ড. মোহাম্মদ আমীন
এস ওয়াজেদ আলী: মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যবক্তা
প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও ভ্রমণকাহিনী রচয়িতা ও প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট এস ওয়াজেদ আলী (শেখ ওয়াজেদ আলী) ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার বড় তাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভবিষ্যতের বাঙালি তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ। এই গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তাই তাঁকে বলা হয় ভবিষ্যতের বাঙালি।
তাঁর পিতা ব্যবসায়ী শেখ বেলায়েত আলী স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে শিলং বসবাস করতেন। মায়ের নাম খাদিজা বেগম। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে শিলং বড়ো তাজপুর গ্রামের পাঠশালায় এস ওয়াজেদ আলীর প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে শিলং মোখার হাইস্কুল থেকে স্বর্ণপদক-সহ এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে আলীগড় কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পাশ করেন। তিনি ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড গমন করেন এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হতে পুনরায় বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। একই সঙ্গে ব্যারিস্টারি অধ্যয়নে যুক্ত হন এবং বার এটল ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে কলকাতা প্রেসিডেন্সির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। বত্রিশ বছর কলকাতার তৃতীয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি করার পর ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। এস ওয়াজেদ আলী শিক্ষিত মহলে সুপরিচিত একটি নাম। তবে এ পরিচয় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নয়, সাহিত্যিক হিসেবে। তিনি সাহিত্যিক না হলে হাজার হাজার ম্যাজিস্ট্রেট,সচিব-মহাসচিবগণের মত মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গেপশুপাখির মত হারিয়ে যেতেন।
অভিভাবকদের ইচ্ছায় তিনি সাত বছর বয়সে আড়াই বছর বয়সী পিতৃব্য-কন্যা আয়েশা খাতুনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। লন্ডনে থাকাকালীন ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে নেলি নামের একজন ইংরেজ মহিলার সঙ্গে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইংল্যান্ড থেকে দেশে আসার পর ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম স্ত্রী আয়েশাকে পরিত্যাগ করেন। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে মিসেস নেলি, স্বামী ওয়াজেদ আলীকে পরিত্যাগ করে ওয়াজেদ আলীর ছোটো ভাই এস শমসের আলীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এস ওয়াজেদ আলী এক বার্মিজ কন্যাকে বিয়ে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। বিয়ের পর বার্মিজ মহিলার ধর্মান্তরিত নাম মিসেস বদরুন্নেসা।
এস ওয়াজেদ আলী কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কর্মকালীন ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘বুলেটিন অব দ্যা ইন্ডিয়ান র্যাশনালিস্টিক সোসাইটি’ নামে একটি ইংরেজি জার্নাল এবং ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ‘গুলিস্তাঁ’ নামের একটি বাংলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা প্রভৃতি শাখায় এস ওয়াজেদ আলীর অভূতপূর্ব দক্ষতা লক্ষ্যণীয়। তাঁর লেখার মধ্যে জাতীয়তাবাদের সুর প্রবল আবেগ কিন্তু মোহনীয় মমতায় বিধৃত। তিনি দেশ ও সমাজকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন, আর গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন দেশের মানুষকে। