অতিরঁজনশূন্য: একটি শব্দের প্রকৃত অর্থ নিরূপণ ৫৭
“এবার ‘অতি’ উপসর্গ দিয়ে একটি শব্দ বল (বলো) তো,” ব্ল্যাকবোর্ডের মধ্যখানে বড়ো বড়ো হরফে ‘অতি’ শব্দটি লেখাটা সম্পন্ন করে শিক্ষার্থীদের কাতারের দিকে যেতে-যেতে খোকন স্যার বললেন।
স্যার গত কয়েকদিন ধরে উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন ক্লাসে ঢুকেই একটি করে উপসর্গ বোর্ডের ওপর লেখেন, পরে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সেটি দিয়ে বিভিন্ন শব্দ তৈরি করে গঠিত নতুন শব্দগুলোর অর্থে ওই উপসর্গটির প্রভাব নিরূপণ করতে শেখান। আফসানা-ছাফিয়া-সানারাও স্যারের এরূপ পাঠদানের মজায় মজেছে। মজবেই না বা কেন? এসব পড়তে গিয়ে তারা যে এখন ‘আশা-প্রত্যাশা’, ‘অভিযোগ-অনুযোগ’, ‘উপহাস-পরিহাস’, ‘দ্বেষ-বিদ্বেষ’ প্রভৃতির মতো বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী যুগল শব্দের সূক্ষ্ম পার্থক্য নিরূপণ করতে শিখে গিয়েছে। এখন উপসর্গের পাঠ মানেই সকলের মধ্যে অংশগ্রহণের প্রতিযোগিতা!
“অতিরঁজনশূন্য, স্যার,” ‘অতি’ উপসর্গ যুক্ত করে চটজলদি সাফা একটি শব্দ বলে ফেলল। দিনের প্রথম উদাহরণ দেওয়াটা সাফা অভ্যেস বানিয়ে ফেলেছে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না।
“কী বলেছ?” সাফার বলা শব্দটি শুনতেই নিশ্চিত হওয়ার জন্যে খোকন স্যার আরও এক বার বলতে বললেন। “অতিরঁজনশূন্য, স্যার,” একটু আগে বলা শব্দটি সাফা আবারও আওড়ে গেল। “অতিরঁজনশূন্য! এত চমৎকার শব্দটি কোথায় পেয়েছ?” খোকন স্যার তাৎক্ষণিক জিজ্ঞেস করলেন। স্যারের চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ— রঞ্জন নয়, রঞ্জনশূন্য নয়, রঁজনশূন্যও নয়; একেবারেই অতিরঁজনশূন্য! “এটি লিজার ডাকনাম,” সাফা বলতে যাবে, তার আগেই সুমাইয়া জবাব দিয়ে দিল। খোকন স্যার এবার আরও বিস্মিত হলেন— “কারোর ডাকনাম অতিরঁজনশূন্য কেন হতে যাবে!” লিজা ফার্স্ট বেঞ্চেই বসেছিল। স্যার এবার সোজা লিজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। “এ আমি কী শুনছি, লিজা? সত্যই কি তোমার ডাকনাম ‘অতিরঁজনশূন্য’?” খোকন স্যার প্রশ্ন করলেন। “জি হ্যাঁ, স্যার,” শ্রেণির সবচেয়ে অমায়িক ছাত্রী লিজা কোনো অতিরিক্ত বাক্যব্যয় ছাড়াই জবাব দিল। “কোনো খাস কারণ?” স্যার আবারও জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি একেবারেই সাধারণ একজন মানুষ— একদম সাধাসিধে, তাই,” লিজার ত্বরিত জবাব।
“স্যার, লিজি সাজগোজ মোটেও পছন্দ করে না,” লিজার জবাব শেষ হতে না-হতেই আনিশা জোর গলায় বলল।
“কোনো বিয়ে-অনুষ্ঠানে যেতেও পছন্দ করে না,” সানজিদা আরও একটি কারণ উল্লেখ করে দিল।
