ইউসুফ খান
এখনকার কলকাতা আসলে সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর- এ তিনটে গ্রাম জুড়ে তৈরি বলে ধরা হয়। সেটা বোধহয় ঠিক না। কলকাতা আড়ে-দীঘে এখন যা বাড় বেড়েছে তাতে তিন কেন তিরিশটা গ্রামও গিলে থাকতে পারে। সেসব অখ্যাত গ্রামের নাম এমন গুমনাম হয়ে গেছে যে তা উদ্ধার হবার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। শুধু একটা গ্রামনাম অন্য সবকটাকে গিলে নিয়ে আজকের মহানগর কলকাতা হয়েছে।
কলকাতাকে কোলকাতা কোলকেতা কোইলকাতা কালকাত্তা কাল্কুত্তা ক্যালকাটা নানা নামে ডাকা হয়। কিন্তু কোনটা যে আসল নাম তা খোদ ক্যালকাটান-ক্যালকেসিয়ানরাও জানে না। তাই কলকাতা নামের ব্যুৎপত্তি নিয়ে অনেক বিবাদ-বিপত্তি আছে। কলকাতার নামরহস্যর লোমহর্ষক নানা তত্ত্ব পাওয়া যায়। আপন মনের মাধুরী মিশায়ে অনেকে কলকাতা নামের উৎপত্তি নিয়ে অনেক গল্প বলেছেন। তার দুএকটা আবার উৎপত্তি না উৎপাত।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘কলিকাতা’ নামের ব্যুৎপত্তি নিয়ে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় লিখেছিলেন – ‘দেড় শত বৎসরের অধিক কাল ধরিয়া ভারতে ব্রিটিশরাজ্যের রাজধানী হইবার গৌরব ছিল যে নগরীর, সেই কলিকাতা-নগরীর নামের ব্যুৎপত্তি এখনও নির্ধারিত হইল না, ইহা বড় আশ্চর্যের বিষয়।’ এই প্রবন্ধে তিনি প্রচলিত কয়েকটা মতকে খারিজ করে দিয়ে নিজের একটা ব্যুৎপত্তি দেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে রাধারমণ মিত্র তাঁর কলিকাতা দর্পণ বইয়ে সুনীতিকুমারের ব্যুৎপত্তিটাকেও নস্যাৎ করে দেন। কিন্তু রাধারমণ মিত্র নিজে কোনও ব্যুৎপত্তি দিয়ে যাননি। ফলত, কলিকাতা নগরীর নামের ব্যুৎপত্তি এখনও নির্ধারিত হইল না।
আমি আমার খুচরো বিদ্যে ব্যুৎপত্তি দিয়ে কলকাতা নামের ব্যুৎপত্তির বিধান দেব। রাধারমণ মিত্র বেঁচে নেই এটাই যা বাঁচোয়া। হাতি ঘোড়া জলে তলিয়ে যেতে পারে, মশার তো সে ভয় নেই! মশা হেলায় জলেরে খেলায় জলেই পাড়ে ডিম। বইপত্র আর নেট ঘেঁটে কলকাতা নিয়ে অনেক কথা পাচ্ছি। সেগুলো একটু ঝালিয়ে নিয়ে তারপর আমি আমার কথা পাড়ব।
কবেকার কলকাতা: ১৪৯৫-৯৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে লেখা বিপ্রদাস পিপলাই এর মনসাবিজয় কাব্যে আছে কলকাতার কথা।
‘তাহার পূর্বকূল বাহি এড়ায়ে কলকাতা।
বেতোরে চাপায়ে ডিঙ্গা চাঁদ মহারথা॥’
অবশ্য পণ্ডিতরা প্রমাণ করে দিয়েছেন এটা কেউ পরে ঢুকিয়েছে। ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে লিখেছেন
‘ত্বরায় চলিল তরী তিলেক না রয়।
চিতপুর সালিখা এড়াইয়া যায়॥
কলিকাতা এড়াইল বেণিয়ার বালা।
বেতড়েতে উতরিল অবসান বেলা॥
বেতাই চণ্ডীকা পূজা কৈল সাবধানে।