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুরদর্শী। গভীর পর্যবেক্ষণ স্বরূপতা দিয়ে বহুদুরের সমাজকে অবলোকন করার দুরন্ত ক্ষমতা এস ওয়াজেদ আলীর সাহিত্য কর্মকে সার্বজনীন করে রেখেছে। দুরদর্শিতাঁর সঙ্গে অনুভূত পর্যবেক্ষণকে মুগ্ধকর সজ্জায় ভাষাবদ্ধ করার ক্ষমতা এস ওয়াজেদ আলীর সাহিত্য কর্মকে সর্বমহলে উপাদেয় করে তুলে। ‘ভবিষ্যতের বাঙ্গালি’ গ্রন্থটি এস ওয়াজেদ আলীর দুরন্ত প্রতিভার দুরদর্শী অবলোকনের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। এ গ্রন্থে তিনি হিন্দু ও মুসলিম সমাজের সমন্বয়ে একটি অভিন্ন জাতি গঠনের বিষয়ে প্রাচুর্য্যময় আলোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে পরিষ্কার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক হিসেব বাংলা সাহিত্যে তাঁর আসন স্থায়ী হয়ে আছে। জীবনের শিল্প (১৯৪১), প্রাচ্য ও প্রাতীচ্য (১৯৪৩), ভবিষ্যতের বাঙালি (১৯৪৩), মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ, একবালের পয়গাম, মুসলিম সংস্কৃতির আদর্শ প্রভৃতি তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ। ইসলামের ইতিহাস ও আকবরের রাষ্ট্র সাধনা (১৯৪৯) এস ওয়াজেদ আলীর দুটি ইতিহাসগ্রন্থ। রম্যরচনাতেও তাঁর সাহিত্যিক চেতনার অনাবিল পরিবেশনা লক্ষণীয়। ‘খেয়ালের ফেরদৌস’ তাঁর একটি অসাধারণ ও আকর্ষণীয় রম্যরচনা। গুলদাস্তা (১৯২৭), মাশুকের দরবার (১৯৩০), দরবেশের দোয়া (১৯৩১), বাদশাহী গল্প (১৯৪৪), গল্পের মজলিশ (১৯৪৪), ভাঙ্গাবাঁশী প্রভৃতি তাঁর গল্পগ্রন্থ।

লেখায় তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানবীয় আচরণ, নীতিবোধে উৎসরিত জীবন-প্রত্যয় ও প্রেমের শ্বাসত মগ্নতায় আত্মবিলাসের মুগ্ধকর মহিমা রুচিশীল প্রমুগ্ধতায় তুলে ধরেছেন। স্বীয় জীবনানুভূতি ও ভাবাদর্শ তাঁর গল্পের উপজীব্য। এর সঙ্গেযুক্ত হয়েছে পারিপাশ্বিক অভিজ্ঞতালব্ধ মূল্যায়ন। ‘মাসুকের দরবার’ গল্পগ্রন্থটি এস ওয়াজেদ আলীর বিখ্যাত গল্পসংগ্রহ হিসেবে খ্যাত। সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এ গ্রন্থের গল্পসমূহকে তুর্গেনিভের প্রোজ-পয়েমস গ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে ভ্রমণ কাহিনি রচনায় এস ওয়াজেদ আলীর নাম নিঃসন্দেহে অনবদ্য সমুজ্জ্বলতাঁর দাবিদার। মোটরযোগে রাঁচির সফর (১৯৪৯), পশ্চিম ভারত (১৩৫৫) প্রভৃতি তাঁর ভ্রমণ কাহিনি। গ্রানাডার শেষ বীর (১৯৪০) এস ওয়াজেদ আলীর একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। এ উপন্যাসে তিনি ঐতিহাসিক নিষ্ঠার মাধ্যমে ঘটনাকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে।
প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট এস ওয়াজেদ আলীর সাহিত্য কর্ম তাঁর জীবন দর্শনের মতই সরল। তিনি জীবনকে কোন কৃত্রিমতা বা ভণ্ডামির বেড়াজালে আবদ্ধ করতে রাজি ছিলেন না। যা করার প্রকাশ্যে করেছেন। অনুভূত বিষয়কে কথা আর কাজের মাধ্যমে সর্বসমক্ষে বিধৃত করেছেন। অবদমনের মাধ্যমে নিজের অন্তর্জালাকে নরকজ্বালায় পরিণত করে দুর্লভ মনুষ্য জীবনের ক্ষণস্থায়ী সময়গুলোর অপচয়কে তিনি নিশ্চিত অপরাধ হিসেবে জানতেন। এ সব ভণ্ডামি হতে বিমুক্ততাঁর সাহস ও উদ্যমী মানসিকতা তাঁর গল্পসমূহ সরল, গতিময় ও নির্ভেজাল জীবনাধারে আদৃত দ্বান্দ্বিক সমাজের আলেখ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মণ্ডিত একজন আদর্শ মানুষ। হিন্দু-মুসলিম সবার কাছে তিনি সমান জনপ্রিয়তাঁর অধিকারী ছিলেন।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর তিনি কলকাতা এলবার্ট হলে কবি নজরুল ইসলামকে সংবর্ধনা প্রদানের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির সভাপতি ছিলেন এবং সভাপতি হিসেবে অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন। একই বছর তিনি আসাম মুসলিম ছাত্র সমিতির বার্ষিক সম্মেলনেও সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সম্মিলনী সভায় সভাপতিত্ব করেন।
এস ওয়াজেদ আলী বাংলা ভাষার একজন প্রধান গদ্য লেখক। মুসলমান সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর প্রচুর লেখা থাকলেও মননে-বরনে তিনি ছিলেন আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক ও স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী একজন যথার্থ সাহিত্যিক। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু-মুসলমান ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠা তাঁর সাহিত্যকর্মের মুল উপজীব্য।
১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জুন এস ওয়াজেদ আলী কলকাতায় মারা যান।
সূত্র: বাংলা সাহিত্যে প্রশাসক, ড. মোহাম্মদ আমীন
কিছু প্রয়োজনীয় পোস্ট—