ছয়দিদির সপ্তচর্চা ৭৫
অজয় শর্মা ছয় বোনের এক ভাই। সে-সহ পরিবারে ভাইবোনের মোট সংখ্যা সাত। অজয় ভাষার সুন্দর সুন্দর শব্দ শিখতে খুবই উৎসাহী। সে রোজ দিদিদের কাছে যায় এবং নিত্যনতুন শব্দ শেখে। আজ তার মাথায় একটি ধারণা খেলে গেল— ‘যেহেতু আমরা মোট সাত ভাইবোন, সেহেতু আজ প্রত্যেক দিদির কাছে একটি করে সাতসংক্রান্ত শব্দ শিখব।’ যেমনটি ভাবনা, তেমনটি কাজ— এতক্ষণ ধরে সামনে খুলে রাখা মেঘমল্লার বইটি বন্ধ করে সোজা দিদিদের কামরায় চলে গেল। ছয় দিদিই জ্যেষ্ঠতার ক্রমে সবার বড়ো জনের কামরায় বসে আছেন। তাঁর কামরায় ঢুকেই অজয় বলল, “বড়ো দিদি, আমাকে ‘সাত’ সংখ্যাটি যুক্ত আছে, এমন কিছু শব্দ শেখাও-না,” কোনো কথা না-বাড়িয়েই বড়দি বলতে শুরু করলেন—
“ ‘সাত’-এর আরেকটি সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘সপ্ত’। আর, ‘সপ্ত’-যুক্ত একটি সুন্দর শব্দ হচ্ছে ‘সপ্তরক্ত’। আমাদের শরীরে এমন সাতটি অংশ রয়েছে, যেগুলো বাইরে থেকে সহজেই দেখা যায় এবং দেখতে অনেকটা রক্তবর্ণের মতো। করতল (হাতের তালু), পদতল (পায়ের তালু), অপাঙ্গ (চোখের কোনার লাল অংশ), জিহ্বা, তালু (মুখগহ্বরের ঊর্ধ্বভাগ), ওষ্ঠ (ঠোঁট) আর নখ হচ্ছে এই সাতটি অঙ্গ। এগুলোর প্রতিটিই দেখতে অনেকটা রক্তবর্ণের কিংবা ঈষৎ রক্তবর্ণের বলে এগুলোকে একত্রে ‘সপ্তরক্ত’ বলা হয়।”
বড়দি অত্যন্ত সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন। বড়দির পাশেই জ্যেষ্ঠতার ক্রমে দ্বিতীয় জন বসে আছেন। বয়সের ক্রমে দ্বিতীয় জনকে ‘মেজো’ বলা হয়। অজয় এবার মেজো দিদিকে ‘সাত’ সম্পর্কে বলতে না-বলে সিধা ‘সপ্ত’-যুক্ত কোনো শব্দের ব্যাপারে বলতে বলল। মেজদি মানেই পৌরাণিক কাহিনি। তাই, ‘সপ্ত’ শব্দটি শুনতেই তাঁর মাথায় পৌরাণিক সপ্তপাতালের কথা চলে এল (এলো)— “ ‘সপ্তপাতাল’ হচ্ছে পুরাণে কল্পিত সাতটি পাতাল বা অধোভুবন। প্রথম পাতালকে ‘তল’ বলা হয়, তার পরের পাতাল হচ্ছে ‘অতল’। তল হারালে মানুষ অতলে হারিয়ে যায়। অতলের পরে আসে ‘বিতল’, এবং বিতলের পরে রয়েছে ‘সুতল’। পঞ্চম পাতাল হচ্ছে ‘তলাতল’। তলাতলের পর রয়েছে ‘মহাতল’। সব তলের শেষে ‘রসাতল’ অবস্থিত। এজন্যেই, মানুষ যখন তার ব্যক্তিত্ব হারিয়ে দারুণভাবে অধঃপতিত হয়, তখন লোকমুখে ‘লোকটা একেবারেই রসাতলে গিয়েছে’ বলতে শোনা যায়।”
মেজদির বলা শেষ হতেই সকলে তৃতীয় জনের দিকে ফিরে তাকাল। বয়সের ক্রমে জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে তৃতীয় জনকে ‘সেজো’ বলা হয়। ‘মেজদি তো পাতাল নিয়ে বলল, এবার আমি না-হয় ঊর্ধ্বতল নিয়ে বলি’ বলে শব্দের খেলায় সেজো দিদিও যোগ দিলেন— “সপ্তপাতালের মতো আরেকটি শব্দ হচ্ছে ‘সপ্তলোক’। এই সপ্তলোক হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনিতে বর্ণিত সাতটি ঊর্ধ্বলোক বা স্বর্গ। প্রথম ঊর্ধ্বলোক হচ্ছে ‘ভূঃ’। এই ভূঃ (ভূ) হচ্ছে পৃথিবী। অনেকের কাছে এই পৃথিবীটাই স্বর্গ, তাই পৃথিবীও সপ্তলোকের একটি। দ্বিতীয় সপ্তলোক হচ্ছে ‘ভুবঃ’। এই ভুবঃ হচ্ছে আকাশ। তারপরে রয়েছে যথাক্রমে ‘স্বঃ’, ‘জনঃ’, ‘মহঃ’ আর ‘তপঃ’। একেবারের সবকটির ঊর্ধ্বে রয়েছে ‘সত্য’। তাই তো বলা হয়— সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।”
কবির পঙ্ক্তি আওড়ে সেজদির বলা শেষ হলো। এবার ন-দিদির পালা। জ্যেষ্ঠতার ক্রমে চতুর্থ বলে তাঁকে ‘ন-দি’ ডাকা হয়; ভাষার রীতি মেনে এভাবেই ডাকতে হয়। ন-দি বলতে শুরু করলেন— “আমার পছন্দের শব্দ হচ্ছে ‘সপ্তর্ষি’। মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু আর বশিষ্ঠ— এই সাতজন ঋষির নামে খ্যাত নক্ষত্রসমূহকে সপ্তর্ষি বলা হয়। এই নক্ষত্রগুলো উত্তর-আকাশে দেখতে মেলে।”
মাত্র তিন বাক্যে নিজের কথা শেষ করতেই ফুলদিদির পালা চলে এল। জ্যেষ্ঠতার ক্রমে তিনি পঞ্চম বলে তাঁকে ‘ফুলদিদি’ ডাকা হয়, এটিই নিয়ম। ফুলদি মহাভারতের দারুণ ভক্ত। তাই, তাঁর শব্দটির সঙ্গে মহাভারত জুড়ে রইল। তিনি বলা শুরু করলেন— “ ‘সপ্তরথী’ হচ্ছে মহাভারতে উল্লেখ-করা সাতজন বীর, যারা বালক অভিমন্যুকে বধ করেছিল। দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, শকুনি, দুর্যোধন আর দুঃশাসন হচ্ছে সেই সপ্তরথী,”
ফুলদি অত্যন্ত ঢঙের সঙ্গে তাঁর বর্ণনার ইতি টানলেন। এবার একেবারে সবার ছোটোর পালা। দিদিদের মধ্যে বয়সে সবার ছোটো বলে অজয় তাকে ছোটো দিদি বলে ডাকে। ছোটো দিদি কেবল গানটাই বোঝেন। তাই, তাঁর জবাবেও গানের বিষয় চলে এল (এলো)। তিনি বললেন, “ ‘সপ্ত’-যুক্ত সবচে সুন্দর শব্দ হচ্ছে ‘সপ্তসুর’। সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি— সংগীতের এই সাতটি সুরই হচ্ছে সপ্তসুর।”
“আগামী সপ্তাহে এরকম আরেকটি শব্দ নিয়ে খেলতে হবে কিন্তু!” সবশেষে অজয় দিদিদের কাছে আবদার রেখে মায়ের কাছে পাঠের জাবর কাটতে গেল। (১০ই জুলাই ২০২০)
ক্রমশ
ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব ৭৩