ধনন্তগ্রাম থানা সাধু এড়াইল বামে॥’
এখানেও পণ্ডিতরা প্রমাণ করে দিয়েছেন এটাও পরে প্রক্ষিপ্ত। পুরনো কোনও পুঁথিতেই কলিকাতা কালীঘাট কোনওটারই উল্লেখ নেই। পরের দিকে ছাপা বইতে এসব কেউ গুঁজে দিয়েছে। কবিকঙ্কণের পরে লেখা দ্বিজমাধবাচার্যের চণ্ডীকাব্যে ধনপতি ও শ্রীমন্তের সমুদ্রযাত্রা বর্ণনা প্রসঙ্গে চিৎপুর কালীঘাট আছে কলিকাতা নেই।
১৫৯০-৯৬ খ্রিষ্টাব্দে লেখা আইন-ই-আকবরী বইয়েও কলকাতা আছে। তবে সে কলকাতার নানা পাঠভেদ আছে – কলকাতা কল্না কল্তা তল্পা। এই কলকাতা বা তলপা ছিল মোগলদের সাতগাঁ সরকারের একটা মহল, গ্রাম না। মহল গ্রামের চেয়ে অনেক বড়ো, এর বহুবচন মহাল। একটা মহলেই অনেকগুলো গ্রাম ঢুকে থাকে।
১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পদ্মাবতী কাব্য লেখেন আরাকানের রোসাঙ্গ রাজসভার কবি আলাওল। কলকাতার উল্লেখ আছে পদ্মাবতীতেও। ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে ভ্যান ডেন ব্রুকের মানচিত্রে কালীক্ষেত্রর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৬৭৬-৭৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত কৃষ্ণরামদাস রচিত কালিকামঙ্গল পুঁথিতে কলকাতার কথা আছে। ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপটেন হিথ একটা রিপোর্টে ক্যালকাটা কথাটা লিখেছেন। ১৭২৬-২৭ খ্রিষ্টাব্দে আলেকজান্ডার হ্যামিলটন ‘এ নিউ অ্যাকাউন্ট অফ দি ইস্ট ইন্ডিজ’ বইয়ে ‘ক্যালিকাটা’ কথাটা প্রথম ছাপার অক্ষরে লেখেন।
কোথাকার কলকাতা: গঙ্গাপাড়ের মহানগর কলকাতা ছাড়াও আরও কলকাতা পাওয়া গেছে। একটা হাওড়ার আমতায় দামোদরের ধারে গ্রাম কলকাতা। এই কলকাতার কাছাকাছি অন্য কোনও কলকাতা বা গঙ্গার ওপারের বড়ো শহর কলকাতার সঙ্গে গুলিয়ে যেতো বলে পাশের গ্রাম রসপুর এর নাম জুড়ে এই কলকাতাকে বলা হতো রসপুর-কলকাতা বা ছোটো কলকাতা। এখনও কলকাতা নামেই আছে গ্রামটা। আর একটা কলকাতা হচ্ছে ঢাকা জেলার লৌহজঙ্গ থানার অধীনে গ্রাম কলকাতা। মানে কলকাতা একটা জেনেরিক নাম যা একের বেশি গ্রামের হতে পারে। আমরা সেই জেনেসিসটা জানব।
১. কালীঘাট কালীক্ষেত্র কালীকোঠা: কালীঘাট কালীঘাটা হয়ে কলিকাতা বা কলকাতা হয়েছে এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব প্রচলিত মত। কিন্তু ঘাট থেকে কাতা হয়েছে এটা বলা সত্যিই ঘাট হচ্ছে। বাঙালি চীনেম্যান নয় যে তার জিভে ঘ হবে ক, কিংবা ট হবে ত। তাছাড়া কা এর উচ্চারণ কো হয়েছে এটাও মানা যায় না। কালীক্ষেত্র কালীকর্তা বা কালীকাত্তা হয়ে কলকাতা হয়েছে এটা আগের মতোই মত। তেমনি কালীঘাটের কালীমন্দির মানে কালীর কোঠা কালীকোঠা- কালীকোট্টা-কালীকোটা থেকে কলকাতা এসেছে এটাও একই সুতোয় গাঁথা মত। এই তিনটে মতেই মত দেয় এমন লোক অনেক। কিন্তু ভাষাতত্ত্বের কোনও নিয়মে কালীঘাট কালীক্ষেত্র কালীকোঠা থেকে কোলকাতা হয় না। আর সবচেয়ে বড়ো কথা চণ্ডীকাব্যে ‘কলিকাতা ও কালীঘাটের পৃথক পৃথক উল্লেখ আছে। এই উল্লেখ সুপরিচিত’ – সুনীতিকুমার। চাঁদ সদাগর সিংহল যাত্রার সময় কলিকাতার পাশ দিয়া গিয়া কালীঘাটে গিয়া কালিকার পূজা করেন। সুতরাং এই বহুমান্য থিওরি তিনটের একটাও ধোপে টেকে না।
