কাজাখস্তান (Kazakhstan) : ইতিহাস ও নামকরণ

কীভাবে হলো দেশের নাম (ইউরোপ)

ড. মোহাম্মদ আমীন

কাজাখস্তান (Kazakhstan)

কাজাখস্তান শব্দের অর্থ কাজাখদের ভূমি। কাজাখ ও  -স্তান শব্দ দুটোর সমন্বয়ে কাজাখাস্তান নামটি গঠিত হয়েছে।  স্থানীয় মিশ্র ভাষার শব্দ কাজাখ (Qazaq) অর্থ মুক্ত বা স্বাধীন এবং পারসি -স্তান (-stan) শব্দের অর্থ ভূমি বা জমি বা দেশ। সুতরাং কাজখস্তান শব্দের অর্থ মুক্তভূমি বা মুক্তদে। কাজাখাস্তানের লোকজন ছিল স্বাধীনচেতা। অধিকন্তু দেশটি তখন দীর্ঘকাল স্বাধীন ছিল। তাই এর নাম রাখা হয় কাজাখাস্তান। এ দেশের মানচিত্র দেখলে মনে হবে, একজন অদ্ভুদ টুপি-পরা এক লোক ইউরোপের দিকে বৃদ্ধাঙুল উপরে করে ইউরোপের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

আবার অনেকে মনে করেন, প্রাচীন পারসিয়ান ভাষা স্তান শব্দের অর্থ ল্যান্ড বা ভূমি বা জাতি এবং খাজাক অর্থ ওয়ান্ডারার (wanderer), অ্যাডভেন্সারার (adventurer)) ও আউট ল (outlaw)ি। সুতরাং কাজাখাস্তান মানে ল্যান্ড অব ওয়ান্ডারারস (Land of the Wanderers)। কাজাখাস্তানে ১২০টি জাতিগোষ্ঠীভুক্ত লোক বসবাস করে। প্রাচীন খাজাক জাতি পৃথিবীর প্রথম জাতি যারা ঘোড়াকে গৃহপালিত পশু হিসাবে পোষ মানায় এবং ঘোড়ায়-চড়া প্রচলন করে।

কাজাখাস্তানের আয়তন ২,৭২৪,৯০০ বর্গ কিলোমিটার বা ১,০৫২,০৮৫ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ ১.৭%। কাজাখাস্তানের আয়তন এত বিশাল যে, এর একপ্রান্ত হতে অন্য প্রান্তের দূরত্ব অনুমান লন্ডন হতে ইস্তাম্বুলের দূরত্বের সমান। বলকাশ হ্রদ পৃথিবীর বৃহত্তম হ্রদ। এর একাংশ স্বাদু পানি ও অন্য অংশে লবণাক্ত পানি রয়েছে। কাজাখাস্তানের মোট জনসংখ্যা ১৭,৫৬৩,৩০০ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ৫.৯৪। আয়তনের দিক হতে কাজাখাস্তান পৃথিবীর নবম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যার দিক হতে ৬২-তম এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় ২২৭-তম। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে জিডিপি (পিপিপি) ৪২০.৬২৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার (৪৩-তম) এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ২৪,১৪৩ ইউএস ডলার (৫০-তম)। অন্যদিকে জিডিপি নমিনাল ২২৫.৬১৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার (৫০-তম) এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ১২,৯৫০ ইউএস ডলার (৫৪-তম)। গিনি ২৮.৮ এবং এইচডিআই ০.৭৫৭। মুদ্রার নাম টেঞ্জ (Tenge)। রাজধানী আস্তানা (Astana)। কাজাখাস্তান পৃথিবীর বৃহত্তম স্থলবেষ্ঠিত দেশ।

কাজাগ একটি তার্কিস ভাষা। এর বহু শব্দ রাশিয়ান, আরবি, মোঙ্গল, পর্সিয়ান ও তার্কিক শব্দ রয়েছে। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত এ ভাষার নিজস্ব কোনো লিখিত রূপ ছিল না। আরবি স্ক্রিপ্টে লেখা হতো। ইতিহাসখ্যাত রশিয়ান বীর তৈমুর-ই লঙ ১৪শ শতকে পুরো কাজাখাস্তান শাসন করেছেন। ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে  ঘোড়া হতে পড়ে তিনি  খোড়া হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, যুদ্ধে তিনি যুদ্ধে তার দুটি আঙুলও হারিয়েছিলেন। স্ট্যালিন কাজাখাস্তানে অনেকগুলো বন্দিশিবির নির্মাণ করেছিলেন। এ সব কারাগারে লক্ষ লক্ষ লোককে অত্যাচার করা হয়েছে। মেরে ফেলা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে  সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক আলেকজান্ডার সলজেনিৎসিনকেও স্টালিনের সমালোচনা করায় এখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল।

