সূক্ষ্ম পার্থক্য: হাইফেন আর ড্যাশের প্রয়োগবিধি: ৫৬
সূক্ষ্ম পার্থক্য: হাইফেন আর ড্যাশের প্রয়োগবিধি: পর্ব-০১
‘১.১। টম টটেনহাম-প্যারিস ঘুরতে যাবে।
১.২। টম টটেনহাম–প্যারিস ঘুরতে যাবে।
২.১। ১-৫ বছরের শিশুদের টিকা দেওয়া যাবে না।
২.২। ১–৫ বছরের শিশুদের টিকা দেওয়া যাবে না।’
ওপরের বাক্য কটি ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা সম্পন্ন হতেই খোকন স্যার শিক্ষার্থীদের কাতারে গিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললেন, “আমার লেখা যুগল বাক্যগুলোর মধ্যে কোনটি সংগত আর কোনটি অসংগত?”
উদ্ধৃতিচিহ্নের ঘটনার পর থেকে সানার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে; সেদিন থেকে ব্যাকরণে ক্লাসে সে আর সবজান্তা সাজতে যায় না। আর ছাফিয়া? সে তো সেদিন থেকে তারকা বনে গিয়েছে! স্যারের প্রশ্ন শুনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই তার (ছাফিয়ার) দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। “মনে হচ্ছে আজকেও তোমাকেই বলতে হবে,” ছাফিয়াকে লক্ষ্য (উদ্দেশ্য) করে খোকন স্যার কথাটি বললেন। স্যার যে এমনটি বলবেন, ছাফিয়া তা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল, স্যারের বলাতে তা পূর্ণতা পেল। ছাফিয়া অলস, কিন্তু অত্যন্ত নান্দনিক ভঙ্গিতে বলল, “আপনার লেখা প্রতিটি বাক্যই শুদ্ধ, তবে অর্থের দিক থেকে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে, স্যার।” ছাফিয়ার পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দেওয়ার ধরন এবং স্যারের মুখে খুশির ছাপ দেখে অন্যরা নড়েচড়ে বসল। তারা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, ছাফিয়া একদম ঠিক উত্তর দিয়েছে এবং গত ক্লাসের মতো আজকেও দুইটি যতিচিহ্নের যথাযথ প্রয়োগ শিখতে মিলবে।
“তাহলে দেরি কীসে! তোমার ব্যাখ্যা শুনতে তোমার সহপাঠীরা কেমন অধীর হয়ে আছে, তা দেখতে পাচ্ছ না!” খোকন স্যার ছাফিয়াকে তাগিদ দিয়ে বললেন। এবার ছাফিয়া বলতে শুরু করল—
“বাক্যের মধ্যে দুইটি সমজাতীয় শব্দের মধ্যখানে তখনই হাইফেন ( – ) বসে, যখন ওই শব্দ দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব সমাস সম্পন্ন হয়। দ্বন্দ্ব সমাসে সমাসবদ্ধ পদে ব্যাসবাক্যের ‘ও’/‘আর’/‘এবং’ আর ‘কিংবা’/‘বা’/‘অথবা’ লোপ পেয়ে সেগুলোর পরিবর্তে হাইফেন বসে। অর্থাৎ, মা ও বাবা = মা-বাবা; হাত ও পা = হাত-পা; ভালো ও মন্দ = ভালো-মন্দ ; দেশ ও বিদেশ = দেশ-বিদেশ; উত্তর ও দক্ষিণ = উত্তর-দক্ষিণ; খাওয়া ও পরা = খাওয়া-পরা; পন্টিং, স্মিথ, ওয়ার্নার ও ম্যাক্সওয়েলের ফিল্ডিং = পন্টিং-স্মিথ-ওয়ার্নার-ম্যাক্সওয়েলের ফিল্ডিং; সাত ও পাঁচ = সাত-পাঁচ; রাজা ও রানি = রাজা-রানি, পেলে ও ম্যারাডোনা = পেলে-ম্যারাডোনা প্রভৃতি। একইভাবে, টটেনহাম ও প্যারিস = টটেনহাম-প্যারিস ; ১ ও ৫ = ১-৫। অর্থাৎ, ১.