ড. মোহাম্মদ আমীন
ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রথিতযশা বাঙালি কবি, সমাজকর্মী এবং নারীবাদী লেখিকা কামিনী রায় ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই অক্টোবর বাকেরগঞ্জের বর্তমান বরিশাল জেলার বাসণ্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা চণ্ডীচরণ সেন ছিলেন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী। পেশায় ছিলেন বিচারক নেশায় ছিলেন ঐতিহাসিক লেখক ছিলেন। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে চণ্ডীচরণ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা লাভ করেন। পরের বছর তার স্ত্রী-কন্যাও কলকাতায় তাঁর কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। চণ্ডীচরণের ভগিনী যামিনী সেন লেডি ডাক্তার

হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কামিনীর ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের সদস্য কেদারনাথ রায়ের বিয়ে হয়। তাঁর লেখক ছদ্মনাম ব্যক্তিত্ব “জনৈক বঙ্গমহিলা”। এই নামে তিনি লেখা শুরু করেন। তাঁর কবিতা পড়ে বিমোহিত হয়ে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য কেদারনাথ রায় তাকে বিয়ে করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে কামিনী রায়ের স্বামীর অপঘাতে মৃত্যু হয়। যা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। স্বামীর অকাল মৃত্যুর বেদনা তাঁর কবিতায় প্রকাশ পায়।
পিতা চণ্ডীচরণ কন্যা কামিনী রায়ের প্রাথমিক শিক্ষার ভার নিজে গ্রহণ করেন। বার বৎসর বয়সে তাকে স্কুলে ভর্তি করে বোর্ডিংয়ে প্রেরণ করেন। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বেথুন স্কুল হতে এন্ট্রান্স (মাধ্যমিক) এবং ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এফএ বা ফার্স্ট আর্টস (উচ্চ মাধ্যমিক সমমানের) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। বেথুন কলেজ হতে তিনি ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের প্রথম নারী হিসাবে সংস্কৃত ভাষায় সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
ওই বছরই অর্থাৎ ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বেথুন কলেজের স্কুল বিভাগে শিক্ষিকার পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে তিনি ওই কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নারী শ্রম তদন্ত কমিশন (১৯২২-২৩) এর সদস্য ছিলেন।
মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লিখতেন। রচিত কবিতাগুলোতে জীবনের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনার সহজ-সরল ও সাবলীল প্রকাশ ঘটেছে। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র পনেরো বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ আলো ও ছায়া প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রথমে এতে গ্রন্থকর্ত্রী হিসেবে কামিনী রায়ের নাম প্রকাশিত হয়নি। গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তাঁর কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ: তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হলো: নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী

(১৮৯৭), গুঞ্জন (শিশুকাব্য, ১৯০৫), ধর্ম্মপুত্র (অনুবাদ, ১৯০৭), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোকসঙ্গীত (সনেট, ১৯১৪), অম্বা (নাটক, ১৯১৫), বালিকা শিক্ষার আদর্শ (১৯১৮), ঠাকুরমার চিঠি (১৯২৪), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবনপথে (সনেট, ১৯৩০)। অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মহাশ্বেতা ও পুণ্ডরীক নামের তার দুটি দীর্ঘ কবিতা রয়েছে। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিশুদের জন্য গুঞ্জন নামের একটি কবিতা সংগ্রহ ও প্রবন্ধ গ্রন্থ বালিকা শিক্ষার আদর্শ রচনা করেন। পাছে লোকে কিছু বলে এবং সুখ তাঁর দুটি বিখ্যাত কবিতা।
বাংলা সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের জন্য তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক (১৯২৯) লাভ করেন। তিনি ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩২-৩৩ খ্রিষ্টাব্দ মেয়াদে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি ছিলেন কামিনী রায়। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ শে সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।
দিন চলে যায় (“আলো ও ছায়া” কাব্যগ্রন্থ হতে)
একে একে একে হায়! দিনগুলি চলে যায়,
কালের প্রবাহ পরে প্রবাহ গড়ায়,
সাগরে বুদ্বুদ্ মত উন্মত্ত বাসনা যত
হৃদয়ের আশা শত হৃদয়ে মিলায়,
আর দিন চলে যায় ।
জীবনে আঁধার করি, কৃতান্ত সে লয় হরি
প্রাণাধিক প্রিয়জনে, কে নিবারে তায়?
শিথির হৃদয় নিয়ে, নর শূণ্যালয়ে গিয়ে,
জীবনের বোঝা লয় তুলিয়া মাথায়,
আর দিন চলে যায় ।
নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?—
এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?
যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে
কেবলি কি নর জনম লয়?—
কাঁদাইতে শুধু বিশ্বরচয়িতা
সৃজেন কি নরে এমন করে’?
মায়ার ছলনে উঠিতে পড়িতে
মানবজীবন অবনী ‘পরে?
বল্ ছিন্ন বীণে, বল উচ্চৈঃস্বরে,—
না,—না,—না,—মানবের তরে
আছে উচ্চ লক্ষ্য, সুখ উচ্চতর,
না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে।
কার্যক্ষেত্র ওই প্রশস্ত পড়িয়া,
সমর-অঙ্গন সংসার এই,
যাও বীরবেশে কর গিয়ে রণ ;
যে জিনিবে সুখ লভিবে সেই।
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ ;
“সুখ” “সুখ” করি কেঁদনা আর,
যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে,
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
গেছে যাক ভেঙে সুখের স্বপন
স্বপন অমন ভেঙেই থাকে,
গেছে যাক্ নিবে আলেয়ার আলো
গৃহে এস আর ঘুর’না পাকে।
যাতনা যাতনা কিসেরি যাতনা?
বিষাদ এতই কিসের তরে?
যদিই বা থাকে, যখন তখন
কি কাজ জানায়ে জগৎ ভ’রে?
লুকান বিষাদ আঁধার আমায়
মৃদুভাতি স্নিগ্ধ তারার মত,
সারাটি রজনী নীরবে নীরবে
ঢালে সুমধুর আলোক কত!
লুকান বিষাদ মানব-হৃদয়ে
গম্ভীর নৈশীথ শান্তির প্রায়,
দুরাশার ভেরী, নৈরাশ চীত্কার,
আকাঙ্ক্ষার রব ভাঙ্গে না তায়।
বিষাদ—বিষাদ—বিষাদ বলিয়ে
কেনই কাঁদিবে জীবন ভরে’?
মানবের মন এত কি অসার?
এতই সহজে নুইয়া পড়ে?
সকলের মুখ হাসি-ভরা দেখে
পারনা মুছিতে নয়ন-ধার?
পরহিত-ব্রতে পারনা রাখিতে
চাপিয়া আপন বিষাদ-ভার?
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে,
সকলের তরে সকলে আমরা,
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
পাছে লোকে কিছু বলে
করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-
পাছে লোকে কিছু বলে।
আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
পাছে লোকে কিছু বলে।
হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
সযতনে শুকায়ে রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
একটি স্নেহের কথা
প্রশমিতে পারে ব্যথা,-
চলে যাই উপেক্ষার ছলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
মহৎ উদ্দেশ্য যবে,
এক সাথে মিলে সবে,
পারি না মিলিতে সেই দলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
বিধাতা দেছেন প্রাণ
থাকি সদা ম্রিয়মাণ;
শক্তি মরে ভীতির কবলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
কত ভালবাসি
কামিনী রায়
জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-
“মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”
“কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়।
“এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।
“তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?”
মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।”
“তবু কতখানি, বল।”
“যতখানি ধরে
তোমার মায়ের বুকে।”
“নহে তার পরে?”
“তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে।”
“আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে!