অত্যন্ত কৃপণের ধন থেকে যক্ষের ধন ৭১
‘মাল’ পেয়ে রাতারাতি বড়োলোক বনে যাওয়ার ঘটনা গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই শোনা যায়। এই মাল হচ্ছে শত শত বছর ধরে মাটির নিচে পড়ে থাকা মূল্যবান স্বর্ণ-রৌপ্যাদি। বহুকাল আগে কৃপণ ধনীর পুঁতে রাখা ধন মালে পরিণত হয়। এই মাল সৃষ্টির ঘটনা থেকেই অতিপরিচিত ‘যক্ষের ধন’ প্রবাদটির উৎপত্তি। যক্ষরা হচ্ছে এক প্রকার উপদেবতা। চেহারা ও বর্ণে এরা অত্যন্ত কুৎসিত ছিল। তাদের বিশ্রী অবয়ব নিয়ে একটি মজার লোকশ্রুতি প্রচলিত আছে। বলা হয়, ব্রহ্মা যখন যক্ষ ও রাক্ষসদের বানাচ্ছিলেন, তখন তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলেন। পেটের মধ্যে খাবারের ভয়ানক পীড়া সহ্য করে অন্ধকারে অত্যন্ত তাড়াহুড়োর মধ্যে তাদের বানানোর কাজ শেষ করেছিলেন বলে তাদের গায়ের রং কুচকুচে কালো এবং চেহারার গঠন যাচ্ছেতাই রকমের হয়ে গিয়েছিল। দেখতে অসুন্দর হলেও যক্ষদের কোনো নেতিবাচক গুণের কথা শোনা যায় না, বরং তারা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ধনাধিপতি কুবেরের ধন পাহারা দিত বলে কথিত আছে। যক্ষদের সততার এই গুণটির আসর প্রাচীন কৃপণ ধনীদের দারুণভাবে গ্রাস করে। প্রাচীনকালে এমন কিছু ধনী ব্যক্তি ছিল (এখনো আছে), যারা কৃপণতার চরম পর্যায়ের গিয়ে পৌঁছাত। নিজেদের অর্জিত ধনসম্পদের একটি আধুলি খরচ হওয়ার শঙ্কাও তাদের অতিষ্ঠ করে তুলত। এই শঙ্কা থেকে পরিত্রাণের জন্যে তারা পুরোহিতদের শরণাপন্ন হলে পুরোহিতেরা এক ভয়ংকর পথ বাতলে দেয়। পুরোহিতদের পরামর্শ মতো কৃপণ ধনীরা একটি ঘর (কক্ষ) তৈরি করে নিজেদের সোনা-জহরতগুলো কলস বা বড়ো ডেকচিতে ভরে কোনো এক উত্তরসূরির নাম লিখে দিয়ে নিজের এক সন্তান-সহ (অধিকাংশের মতে ছেলেকে রাখা হতো) সেই ঘরে রেখে পুজোকর্ম সম্পন্ন করে বাইরে থেকে সেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত। তারা বিশ্বাস করত, ভেতরে রেখে আসা সন্তান মরে গেলে তার আত্মা যক্ষে পরিণত হবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে ধন পাহারা দেবে। নির্দিষ্ট উত্তরসূরির হাতে সেই ধন তুলে দিলেই তার আত্মার মুক্তি মিলবে; নির্দিষ্ট উত্তরসূরি ব্যতীত অন্য কেউ সেই ধন হাতাতে চাইলে মৃতের আত্মা তার অনিষ্টসাধন করে সেগুলো রক্ষা করবে। ফলে দারুণ অসময়েও ওই পুঁতে রাখা ধন থেকে একটি আধুলি খরচ করারও অবকাশ থাকত না। আর, একারণে অত্যন্ত কৃপণ ব্যক্তির ধন— যেগুলো নিজেদের চরম দুর্দিনেও উপকারে আসে না— বোঝাতে ‘যক্ষের ধন’ শব্দের (সমাসবদ্ধ) প্রচলন শুরু হয়ে যায়। (২৯শে জুন, ২০২০)
ক্রমশ
তিথি