“সেদিন ফ্রিতে টিকেট পাওয়া সত্ত্বেও আতিফ আসলামের লাইভ কন্সার্ট দেখতে যাওয়ার ন্যূনতম আগ্রহও দেখাল না,” ভ্যাংচি কেটে মুনতাহাও একটি পয়েন্ট যুক্ত করল।
“ ‘গেন্দাফুল’ গানের নতুন ভিডিয়োটি তো সে দেখেইনি!” আনার সবিস্ময় মন্তব্য।
“সে একটুও না-হেসেই পেটে খিলধরানোসব কৌতুক বলে দেয়,” পাঁচ নম্বর মন্তব্যটি তাসিয়া যুক্ত করল।
“সে হালের কোনো ট্রলই পছন্দ করে না,” তাহিয়ানের মন্তব্যও বাদ গেল না।
“ ‘অতিরঁজনশূন্য’ অর্থ কী?” অন্যদের বলা থামিয়ে দিয়ে লিজাকে লক্ষ্য (উদ্দেশ্য) করে খোকন স্যার বললেন।
“অত্যন্ত সাধারণ,” লিজা সব প্রশ্নের জবাব এমনভাবে দিয়ে যাচ্ছে, যেন সবটাই বাড়িত্থেকে মুখস্থ করে এসেছে।
“উঁহুঁ! হলো না!”— স্যারের এই মন্তব্য শুনতেই লিজার মুখ থেকে গোলাপি আভা দূর হয়ে লজ্জায় তা লাল আভায় পরিবর্তিত হলো।
“তাহলে ‘অতিরঁজনশূন্য’ মানে কী, স্যার?” সে কালক্ষেপণ না-করেই জিজ্ঞেস করল। “চল, আজ আমরা লিজার ডাকনামের প্রকৃত অর্থ নিরূপণ করি,” খোকন স্যার এই প্রস্তাব রাখতেই অন্যান্য শিক্ষার্থীরা ‘কী মজা’ বলে পিঠ টানটান করে বসল। প্রশ্ন দিয়েই স্যারের বলা শুরু হলো—
রঁজন মানে কী?
“আমি তো কখনো ‘রঁজন’ বলে কোনো শব্দ শুনিনি,” শুরুতেই সাবিত মন্তব্য করে বসল।
“আরে! তৎসম ‘রঞ্জন’ থেকে অতৎসম ‘রঁজন’-এর সৃষ্টি। অতৎসম রূপে মূল শব্দ থেকে নাসিক্য বর্ণ ‘ঞ’ লোপ পাওয়ায় তার পরিবর্তে চন্দ্রবিন্দু লেখা হয়েছে; যেভাবে বঙ্কিম থেকে বাঁকা, কান্না থেকে কাঁদা, অন্ধকার থেকে আঁধার প্রভৃতি লেখা হয়,” স্যার ব্যাখ্যা করবার আগেই ছাফিয়া বুঝিয়ে দিল।
— বাহ্! খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলে। রঁজনের মূল হচ্ছে রং। কোনো শ্রীহীন জিনিসের দীনতা বা বিশ্রী রূপ ঢাকবার জন্যে ওই জিনিসের ওপর রং করে রঞ্জিত করা হয়; রঞ্জিত করে প্রকৃত অবস্থা লুকানোর চেষ্টা করা হয়।
“তাই তো বাড়ির দেওয়াল, ক্লাসরুমের বেঞ্চ, সড়কের বিভাজিকা, বাগানের বেড়া প্রভৃতি তাদের সৌন্দর্য হারালে আমরা রং লাগিয়ে রঞ্জিত করে আবারও সুন্দর করে তোলার চেষ্টা করি। এটি একেবারেই সাধারণ একটি ব্যাপার,” স্যারের বলার মধ্যখানে তানহা বলে উঠল।
— একদম ঠিক। মানুষের চরিত্রও হচ্ছে রঙের মতো। মানুষ তার চরিত্রের রং দিয়ে সাধারণ বিষয়কে রঙিন বানানো চেষ্টা করে; যতটুকু নয়, তার চেয়েও বেশি করে দেখানোর চেষ্টা করে। রঞ্জনপ্রিয় মানুষ সদা চাকচিক্যের পেছনে ছোটে; তারকাদের দেখলেই উত্তেজিত হয়ে যায়, মাথায় নিয়ে নাচতে চায়, তাদের অনুসরণ করতে চায়; আচার অনুষ্ঠানে নিজেকে বিশেষভাবে তুলে ধরতে চায়, নিজের বিশেষত্ব লোকসম্মুখে দেখিয়ে দিতে চায়; অন্য দশজনে যা করে, নিজেও তার অনুকরণ করে তাদের একজন হতে চায়। ধর, এই মুহূর্তে আমাদের শ্রেণিকক্ষে শ্রেয়া ঘোষাল এলেন। তাহলে তোমরা কী করবে?