১ নম্বর বাক্যে টম কোনো একটি জায়গায় থাকে। সে সেখান থেকে টটেনহাম ও প্যারিসে ঘুরতে যাবে। বাক্য ২.১-এ কেবল ১ বছরের আর ৫ বছরের শিশুদের টিকা দেওয়া যাবে না; ২, ৩ ও ৪ বছরের কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সের শিশুদের টিকা দিতে কোনো সমস্যা নেই।
এবার ড্যাশযুক্ত বাক্য দুটি নিয়ে বলছি। দুই বা তারও অধিক সময় (কাল) বা দূরত্ব নির্দেশক শব্দের মধ্যখান থেকে ‘থেকে’ বা ‘হতে’ বাদ দিলে তার পরিবর্তে ‘ড্যাশ’ (এন ড্যাশ) বসাতে হয়। যেমন: ঢাকা থেকে কলকাতা = ঢাকা–কলকাতা; ১০ থেকে ১৫ জন = ১০–১৫ জন; মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত = মে–সেপ্টেম্বর পর্যন্ত; চট্টগ্রাম থেকে দিল্লি, তারপর দিল্লি থেকে সিডনি = চট্টগ্রাম–দিল্লি–সিডনি; শনি থেকে বুধবার পর্যন্ত = শনি–বুধবার পর্যন্ত; ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ = ১৯৪৭–১৯৭১। একইভাবে, টটেনহাম থেকে প্যারিস = টটেনহাম–প্যারিস; ১ থেকে ৫ বছরের = ১–৫ বছরের। অর্থাৎ, ১.২ নম্বর বাক্যে টম টটেনহামে থাকে। সে সেখান (টটেনহাম) থেকে প্যারিসে ঘুরতে যাবে। বাক্য ২.২-এ ১ থেকে ৫ বছরের মধ্যে কোনো শিশুকেই টিকা দেওয়া যাবে। স্যার!”
ছাফিয়ার বলা শেষ হতে না-হতেই সানা দাঁড়িয়ে গেল আর জিজ্ঞেস করল, “ তা, ‘কিংবা’-র পরিবর্তে হাইফেনের প্রয়োগ কীভাবে করব?” ছাফিয়া আবারও বলতে শুরু করল—
“দুইটি সাংখ্যিক মানের মধ্যে সন্দেহ বা দ্বিধা থাকলে ওই সংখ্যা দুটির মধ্যখানে যে কিংবা/বা/অথবা ব্যবহার করা হয়, সেটি না-দিলে তার পরিবর্তে হাইফেন দিতে হয়। যেমন: ৫ কিংবা ৬ বছর লাগবে = ৫-৬ বছর লাগবে; উনিশ কিংবা বিশ = উনিশ-বিশ প্রভৃতি।”
“ ‘হাইফেন’ আর কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হবে?” এবার খোকন স্যার নিজেই জিজ্ঞেস করলেন।
শিক্ষক-শিক্ষক ভাব নিয়ে ছাফিয়ার বলা আবারও শুরু হলো—
হাইফেন মূলত সমাসবদ্ধকরণে ব্যবহৃত হয়। হাইফেনের প্রধান ব্যবহার ইতোমধ্যে বলা হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, যেখানেই দ্বন্দ্ব সমাস সম্ভব, সেখানেই হাইফেন দেওয়া যাবে; যেখানে ‘ও’ ব্যবহার করা যাবে, সেখানে ‘ও’-র পরিবর্তে হাইফেন ব্যবহার করা যাবে। ক্রিয়াপদের শুরুতে ব্যবহৃত না-বাচক ‘না’-ও হাইফেন দিয়ে লেখাটা সংগততর।
“যেমন: না-বলা, না-করা, না-মানা প্রভৃতি। তাই না?” ছাফিয়ার কাজ আরও একটু এগিয়ে দিয়ে খোকন স্যার বললেন।
— একদম, স্যার!
