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র ছিলেন। রাত তিনটায় সামরিক বাহিনীর প্রহরায় ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে শহিদ রফিকের লাশ দাফন করা হয়। ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখার জন্য ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে একুশে পদক প্রদান করা হয়।
আবুল বরকত
আবুল বরকত (আবাই) পশ্চিবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জুন জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম শামসুদ্দিন, মাতার নাম হাসিনা বেগম। বরকত সেখানকার় তালিবপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে মেট্রিক এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আইএ পাস করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ হয়ে বিএ অনার্স পাস করেন। অতঃপর স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুযারি পুলিশ যখন গুলি চালায় তখন তিনি তৎকালীন মেডিকেল কলেজ হস্টেলের ১২ নং শেডের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজিমপুর গোরস্তানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। মহান ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগের জন্য ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে শহিদ বরকতকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
শফিউর রহমান
শফিউর রহমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার কোন্নগরে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাহবুবুর রহমান ছিলেন ঢাকার পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট। কলকাতা গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজ হতে আইকম পাস করে শফিউর রহমান চব্বিশ পরগণা সিভিল সাপ্লাই অফিসে কেরানির চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতার তমিজউদ্দিনের কন্যা আকিলা খাতুনের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। দেশ বিভাগের পর পিতার সঙ্গে ঢাকায় এসে ঢাকা হাইকোর্টে হিসাব রক্ষণ শাখায় যোগ দেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে ফেব্রুয়ারি নওয়াবপুর রোডের মিছিলে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। মারা যাওয়ার পর পুলিশ আত্মীয়দের কাছে লাশ হস্তান্তর করেনি। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি তথ্য বিবরণ হতে জানা যায়, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট শহিদ শফিউর রহমানের জানাজা পড়ান। জানাজায় তাঁর বাবা ও ভাই উপস্থিত ছিলেন। তাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁর কবরের পাশে রয়েছে পূর্বদিনের শহিদ আবুল বরকতের কবর। আজিমপুর শহিদ সফিউর রহমানের কবরে লেখা আছে : ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে শহিদ সফিউর রহমান, ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে শফিউর রহমানকে একুশে পদক প্রদান করা হয়।২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ভাষা আন্দোলনে শহিদ অন্যান্য পরিবারের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী বেগম আকিলা খাতুনকে আজীবন ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
আব্দুল জব্বার
ভাষার আন্দোলনের অন্যতম শহিদ আব্দুল জব্বার ১৩২৬ বাঙ্গাব্দের ২৬ আশ্বিন তারিখে (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ ) ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার পাঁচাইর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় ধোপাঘাট কৃষিবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুকাল অধ্যয়নের পরে দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া ত্যাগ করে পিতাকে কৃষিকাজে সাহায্য শুরু করেন। পনের বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করেন। নারায়ণগঞ্জে জাহাজ ঘাটে এক ইংরেজ সাহেবের অধীনে চাকরি নিয়ে বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) চলে যান। সেখানে দশ-বারো বছর অবস্থান করেন। আবদুল জব্বারের পিতার নাম হাসান আলী এবং মায়ের নাম সাফাতুন নেছা। বার্মা থেকে দেশে ফিরে আমেনা খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। আমেনা-জব্বার দম্পতির নুরুল ইসলাম বাদল নামের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। জব্বারের মৃত্যুর পর আমেনা খাতুনকে বিয়ে করেন তার সহোদর আবদুল কাদের। আমেনা-কাদের দম্পতির রফিকুল্লাহ্, আতিকুল্লাহ্ ও রাশেদা খাতুন নামে তিন সন্তান রয়েছে। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ই সেপ্টেম্বর হৃদরোগজনিত কারণে বিনা চিকিৎসায় মারা যান আমেনা খাতুন। ভাষা আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা রাখায় আবদুল জব্বারকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
আব্দুস সালাম
আবদুস সালাম ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২১ শে ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে ৭ ই এপ্রিল মারা যান।তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ফাজিল মিয়া। আবদুস সালাম কর্মজীবনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের ‘পিয়ন’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ঢাকার নীলক্ষেত ব্যারাকের ৩৬বি নম্বর কোয়ার্টারে বাস করতেন। মহান ভাষা আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা রাখায় তাঁকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদক প্রদান করা হয়। ফেনী স্টেডিয়ামের নাম পরিবর্তন করে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ‘ভাষা শহীদ সালাম স্টেডিয়াম’ করা হয়। দাগনভুঞা উপজেলা মিলনায়তনকে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘ভাষা শহীদ সালাম মিলনায়তন’ করা হয়।তাঁর নিজ গ্রাম লক্ষ্মণপুরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘সালাম নগর’।
অহিউল্লাহ
ভাষাশহীদদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শহিদের নাম অহিউল্লাহ। পিতা হাবিবুর রহমান ছিলেন পেশায় রাজমিস্ত্রি। ২২ শে ফেব্রুয়ারি নওয়াবপুর রোডের মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে মারা যান। তার লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
খাঁটি গোরুর দুধ শুদ্ধ না কি অশুদ্ধ
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন
আপদ্ বনাম বিপদ : বিপৎকাল না কি বিপদকাল
চোখ : কাব্যিক ভাবনা ব্যাকরণিক অভিধা
পুষ্পিতা বাংলা একাডেমি : রজস্বলা না কি রজঃস্বলা
বাংলা বানান : শুদ্ধ অশুদ্ধ : শব্দগুলো জব্দ করুন ভালোভাবে পড়ে
বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবিলিকেশন্স লি.।