“আমি প্রথমেই একটি সেলফি নিয়ে নেব,” আকলিমা যেন সকলের মনের কথাটিই বলে দিল (দিলো)।
— সে সুযোগ আমিও কিন্তু হাতছাড়া করব না! শতের মধ্যে নব্বই জনেরও বেশি লোক এমনটিই করবে। কিন্তু অনেকেই আছে, যারা এসব কাজ লোকদেখানোর জন্যে বাড়াবাড়ি বলে মনে করে, রঞ্জিত বিষয় বলে পছন্দ করে না। তাদের কাছে রঞ্জিত কোনো কাজই গ্রহণযোগ্য হয় না বলে আমরা তাদের রঞ্জনশূন্য-বাস্তববাদী বলি। টম ক্রুজ-শ্রেয়ার মতো তারকার আগমনে তারা একটুও ভ্রুক্ষেপ করে না।
“আমাদের লিজু!” সকল শিক্ষার্থী একযোগে বলল।
— আচ্ছা, বিদ্যালয়ের শেষ দিনের অনুষ্ঠানে তোমাদের আপা-ভাইয়েরা কীরকম পোশাক পরে আসে, তা কখনো খেয়াল করেছ কি?
“আপুরা নতুন শাড়ি এবং ভাইয়েরা নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে আসে,” মিলিত কণ্ঠে উচ্চারিত হলো।
— এটিই স্বাভাবিক। কারণ, আমাদের রঞ্জিত চরিত্র নিজেদেরকে রঙিন করে উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রশংসা কুড়ানোর লোভে পড়তে বাধ্য করে। শয়ের মধ্যে নব্বই জনেরও বেশি এমনটিই করবে। কিন্তু কিছু মানুষ আছে, যারা রঞ্জিত হয়ে চাকচিক্য বেশভূষা নিতে নারাজ।
“গত অনুষ্ঠানে মাহাথির ভাই পুরোনো শার্ট পরেই এসেছিলেন,” সুযোগ বুঝে মাহাথিরের প্রসঙ্গ নিয়ে আসার লোভ তিথি সামলাতে পারল না।
— শেখ সাদী-আইনস্টাইনরাও এমনটিই ছিলেন। সাদীর কাপড়কে খাবার খাওয়ানোর ঘটনা তো কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে।
“ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও,” আফসানা আরও এক জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম যুক্ত করল।
— এই তো, এতক্ষণে ঘরের মানুষের উদাহরণ দিলে। এবার বল (বলো), একশ জনের মধ্যে যে নব্বই জন সেলফি তোলার জন্যে দৌড়াবে কিংবা সেজেগুজে নতুন কাপড় পরে অনুষ্ঠানে যাবে, তারা সাধারণ, না কি যে দশ জন ধীর হয়ে বসে থাকবে কিংবা সাধারণ পোশাক পরে অনুষ্ঠানে যাবে, তারা সাধারণ?
“যে নব্বই জন সেলফির পেছনে দৌড়াবে কিংবা সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করবে, তারাই সাধারণ,” ছাফিয়া মুহূর্তের মধ্যে জবাব দিয়ে দিল (দিলো)।
“নব্বই জনের দল কেন সাধারণ হবে?” ছাফিয়ার জবাব শেষ না-হতেই আপত্তি জানিয়ে ইশমামের প্রশ্ন।
এবার স্যারের জায়গায় ছাফিয়া বলতে শুরু করল:
ধর, আমাদের স্কুলের অনুষ্ঠানে আসা দশ জন অতিথির মধ্যে আট জনের পরিহিত টি-শার্টের রং নীল, আর দুই জনের টি-শার্টের রং কালো। তাহলে কোন টি-শার্টগুলো সাধারণ?
“এটি কোনো প্রশ্ন হলো! নিঃসন্দেহে নীল রঙেরগুলো সাধারণ।” আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ইশমামের জবাব।
: কেন?
“বাহ্রে! যা একেবারেই সুলভ, সকলে গায়ে দেয়, তা সাধারণ না-হয়ে দুর্লভগুলো সাধারণ হবে নাকি? তোমাকে বলেছিলাম না, আমার জার্সি অন্যদের মতো কমন না-হওয়ার জন্যে এবারে বেলজিয়ামের জার্সি কিনব।” ব্যঙ্গভরে ইশমাম জবাব দিল (দিলো)।
: যথার্থ! অর্থাৎ, যা সহজে মেলে, সবখানে পাওয়া যায়, সকলের মধ্যে পাওয়া যায়, শতকরায় সিংহভাগ থাকে, তাই (তা-ই) সাধারণ। বেশিরভাগ মানুষ তাই (তা-ই) করে, যা সাধারণ— তারকার পেছনে দৌড়ানো, বাহ্যিক চাকচিক্য নিয়ে বাড়াবাড়ি, তিলকে তাল বানানো বাগেরা বাগেরা। আর যে মানুষগুলো সাধারণ বা স্বাভাবিক কাজগুলো করে, তারাই তো সাধারণ মানুষ। নাকি!