“আর কোথায় লিখতে হবে?” খোকন স্যার পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন।
— অনুরোধ বোঝাতে ক্রিয়াপদের শেষে হাইফেন দিয়ে ‘করুন-না’, ‘বলুন-না’, ‘ছাড়ুন-না’ প্রভৃতিরূপে লিখতেও কোনো বাধা নেই। সর্বনামের সঙ্গে পরবর্তী বিশেষ্য বা সর্বনাম যুক্ত করার ক্ষেত্রেও হাইফেন ব্যবহার করা যায়।
“যেমন: যে-কোনো, যে-কেউ, যা-তা, সে-জন, যে-কারণে প্রভৃতি,” দ্বিতীয় বেঞ্চ থেকে তাসিয়া জোর-গলায় বলে উঠল।
— ঠিক তাই, তাসিয়া! আবার, দ্বিরুক্তির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শব্দের সামান্য পরিবর্তন হলে শব্দ দুটি নিরেটভাবে লিখতে হয়। যেমন: মাঝেমধ্যে, তাড়াতাড়ি প্রভৃতি। কিন্তু, যদি এরূপ ক্ষেত্রে শব্দ দুটি নিরেটভাবে লিখলে দৃষ্টিকটু মনে হয়, তাহলে মধ্যখানে হাইফেন ব্যবহার করা যাবে। অনুগামী ক্রিয়ার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম।
“তবে ওলটা-পালটা, যেখানে-সেখানে, এপার-ওপার, যেতে-যেতে, পড়তে-পড়তে প্রভৃতি বানানে হাইফেন দেওয়ার এই কারণ!” বিস্ময়ের সঙ্গে সাবিত বলল।
— আর নয়তো কী! বাক্যের মধ্যে যৌগিক ক্রিয়াপদকে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করা হলে ওই পদদ্বয় বা পদগুলোর মধ্যখানেও হাইফেন দেওয়া যায়। “সেদিন মোরশেদ স্যারের লেখায় ‘উল্লেখ-করা’, ‘এঁকে-দেওয়া’, ‘বাড়িয়ে-বলা’ প্রভৃতি রূপ তাহলে এই নিয়মে লেখা হয়েছে?” অবশেষে ক্লাসের নিশ্চুপ ছাত্র ইশমামের মুখ দিয়েও প্রশ্ন বেরিয়ে এল।
— তোমার উপলব্ধি কী আর ভুল হতে পারে! তারপর, সন্ধির ঝামেলা এড়াতে ‘কু-অভ্যাস’, ‘অতি-অল্প’, ‘সহ-অধিনায়ক’, ‘পালটা-আক্রমণ’ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও নির্দ্বিধায় হাইফেন ব্যবহার করা যাবে। সংখ্যার সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত করতে কিংবা শব্দের মূল বানান অবিকৃত রাখতে হাইফেনের ব্যবহার কিন্তু আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।
“৩-এর, ১৭৪৭-এ, ‘শুবাচ’-এ, ‘ক’-এর, ‘মামা’-র প্রভৃতি হচ্ছে এই নিয়মের প্রকৃষ্ট উদাহরণ,” টমের আরেক ছাত্রী আফসানা এক নিশ্বাসে বলে দিল।
— যথার্থ বলেছ, পিমা! কোনো জায়গার পরিচয়ে কোনো ঘটনা বা বিষয় কিংবা অনুষ্ঠানের নামকরণের ক্ষেত্রেও হাইফেন ব্যবহার করা যায়।
“মদিনা-সনদ, তিস্তা-চুক্তি, রিও-অলিম্পিক, লর্ডস-টেস্ট প্রভৃতি এই নিয়মে লেখা হয়েছে,” সানজুর সপ্রতিভ মন্তব্য।