২. কলি কাতা: কলকাতার ব্যুৎপত্তি নিয়ে সবচেয়ে ওজনদার মত দিয়েছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মূল বক্তব্য, ‘কলিকাতা একটি খাঁটি বাংলা শব্দ। ইহার অর্থ, ‘কলি’ বা কলিচুনের জন্য ‘কাতা’ বা শামুকপোড়া।’ ‘কলির বা চুনের ও কলিচুনের জন্য শামুকের আড়ত, এবং চুনের কারখানা হইতে ‘কলি-কাতা’ নাম।’, ‘কলি ও কাতা অর্থাৎ কলিচুন ও নারিকেল-দড়ি, এই দুই জিনিসের নাম হইতে ‘কলিকাতা’ নামের উদ্ভব…।’ এরকম আরও অনেক জড়ানো-মড়ানো কথা। কলকাতায় আগে শামুক বা ঝিনুক পুড়িয়ে চুন তৈরি করা হতো বলে এর নাম কলকাতা হয়েছে। এইসব কথা একে তো সুনীতিকুমার বলছেন তার ওপর আবার অনেক যুক্তি দিয়েছেন তাই একধারসে সবাই এটা মেনে নিয়েছে। এমনকি কলকাতা কর্পোরেশনও এটা মেনেছে। কিন্তু রাধারমণ মিত্র তাঁর কলিকাতা দর্পণ বইয়ে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের এই চুনকাম পুরো ধুয়ে দিয়েছেন। তিনি বইয়ের প্রথম ৩৯ পাতা ধরে লাইন বাই লাইন তুলে দেখিয়েছেন সুনীতিকুমারের চুনকামের প্রাইমারে প্রচুর পুট্টি। ফলে তিনি সুনীতিকুমারের সবকটা কথা ধরে ধরে কচুকাটা করতে পেরেছেন। একবার পড়েই দেখুন গবেষণার গভীরতা কাকে বলে।
৩. কোল কা হাতা: এটা সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ই হালকা করে ভাসিয়ে দিয়েছেন। কোলি কা হাতা বা কোল কা হাতা। মানে কোল জাতির গণ্ডি বা দেশ। সেখান থেকেই কলিকাতা বা কোলকাতা। এছাড়াও উৎপত্তির আরও কিছু উৎপটাং গল্প আছে। সেসবের পেছনের চিন্তা খুবই চমৎকারা।
৪. কাল কাটা: কলকাতার কোনও মাঠে এক হিন্দুস্তানি ঘাসুড়ে ঘাস কাটছিল। তাকে এক ইংরেজ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, জায়গাটার নাম কী? ঘেসেড়া ইংরেজি জানত না। তাই সে ভাবল সাহেব বোধহয় কবে ঘাস কাটা হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করছে। তাই সে জবাব দিল, ‘কাল কাটা’ অর্থাত্ গতকাল কাটা হয়েছে। সাহেব ভাবল জায়গাটার নামই ‘কালকাটা’ আর সেই থেকে নাম হয়ে গেল ক্যালকাটা কলকাতা। খুবই উচ্চস্তরের গ্রাস সেবন না করলে এই চিন্তা মাথায় আনা বা মাথায় নেওয়া সম্ভব নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই গল্প ছাপার অক্ষরেও বহু জায়গায় আছে। কোনও গভীর বিশ্বাস থেকেই নিশ্চয় ছেপেছে। গ্রাস সর্বগ্রাসী!
