অধিকন্তু অর্থে ও: শব্দের শেষে ‘ও’ পূর্ণ রূপে এবং কার-চিহ্ন রূপে লেখার নিয়ম ৫৮
“অধিকন্তু অর্থে ব্যবহৃত ‘ও’ প্রত্যয় শব্দের সঙ্গে কার-চিহ্ন রূপে যুক্ত না হয়ে পূর্ণ রূপে শব্দের পরে যুক্ত হবে।”— প্রমিত বাংলা বানানের ৩.৪ নম্বর নিয়মটি পড়ার পর কিছু প্রশ্ন জাগতেই পারে:
১. এখনও লিখব, না কি এখনো?
২. কখনও লিখতে হবে, না কি কখনো?
৩. আরও লেখা উচিত, না কি আরো?
৪. কোনও সংগত রূপ, না কি কোনো?
৫. আমারও প্রমিত, না কি আমারো?
৬. হাজারও লেখা সমীচীন, না কি হাজারো?
৭. তোমায়ও লিখতে হবে, না কি তোমায়ো?
প্রকৃত পক্ষে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরূপ শব্দসমূহের উভয় বানানই প্রমিত, তবে তা অনেকটা প্রায়োগিক ক্ষেত্রের ওপর নির্ভরশীল। এই ব্যাবহারিক ভিন্নতা বুঝতে হলে এরূপ শব্দগুলো অধিকন্তু অর্থে কখন ব্যবহৃত হয়, সে-সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, অভিধানে ‘অধিকন্তু’ শব্দটির ভুক্তিতে যে অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে ‘ও’ প্রত্যয় কখন অধিকন্তু অর্থে যুক্ত হয়, তা আমার মতো সাধারণ বাংলাভাষীর পক্ষে বোঝা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। তাই, কোনো শব্দের সঙ্গে কখন অধিকন্তু অর্থে ‘ও’ প্রত্যয় যুক্ত হয়, তা অনুধাবনের জন্যে আমি ভিন্ন উপায় নিরূপণের চেষ্টা করেছি, এবং এই লেখার পরবর্তী অংশ পাঠের পর তা আপনিও পারবেন বলে আমার পূর্ণ বিশ্বাস।
শুরুতেই উল্লেখ করে দেওয়া উচিত— কোনো বিশেষ্য আর ব্যক্তিবাচক সর্বনামের সঙ্গে ‘ও’ প্রত্যয় সবসময় অধিকন্তু অর্থে যুক্ত হয়। তাই, এসব শব্দের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘ও’ প্রত্যয় সবসময় পূর্ণ রূপে শব্দের শেষে বসবে। যেমন: আমারও, তাহারও, হাজারও, ছাফিয়াও, বইও, তলস্তয়ও, মানুষও প্রভৃতি।
এগুলো ছাড়া অন্যান্য শব্দের শেষে— বিশেষ করে কখন, এখন, আর, কোন, আজ প্রভৃতি— কখন ’ও’ প্রত্যয় পূর্ণ রূপে যুক্ত হবে এবং কখন কার-চিহ্ন রূপে যুক্ত হবে, তা বুঝবার জন্যে দুটি ধাপ অনুসরণ করতে হবে—
ধাপ-০১: বাক্যের মধ্যে কোনো শব্দের শেষে ‘ও’ প্রত্যয় পূর্ণ রূপে যুক্ত করার প্রথম শর্ত হচ্ছে— নির্দিষ্ট শব্দটির আর ‘ও’ প্রত্যয়ের মধ্যখানে কোনো প্রাসঙ্গিক বিভক্তি যুক্ত করা যায় কি না, তা দেখা। যদি কোনো প্রাসঙ্গিক বিভক্তি যুক্ত করা যায় এবং বিভক্তি যুক্ত করার পরও বাক্যের মূল অর্থ অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে ওই শব্দের বানানে ‘ও’ প্রত্যয় নির্দ্বিধায় পূর্ণ রূপে লেখা যাবে। দু-একটি উদাহরণ দিচ্ছি—
ক. ‘আমি আজও যেতে পারব না। > আমি আজকেও যেতে পারব না।’— যেহেতু এখানে ‘আজও’ রূপটির ‘আজ’ আর ‘ও’-এর মধ্যখানে ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করার পরও অর্থের কোনো হেরফের হয়নি, সেহেতু প্রথম বাক্যটিতে নির্দ্বিধায় ‘আজও’ রূপটি লেখা যাবে।