— বহত খুব! দাপ্তরিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পদধারীর পদমর্যাদা বা কমিটির নাম লিখতেও হাইফেন ব্যবহার করা যায়। ‘শিক্ষা-সচিব’, ‘আহ্বায়ক-কমিটি’ প্রভৃতি রূপ এই নিয়মের লেখা হয়। এক বর্ণের শব্দকে অন্য শব্দের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও হাইফেনের ব্যবহার দৃষ্টিনন্দন।
“তাহলে কি ‘ব-তে বই’ ‘n-তম পদ’ ‘ক-সংখ্যক ব্যক্তি’ লিখতে কোনো সমস্যা নেই?” সাফাও প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারল না।
— উঁহুঁ, কোনো সমস্যা নেই। হাইফেনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে পঙ্ক্তি শেষে শব্দ ভাঙার ক্ষেত্রে। কোনো লাইনে একটি শব্দের পুরোটার সংকুলান সম্ভব না-হলে ওই শব্দটি ভেঙে বাকি অর্ধেক পরবর্তী লাইনে লেখার সময় পূর্ববর্তী লাইনের ভাঙা অংশের পরে হাইফেন জুড়ে দিতে হয়।
“বুদ্ধি-/মতি, মাতৃ-/হারা, লাগাম-/ছাড়া— এভাবে তো?” আকলিমা গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রশ্ন করল।
— আমার বন্ধুমহলের উপলব্ধি ভুল কীভাবে হয়! ‘বর্ণ-পরিচয়’, ‘স্বাধীনতা-যুদ্ধ’, ‘অক্ষর-জ্ঞান’, ‘দুর্যোগ-কবলিত’, ‘পরীক্ষা-হল’ প্রভৃতি সমাসবদ্ধ পদের অনুরূপ পদে সম্বন্ধবাচক আর নিমিত্তবাচক বিভক্তি কিংবা অনুসর্গের পরিবর্তে হাইফেন লেখা হয়; লিখতে কোনো বাধাও নেই। আর হ্যাঁ, কোনো শব্দের শেষে ‘সহিত’ বা ‘সুদ্ধ’ অর্থে ‘সহ’ সবসময় হাইফেন দিয়ে লিখতে হবে।
“বই-সহ, টাকা-সহ, প্রমাণ-সহ, শিক্ষক-সহ প্রভৃতি হচ্ছে এই নিয়মের দৃষ্টান্ত” শ্রেণির প্রাজ্ঞ ছাত্রী লিজার অংশগ্রহণও বাদ গেল না।
— জি হ্যাঁ, লিজু। এসবের পাশাপাশি সংখ্যার সাহায্যে খেলার ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রেও হাইফেন ব্যবহার করতে পারলে হাইফেনের কাজ মোটামুটি চালিয়ে নেওয়া যাবে।
“গতকাল ফুটবল খেলায় ব্রাজিল আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়েছে। আর, আজ দাবা খেলায় আমি, সুমাইয়াকে ৫-১ পয়েন্টে হারিয়েছি।” শ্রেণির সবচেয়ে ঢঙি ছাত্রী মুনতাহা বরাবরের মতো ঢঙে পূর্ণ চমৎকার ভঙ্গিমায় ছাফিয়ার শেষ নিয়মটির উদাহরণ দিয়ে দিল।
— মুনতাহার উদাহরণে হাইফেন নিয়ে আমার বক্তব্য এখানেই ফুরোচ্ছে, স্যার।
ছাফিয়ার কথা শেষ করে না-বসতেই তাসিয়া কিছু বলবার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে গেল। সে বলল, “হাইফেনের ব্যবহার তো গেল, এবার কোন কোন ক্ষেত্রে ড্যাশ ব্যব…”