৫. খাল কাটা: রেভারেন্ড জেমস লঙ বলেছেন খাল-কাটা থেকে ক্যালকাটা কলকাতা হয়েছে। মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ থেকে কলকাতাকে বাঁচানোর জন্য যে মারহাট্টা ডিচ মানে মারাঠা খাল কাটা হয়েছিল সেটা থেকেই না কি কলকাতার নাম কলকাতা।কিন্তু এই খাল কাটা হয় ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে আর কলকাতা নাম পাওয়া যাচ্ছে তার দুশো বছর আগে থেকে। রামের আগেই রামায়ণ?
৬. কিলকিলা কিলা কিলা: বৌদ্ধ পরিব্রাজক কবিরাম ‘দিগ্বিজয় প্রকাশ’ নামে একটা বই লেখেন। তাঁর পরিভ্রমণের পথের বর্ণনায় তিনি কিলকিলা প্রদেশের কথা লিখেছেন। মাহেশ হরিপাল সিঙ্গুর ত্রিবেণী চাকদা ডুমুরদা সপ্তগ্রাম জগদ্দল শিবপুর বালী ভদ্রেশ্বর শ্রীরামপুর বাঁশবেড়িয়া খলসান গোবিন্দপুর ভাটপাড়া শিয়ালদহ প্রভৃতি স্থান এই কিলকিলা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। তাই অনেকে ভাবে এই কিলকিলা-ই হয়েছে কলকাতা। রাজা রাধাকান্ত দেব শেষ জীবনটা বৃন্দাবনে কাটিয়েছেন। সেখানে বসে তিনি স্তবের একটা বই লেখেন পদাবলী নামে। পদাবলীর অভিধান পত্রিকায় তিনি কলকাতা নামের জায়গায় কিলকিলা লিখেছিলেন। কিন্তু কিলকিলা একটা প্রদেশ, কলকাতা একটা গ্রাম। আর একটা মত – কিলা কিলা মানে কেল্লা থেকে কলকাতা। কিন্তু কেল্লা তৈরির আগে থেকেই যে কলকাতা কলকাতা। শ্রীপান্থ-র কলকাতা বইয়ে আরও কিছু গল্প আছে –
৭. কলির শহর: ক্রোধ-এর ঔরসে তার নিজের বোন হিংসা-র গর্ভে কলির জন্ম। কলিও নিজের বোন দুরুক্তি-কে বিয়ে করে। কলকাতা হচ্ছে পুরাণের এই কলির শহর তাই এর নাম কলিকাতা। কিন্তু এই অনাচারী অপদেবের নাম কেন এই গ্রামের নামের সঙ্গে যুক্ত হবে তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। কালীর শহর কলকাতা হতে পারত।
৮. কালী থা: কালি গৈয়ে কলকাত্তা কি, যিনকে পূজা ফিরিঙ্গি কিন বাঙ্গালী কো মুলুক ধনদৌলত দখল করলিন॥ কালীক্ষেত্র থেকে কালীকে কাপালিকরা নিয়ে পালায় কালীঘাটের বনে। কালীঘাটে যাবার আগে কালী এখানে ছিলেন তাই এটা কালী-থা। কালী-থা থেকে কলকাত্তা।
৯. কালিকটা: পোর্তুগিজদের শহর কালিকটের জিনিস ইউরোপে বিখ্যাত, তাই সুতানুটির জিনিসকে কালিকটের মাল বলে চালাতে ইংরেজরা সুতানুটির নাম বদলে কালিকটা করে দেয়। কালিকটা থেকে কলিকাতা।
১০. গল গাথা: ডাচ ভাষায় গল মানে মড়ার খুলি। গলগাথা মানে মড়ার খুলি ভরা দেশ। গলগাথা থেকে কলকাতা।
সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন – যে অসুখের একশ রকমের ওষুধ পাওয়া যায়, আসলে সে অসুখের কোনও ওষুধ নেই। পরের পোস্টে আমি আমার ওষুধের দোকান খুলব।
উৎস: কলকাতা নামের ব্যুৎপত্তি ১, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)।
কলকাতা, ২০২০ সেপ্টেম্বর ০৩