খ. ‘সে গতকালও পড়া শেখেনি। > সে গতকালকেও পড়া শেখেনি।’— যেহেতু এখানে ‘গতকালও’ রূপটির ‘গতকাল’ আর ‘ও’-এর মধ্যখানে ‘-কে’ বিভক্তি যুক্ত করার পরও অর্থের কোনো হেরফের হয়নি, সেহেতু মূল বাক্যটিতে নির্দ্বিধায় ‘গতকালও’ রূপটি লেখা যাবে।
ধাপ-০২: যেসকল শব্দের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপের মতো বিভক্তি যুক্ত করা যায় না, সেসকল শব্দের ক্ষেত্রে ‘ও’ প্রত্যয় যুক্ত করার মজাই আলাদা। সেক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে— এরকম শব্দসমূহের ক্ষেত্রে ‘অধিকন্তু’ শব্দের ‘-ন্তু’ বাদ দিয়ে কেবল ‘অধিক’ অংশটুকু মাথায় রাখতে হবে। ‘অধিক’ মানে ‘বেশি’, ‘অতিরিক্ত’ প্রভৃতি। অর্থাৎ, বাক্যের মধ্যে প্রয়োগে যেসকল শব্দের শেষে একটি বেশি বা অতিরিক্ত ‘ও’ যুক্ত করা হয়, সেটিই হচ্ছে অধিকন্তু অর্থে যুক্ত হওয়া ‘ও’। কোনোকিছু থেকে বেশি বা অতিরিক্ত অংশটুকু বাদ দিলে মূল জিনিসে বা বিষয়ে তার কোনো আসর পড়ে না। একইভাবে, কোনো শব্দের সঙ্গে অধিকন্তু অর্থে যুক্ত হওয়া এরকম ‘ও’ বাদ দিলেও ওই বাক্যের ওপর কোনো আসর পড়ে না, অর্থের কোনো হেরফের হয় না। মোদ্দা কথা হচ্ছে— কোনো বাক্যের মধ্যে আরও, এখনও, কোনও, কখনও প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হলে এবং এসব শব্দ থেকে ‘ও’ বাদ দিয়ে লিখলেও ওই বাক্যের অর্থ অপরিবর্তিত থাকলে নির্দিষ্ট শব্দটির বানানে নির্দ্বিধায় পূর্ণ রূপে ‘ও’ যুক্ত করা যাবে। কিন্তু অর্থ বদলে গেলে কিংবা একটি ব্যর্থ বাক্যে পরিণত হলে ‘ও’ পূর্ণ রূপে যুক্ত না-করে কার-চিহ্ন রূপে যুক্ত করে ‘আরো’, ‘এখনো’, ‘কোনো’, ‘কখনো’ প্রভৃতিরূপে লেখাটা সংগততর। এই নিয়মটি স্পষ্ট করবার জন্যে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা উচিত, এবং আমি তা করেছিও—
ক. ‘আমি আরও/আরো খেতে পারব না।’— এই বাক্যের মধ্যে ‘আর’ শব্দটির সঙ্গে ‘ও’ প্রত্যয় কার-চিহ্ন রূপে যুক্ত হবে, না কি পূর্ণ রূপে যুক্ত হবে, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ‘আরও/আরো’ শব্দটি কেবল ‘আর’ হিসেবে লিখলে দাঁড়ায়— আমি আর খেতে পারব না। যেহেতু ‘ও’ প্রত্যয় বাদ দেওয়ার পরও নতুন বাক্যের অর্থ আর মূল বাক্যে অর্থ অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে, সেহেতু মূল বাক্যটিতে ‘আরও’ বানান এভাবে লিখতে হবে।
খ. ‘আরও/আরো মানুষের জন্যে খাবার লাগবে। > আর মানুষের জন্যে খাবার লাগবে।’— যেহেতু ‘ও’ প্রত্যয় বাদ দেওয়ায় নতুন বাক্যের অর্থ মূল বাক্য থেকে ভিন্নতর হয়ে গিয়েছে, সেহেতু মূল বাক্যটিতে ‘আরো’ বানান এভাবে অন্ত্যে ‘ও-কার’ দিয়ে লেখাটা বিধেয়।