তাসিয়ার কথা শেষ না-হতেই ক্লাস সমাপ্তির ঘণ্টা পড়ে যাওয়ায় খোকন স্যার তাসিয়াকে থামিয়ে দিয়ে ক্লাসের ইতি টেনে দিতে বাধ্য হলেন। (৭ই মে, ২০২০)
সূক্ষ্ম পার্থক্য: হাইফেন আর ড্যাশের প্রয়োগবিধি: পর্ব-০২
শ্রেণিকক্ষে ঢুকেই খোকন স্যার গোটা কক্ষে এক বার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কক্ষের একটি বেঞ্চও খালি নেই। সানা-সানজু-সায়িমার সম্পত্তিতে পরিণত হওয়া ফার্স্ট বেঞ্চ আজ তাসিয়া, শাওক আর লিজার দখলে। ছাফিয়া রোজকার মতো বাম পাশের কলামের দ্বিতীয় বেঞ্চেই বসেছে। তার বাম পাশে আফসানা এবং ডান পাশে সাফা। সকলের অবয়বে উত্তেজনার ছাপ, শেখার আগ্রহ এবং নিজেকে উপস্থাপনের তাড়না স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। “যাক! এতদিনে শিক্ষার্থীরা ব্যাকরণের ক্লাসে মনোযোগী হলো!” মনে মনে এই কথা বলে হাতে চক তুলে নিয়ে খোকন স্যার ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, অমনি তাসিয়া দাঁড়িয়ে গেল। “স্যার— ড্যাশ— আজ— স্যার— ছাফিয়া…” তাসিয়া কিছু বলার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু সবটাই তালগোল পাকিয়ে ফেলল। তবে সে কী বলতে চেয়েছে, তা স্যার কিংবা সহপাঠী— কারোরই বুঝতে বাকি রইল না। “ওহ্! গতদিন তো ড্যাশের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা শেষ করা হয়নি!” খোকন স্যার বিস্ময়ের সঙ্গে শব্দ কটি উচ্চারণ করতেই তাসিয়া স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল। এবার খোকন স্যার প্রতিবারের মতো বোর্ডের ওপর কিছু একটা লিখতে গেলেন।
‘১. সকাল-বিকাল;
২. সকাল–বিকাল।’
যুগল শব্দ দুটির লেখা শেষ হতেই স্যার যথারীতি শিক্ষার্থীদের কাতারে গিয়ে দাঁড়ালেন। “আমার লেখা যুগল শব্দ দুটির মধ্যে কোনটি সংগত এবং কোনটি অসংগত?” খোকন স্যারের মুখ দিয়ে পরিচিত প্রশ্নটি আরও এক বার উচ্চারিত হলো। স্যারের প্রশ্ন শেষ না-হতেই সানা দাঁড়িয়ে গিয়ে উত্তর বলতে শুরু করল—
“বোর্ডে লেখা দুটি রূপই শুদ্ধ। প্রথমটিতে ‘সকাল ও বিকাল’ সমাসবদ্ধ হয়ে মধ্যখানের ‘ও’ লোপ পেয়ে সেটির স্থলে হাইফেন এসেছে। যেমন: আমি সকালে ও বিকালে পড়তে পারব না, তবে দুপুরে পড়তে কোনো আপত্তি নেই। > আমি সকাল-বিকাল পড়তে পারব না। আবার, দ্বিতীয় রূপটিতে ‘সকাল থেকে বিকাল’-এর মধ্যকার ‘থেকে’ লোপ পেয়ে তার স্থলে ড্যাশ (এন ড্যাশ) লেখা হয়েছে। অর্থাৎ, আমি সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কোনো সময়েই পড়তে পারব না। > আমি সকাল–বিকাল পড়তে পারব না। স্যার!”