“তাই তো!” নিজের বোকামি বুঝতে পেরে মাথা চুলকে ইশমাম বসে পড়ল।
এবার খোকন স্যার বলা শুরু করলেন—
তাহলে রঞ্জিত কারা?
“যারা অন্য নব্বই জনের মতো স্বাভাবিক বিষয়কে রঞ্জিত করার সাধারণ-সহজাত ধারণা অনুসরণ করে চলে, অগ্রজদের বানানো রীতি অন্ধের মতো অনুকরণ করে,” মিলিত কণ্ঠ আরও এক বার কয়ে উঠল।
— যারা অন্যের দেখাদেখি এসব সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করে চলে, মানুষ হিসেবে তারা সাধারণ, না কি অসাধারণ?
“অবশ্যই সাধারণ!” ইশমাম জোর গলায় তার ভুল শুধরে নিল।
— যাদের মধ্যে এই রঞ্জিত ভাব সামান্যটুকুও নেই, তাদের কী বলা উচিত?
“রঁজনশূন্য।” তদ্ভব শব্দ বলতে ও লিখতে পছন্দ করা তাসরিয়ানের প্রত্যয়ী জবাব।
— তাহলে ‘রঁজনশূন্য’ শব্দের অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে?
“যার মধ্যে সাধারণের মতো লোকদেখানো আচার-আচরণ এতটুকুও নেই। অর্থাৎ, অসাধারণ,” শব্দের অর্থ বলায় মাহির সানা অবলীলায় বলে দিল (দিলো)।
এবার খোকন স্যার লিজার সামনে গিয়ে শুরুর প্রশ্নটি সামান্য একটু পরিবর্তন করে আরও এক বার উচ্চারণ করলেন— “তাহলে ‘অতিরঁজনশূন্য’ শব্দের অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে?”
“অসাধারণ, স্যার,” বরাবরের মতো স্থির ও সপ্রতিভ ভঙ্গিমায় লিজার জবাব।
“গলত!” লিজার জবাব শুনতেই ছাফিয়া চেঁচিয়ে উঠল।
— তাহলে অর্থ কী হবে?
“অনন্যসাধারণ! কারণ, ‘রঁজনশূন্য’ শব্দের শুরুতে ‘অতিরিক্ত’, ‘অত্যন্ত’, ‘খুব’ প্রভৃতি অর্থে ‘অতি’ উপসর্গটি যুক্ত হয়েছে,” নিজের দক্ষতার জাহির করবার সুযোগ পেয়ে ছাফিয়া আবারও নিজের কামাল দেখিয়ে দিল (দিলো)।
— এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গিয়েছ যে, গত নয় বছরে তোমাদের মধ্য থেকে কেউই লিজার কাছ থেকে প্রথম স্থান কেন ছিনতে পারেনি!
“ও!” গোটা শ্রেণিকক্ষে বিস্ময়ের সঙ্গে ধ্বনিত হলো।
“ ‘অতিরঁজনশূন্য’-এর মামলা তো ‘অপরূপ’-কেও ছাড়িয়ে গেল!” আফসানার মুখ দিয়ে বিস্ময়মাখা মন্তব্যটি বের হতে না-হতেই ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজে গেল।
[ জ্ঞাতব্য: যাঁরা কোনো কিছুতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখান না, তাঁরাই হচ্ছে অতিরঞ্জনশূন্য বা অতিরঁজনশূন্য। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, খেলার জগতে ‘হাশিম আমলা’ একজন অতিরঁজনশূন্য ব্যক্তি।
২. ‘অতিরঁজনশূন্য’ শব্দটির অর্থ নিরূপণের সময় প্রথমে ‘রঁজন’-এর সঙ্গে ‘অতি’ উপসর্গ যুক্ত করেও আলোচনা আগানো যায়। সেক্ষেত্রেও সমাপ্তিতে একই অর্থ পাওয়া যাবে। (১৭ই মে, ২০২০)
ক্রমশ
সূক্ষ্ম পার্থক্য: হাইফেন আর ড্যাশের প্রয়োগবিধি: পর্ব-০১ ও পর্ব-০২