গ. ‘তুমি কি এখনও/এখনো যেতে পারবে না? > তুমি কি এখন যেতে পারবে না?’— যেহেতু ‘ও’ প্রত্যয় বাদ দিয়ে ‘এখন’ লিখলেও নতুন বাক্যের আর মূল বাক্যের অর্থ অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে, সেহেতু প্রথম বাক্যটিতে ‘এখনও’ বানান এভাবে লিখতে হবে।
ঘ. ‘সে এখনও/এখনো আমার কথা শোনে। > সে এখন আমার কথা শোনে’— যেহেতু নতুন বাক্যটিতে ‘ও’ প্রত্যয় বাদ দিয়ে ‘এখন’ লিখলে মূল বাক্যের অর্থ বদলে যাচ্ছে, সেহেতু প্রথম বাক্যটিতে ‘এখনো’ বানান শেষ বর্ণের সঙ্গে ‘ও-কার’ দিয়ে লেখাটা যথার্থ।
ঙ. ‘আমি কোনও/কোনো পির নই। > আমি কোন পির নই?’— যেহেতু ‘ও’ প্রত্যয় বাদ দিয়ে কেবল ‘কোন’ লেখা হলে মূল বিবৃতিমূলক বাক্যটি প্রশ্নবোধক বাক্যে পরিণত হচ্ছে, সেহেতু মূল বাক্যটিতে ‘কোনো’ বানান ‘দন্ত্য-ন’-এর সঙ্গে ‘ও-কার দিয়ে লেখাটা সমীচীন।
চ. ‘তিনি কোনও/কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মেছিলেন। > তিনি কোন সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মেছিলেন?’— এখানেও মূল বাক্যে ‘কোনো’ লিখতে হবে; ‘ঙ’-এর ব্যাখ্যা প্রযোজ্য।
ছ. সে কখনও/কখনো মিথ্যে বলেনি। > সে কখন মিথ্যে বলেনি? এক্ষেত্রেও মূল বাক্যে ‘কখনো’ লেখাটা যথাযথ। কারণ, ‘ও’ প্রত্যয় বাদ দিয়ে লিখলে মূল বিবৃতিমূলক বাক্যটি প্রশ্নবোধক বাক্যে পরিণত হচ্ছে।
জ. ছাফিয়া কখনও/কখনো অকৃতকার্য হয়নি > ছাফিয়া কখন অকৃতকার্য হয়নি? এই উদাহরণের মূল বাক্যেও ‘কখনো’ লেখাটা বিধিসম্মত, এবং কারণ হিসেবে ‘ছ’-এ উল্লেখ করা ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
ঝ. ‘আমি যে-কোনও/যে-কোনো কাপড় পরতে পারি না। > আমি যে-কোন কাপড় পরতে পারি না।’— যেহেতু ‘ও’ প্রত্যয় বাদ দিয়ে ‘যে-কোন’ লেখা হলে নতুন বাক্যটি একটি স্পষ্ট অর্থহীন বাক্যে পরিণত হচ্ছে, সেহেতু মূল বাক্যে ‘যে-কোনো’ বানানটি শেষ বর্ণের সঙ্গে ‘ও-কার’ দিয়ে লেখাটা বিধেয়।
এটুকু বলার পর একটি প্রশ্ন সূচিত হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক এবং সেটি হচ্ছে— তাহলে বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান ‘আরো হচ্ছে আরও-এর প্রচলিত বানান’ এবং ‘আরও হচ্ছে আরো-র সংগততর বানান’ মন্তব্য দুটি কেন করল?
এর উত্তর অভিধানেই উল্লেখ রয়েছে— ‘আরও’ তখনই ‘আরো’-র সংগততর বানান হবে, যখন তা অধিকন্তু অর্থে ব্যবহৃত হবে।
< এবি ছিদ্দিক
[ জ্ঞাতব্য: ১. বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, ও বাংলা একাডেমি বাংলা বানান অভিধানে ‘কখনও’ আর ‘যে-কোনও’ বানানের কোনো ভুক্তি উল্লেখ নেই। কেননা, ‘কখন’ ও ‘কোন’-এর সঙ্গে অধিকন্তু অর্থে ‘ও’ প্রত্যয় যুক্ত হতে পারে না।
২. আর, এখন, কখন, কোন প্রভৃতি শব্দের উচ্চারণ যথাক্রমে /আর্, অ্যাখন্, কখোন্, কোন্/ প্রভৃতি। ] (২১শ মে, ২০২০)
ক্রমশ
অতিরঁজনশূন্য: একটি শব্দের প্রকৃত অর্থ নিরূপণ