বলা শেষ করে সানার চোখেমুখে তৃপ্তির আভা। তৃপ্তি মিলবেই না বা কেন, ব্যাকরণের ক্লাসে ছাফিয়াকে কাত করে দেওয়ার এমন মোক্ষম সুযোগ রোজ রোজ থোড়াই-না পাওয়া যায়! সানার পাশাপাশি স্যার আর ছাফিয়ার মুখেও হাসির ছটা, তবে তা যেন সানার ব্যাখ্যার কোনো ভুলের কল্যাণে সৃষ্ট। “তুমি গত ক্লাসের পাঠ বেশ ভালোভাবে রপ্ত করতে পেরেছ, যার জন্যে তোমাকে বাহবা জানাচ্ছি। কিন্তু আমি বোর্ডে যেটুকু লিখেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে তোমার ব্যাখ্যা যথার্থ নয়। কী বলো, ছাফিয়া?” স্যার সানাকে বসিয়ে দিয়ে ছাফিয়াকে উদ্দেশ্য (লক্ষ্য) করে শেষ বাক্যটি বললেন। “একদম ঠিক, স্যার।” ছাফিয়া ত্বরিত উত্তর দিল। শ্রেণিকক্ষের সবাই আবারও নড়েচড়ে বসল— এতক্ষণে মূল আলোচনায় এল বলে!
“তো দেরি কীসে! পাঠদানের সময় যে হয়ে গিয়েছে!” ছাফিয়াকে উৎসাহ দিয়ে খোকন স্যার বললেন। এবার ছাফিয়া বলতে শুরু করল—
“আপনার লেখা এক নম্বর শব্দটি একটি সমাসবদ্ধ শব্দ, যা গত ক্লাসে আমি বলে ফেলেছি, আজ সানাও বলেছে। কিন্তু দুই নম্বরে একটি নয়, দুইটি শব্দ রয়েছে। প্রথম শব্দটি হচ্ছে ‘সকাল’ এবং দ্বিতীয় শব্দটি হচ্ছে ‘বিকাল’। অর্থাৎ, বাক্যের মধ্যে প্রয়োগ না-করে কেবল দুইটি সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থের শব্দের মধ্যখানে ড্যাশ (এন ড্যাশ) বসানোর মানে হচ্ছে— ওই শব্দ দুটির একটিকে অপরটির বিপরীত শব্দ হিসেবে দেখানো হয়েছে; যেমনটি আমরা লিখি:
রাতের বিপরীত শব্দ দিন = রাত–দিন; ধনীর বিপরীত শব্দ গরিব = ধনী–গরিব; অজ্ঞের বিপরীত শব্দ প্রাজ্ঞ = অজ্ঞ-প্রাজ্ঞ। স্যার!”
“আজ কিন্তু ড্যাশের সবটা শেষ করে দিতে হবে!” ছাফিয়ার বলা শেষে খোকন স্যার কিছু বলবার আগেই আবদার করে আকলিমা বলে ফেলল। “তোমার বন্ধুমহলের আবদার পূরণ করো,” আকলিমার সুরে সুর মিলিয়ে খোকন স্যারও তাগিদ দিয়ে বললেন। ছাফিয়ার পাঠদান আবারও শুরু হলো—
ড্যাশের গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবহারের কথা গত ক্লাসেই বলেছিলাম— সময়ের ব্যবধান বা স্থানের দূরত্বের মধ্যখান থেকে ‘থেকে’ বাদ দিলে ‘ড্যাশ’ ব্যবহার করতে হয়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা = চট্টগ্রাম–ঢাকা; শনি থেকে বুধবার = শনি–বুধবার; ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ = ১৯৪৭–১৯৭১ প্রভৃতি ওই নিয়মেরই উদাহরণ। পরীক্ষার খাতায় বিপরীত শব্দ লেখার সময়ও মধ্যখানে ড্যাশ ব্যবহার করা যায়, যা একটু আগেই বললাম। ড্যাশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত কিংবা তালিকা উল্লেখের পূর্বে।
“যেমন: বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। যথা— ইলিশ, চিতল, বোয়াল, কই প্রভৃতি,” সবার আগে উদাহরণ উল্লেখ করবার লোভ সাফা সামলাতে পারল না।
— ঠিক এমনটিই! ড্যাশের আরেকটি প্রয়োগ তাসিয়া শুরুতেই দেখিয়ে দিয়েছে।
“তাসিয়া কখন ড্যাশের ব্যবহার দেখালো!” সকলের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল।
— ওই যে, সে শুরুতে ড্যাশের কথা বলতে গিয়ে আমতা-আমতা করে কথার তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিল, সেটিও ড্যাশের প্রয়োগের অন্যতম একটি ক্ষেত্র। অর্থাৎ, ইতস্ততভাবে বলা কথা লেখার ক্ষেত্রে কিংবা তালগোল পাকানো কথা লেখার ক্ষেত্রে ড্যাশ ব্যবহার করতে হয়।
“যেমন: স্যার— ড্যাশ— আজ— স্যার— ছাফিয়া…” তাসিয়া বাক্যটি আরও একবার হুবহু বলে দিল।
— তাসিয়া, তুমি সত্যিই তোতলেছিলে, নাকি আমার কাজ আগে থেকে সেরে রাখছিলে, তা স্রষ্টাই ভালো জানবেন! আপাতত এটি বাদ দিয়ে মূল প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি— কোনো কথাকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করতে ড্যাশের ব্যবহার অত্যন্ত উপযোগী।
“ নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রটি হচ্ছে— কোনো বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার ওই বস্তুর ওপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক।” পদার্থবিজ্ঞানের অনুরাগী তানহা মুহূর্তেই বলে দিল।
— আর কোনো উদাহরণ?
“ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শহীদ মোজাম্মেল অডিটোরিয়াম’-টি ‘ভূতের বিল্ডিং’ নামে পরিচিত। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে— বিল্ডিংটিতে না কোনো ভূত আছে, না কখনো কোনো ভূত দেখা গিয়েছে,” তাসরিয়ান তার গতকাল লেখা যযাতির একটি বাক্য অবিকল বলে দিল।
— দুর্দান্ত! ঠিক তাসুর মতোই লিখতে হবে। কোনো বাক্যের মধ্যে কোনো শব্দ বা পদবন্ধ ঊহ্য রেখে শূন্যস্থান পূরণ করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে ড্যাশের ব্যবহার একেবারেই পরিচিত।
“প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকাকালীন ‘আকাইদ শব্দের অর্থ–’, ‘মা-বাবাকে–করব’, ‘পদার্থ কঠিন, তরল ও–অবস্থায় থাকতে পারে’ প্রভৃতি শূন্যস্থান কি আর কম পূরণ করেছি?” শাওক, তার প্রশ্নের মধ্যেই প্রয়োগ দেখিয়ে দিল।
— পূরণ করেছি বটে। তাই তো এই একটি ক্ষেত্রে আমরা নির্দ্বিধায় ড্যাশ ব্যবহার করতে পারি। এটির পাশাপাশি ভ্রমণের পথ নির্দেশ করতেও বিনা সংশয়ে ড্যাশ ব্যবহার করা যায়।
“আমার আব্বু গত মাসে আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে চেন্নাই গিয়েছিলেন। তাঁর টিকিটের ওপরের দিকে লেখা ছিল— আগরতলা–কলকাতা–চেন্নাই।” নিজের অনুকূলে একটি নিয়ম পেতেই উদাহরণ উল্লেখ করার খেলায় যুক্ত হওয়া থেকে সাবিতকে আটকানো গেল না।
— ঠিক এভাবেই লিখতে হয়। ভূমিকা বা অপ্রাসঙ্গিক কথা শেষ করে মূল প্রসঙ্গ শুরু করার ক্ষেত্রেও ড্যাশের ব্যবহার সংগততর। এতে লেখার সৌন্দর্য বাড়ে।
“ ‘এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসছি—’— এভাবে কি?” ধীর বুদ্ধির ছাত্রী লিজা গাম্ভীর্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল।
—একদম এভাবেই। কয়েকটি শব্দ বা নাম উল্লেখ করে সেগুলোকে তালিকাবদ্ধ বা গুচ্ছ রূপে প্রকাশ করতে শেষ শব্দ বা নামটির পরে ড্যাশের ব্যবহারও তো তোমরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ…
“হাইফেন, ড্যাশ, কোলন, উদ্ধৃতিচিহ্ন— কোনোটির ব্যবহারই এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়,” যতিচিহ্নের ক্লাস করতে করতে সানজুর দেওয়া উদাহরণে যতিচিহ্নের নাম চলে এল।
— উদাহরণ তো এমনই হওয়া উচিত, সানজি (বানান ঠিক আছে)!
“ড্যাশ ব্যবহারের আর কোনো ক্ষেত্র বাকি আছে কি?” এবার খোকন স্যার প্রশ্ন করলেন।
— জি হ্যাঁ, স্যার। কোনো বাক্যের মধ্যখানে ব্যাকরণগত সম্পর্কহীন কিংবা বিচ্ছিন্ন কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছ সংযোজন করতে হলে ওই শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ড্যাশ দিয়ে আলাদা করে দেওয়াটাই বিধেয়।
“দুইটি শব্দের মধ্যে দ্বন্দ্ব সমাস সম্ভব হলে— যেমন, মা ও বাবা = মা-বাবা— ওই শব্দ দুটির বানান মধ্যখানে হাইফেন দিয়ে লেখা যায়,” কারও দিকে না-তাকিয়ে আফসানা আওড়ে গেল।
— আজকের সবচেয়ে কঠিন নিয়মের উদাহরণ তুমিই দিলে, আর তাও অতি চমৎকারভাবে, পিমা! তুমি তোমার সপ্রতিভায় আমাকে বারবার চমকে দাও। চমক থেকে মনে পড়ল, অপ্রত্যাশিত কিংবা আকস্মিক চমক বোঝাতেও ড্যাশ ব্যবহার করা হয়।
“সেদিন স্কুলে আমার প্রথম দিন— জসীম স্যারকে ক্লাসমেট মনে করে তাঁর কাঁধে হাত রেখে স্কুলের বারান্দায় হেঁটেছিলাম!” উদাহরণ হিসেবে খালেক তার জীবনের টুকরো স্মৃতির কথা বলে দিল।
— বাহ্! এ তো বেশ নাটকীয় ব্যাপার! ও হ্যাঁ, নাটকের কিংবা কথোপকথনের সংলাপ লেখার ক্ষেত্রেও কিন্তু ড্যাশের ব্যবহার লক্ষণীয়; যেমনটি এবিসি আমাদের এই কথোপকথন লেখার সময় আমার সংলাপের শুরুতে বারবার ড্যাশ ব্যবহার করবে। এগুলো ছাড়া ড্যাশের আরও একটি ব্যবহার আছে, যেটি আমাদের মতো সাধারণ শিক্ষার্থীর না-জানলেও চলবে।
“অভিধানে শব্দের মূল ভুক্তি এবং অর্থের মধ্যখানে ড্যাশের ব্যবহারের কথা বলছ, তাই তো?” ক্লাসের চঞ্চলা ছাত্রী মুনতাহা এতক্ষণে কোনো নিয়মের উদাহরণ দিতে না-পেরে শেষমেশ ড্যাশের একটি প্রয়োগবিধিই উল্লেখ করে দিল।
— বিলকুল! এবার এই নিয়মের উদাহরণ কে দেব?
“ ‘ব্যাবহারিক–ব্যবহারসম্মত’— সুযোগ হলে কাজী আবদুল ওদুদের ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’ অভিধানটি ওলটালে এভাবেই দেখতে পাবে,” খোকন স্যার মুনতাহার উল্লেখ-করা নিয়মের উদাহরণ দিতেই ক্লাস সমাপ্তির ঘণ্টা পড়ে গেল। (১৪ই মে, ২০২০)
[ জ্ঞাতব্য: ১. এম ড্যাশ = —
২. এন ড্যাশ = – ]
ক্রমশ
চুপ বনাম নিশ্চুপ: নতুন শব্দ তৈরির অভিনব প্রক্রিয়া