কাজাখস্তান এশিয়ার একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এটি বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং সবচেয়ে বড় স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। এর উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে গণচীন, দক্ষিণে কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, ও তুর্কমেনিস্তান এবং পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর ও রাশিয়া। কাস্পিয়ান সাগর পৃথিবীর বৃহত্তম স্থলবন্দি জলাধার। এর আয়তন ৩ লক্ষ ৭১ হাজার বর্গ কিলোমিটার। কাস্পিয়ান সাগর স্টারগন (sturgeon) নামের মূল্যবান মাছে সমৃদ্ধ।

কাজাখস্তান প্রায় পুরোটাই এশিয়া মহাদেশে অবস্থিত। তবে দেশটির কিয়দংশ উরাল নদীর পশ্চিমে ইউরোপ মহাদেশে পড়েছে। দেশের উত্তর অংশে অবস্থিত আস্তানা দেশটির রাজধানী। কাজাখাস্তানের জাতীয় পতাকায় সূর্যের ৩২টি রশ্মি রয়েছে। এগুলো উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসাবে বিবেচিত। পূর্ব কাজখাস্তানের পাহাড়ে বরফ চিতা বাস করে। তারা লাজুক এবং ৬৮ কেজি পর্যন্ত ওজন হয়। সাহস, স্বাধীনচেতা ও বুদ্ধিমান হিসাবে বরফ-চিতা পরিচিত। এটিই কাজাখাস্তানের জাতীয় প্রতীক।

অনেক কাজাখ নিজেদের মঙ্গোল নেতা চেঙ্গিস খানের Genghis Khan) উত্তরসুরী মনে করেন। যিনি ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে  পৃথিবীর বৃহত্তম সাম্রাজ্য ঘটন করেছিলেন।  চেঙ্গিস খানের দ্বিতীয় পুত্র চাগতাই চেঙ্গিস খান ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে  কাজাখাস্তান দখল করে নিয়েছিলেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ আগস্ট কাজাখাস্তানের নারীরা ভোটাধিকার লাভ করে। উল্লেখ্য ওই একই দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরাও ভোটাধিকার লাভ করেছিল।

কাজাখ ভাষা কাজাখস্তানের সরকারী ভাষা। কাজাখ নামের তুর্কীয় জাতি এখানকার প্রধান জনগোষ্ঠী। ১৯২২ থেকে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কাজাখস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে ১৫ টি প্রজাতন্ত্র হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে : রাশিয়া, ইউক্রেন, জর্জিয়া, বেলরুশিয়া, উজবেকিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইযান, কাজাখাস্তান, কিরগিজস্তান, মলদোবা, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর এটি স্বাধীনতা লাভ করে। তবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার পর থেকে দেশটিতে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা বিদ্যমান। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ আগস্ট নতুন সংবিধান গৃহীত হয়। যাতে রাষ্ট্রপতিকে দেশ শাসনের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়।

কাজাখাস্তানের রাজনীতি একটি রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় পরিচালিত হয়। রাষ্ট্রপতি হলেন রাষ্ট্রের প্রধান। সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত হন।কাজাখাস্তানের ৭০% মুসলিম, ২৬% খ্রিস্টান, ০.১% বু্ড্ডিস্ট এবং ইহুদি ও অন্যান্য ০.৪% এবং ধর্মপরিচয়হীন ৩.৫%। সাংবিধানিকভাবে এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।

ঘোড়া কাজখাস্তানের ঐতিহ্যবাহী পশু। মধ্য এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে তুকুমেনিস্তানের বাইরে কাজাখাস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আকাল-টেকে ঘোড়া উৎপাদন কর হচ্ছে। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম গৃহপালিত পশুর অন্যতম। ৩০০০ বছর আগে এ ঘোড়া প্রথম উৎপাদন করা হয়। যা পারস্য রাজা প্রথম দারিউস থেকে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, চেঙ্গিস খান প্রমূখ ব্যবহার করেছে। এ ঘোড়া তাদের অসাধাণ সহনশীলতা, শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার জন্য বিখ্যাত ছিল। ঘোড়ার মাংশ কাজাখাস্তানে এতই প্রিয় যে, ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে  লন্ডন অলিম্পিকে অ্যাথলেটসরা তাদের সঙ্গে ঘোড়ার মাংস নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। খাজাকরা মাংস পরিবেশনে কিছু প্রতিকী প্রথা অনুসরন করে। যেমন: প্রাঞ্জলভাষী হওয়ার জন্য জিহ্বার মাংস এবং শিশুদের দেওয়া হয় কানের মাংস। যাতে তারা কানে ভালো শুনতে পায়। দ্রুত দৌড়ানোর  যোগ্যতা অর্জনের জন্য দেওয়া হয় পায়ের মাংস।

২০ মিলিয়ন বছর আগে প্রথম কাজাখাস্তানের প্রাক্তন রাজধানী আলমাটি (Almaty) এলাকায় আপেল বৃক্ষের চাষ করা হয়। আলমাটি শব্দের অর্থ (a place of apples)প্যালেস অব আপলে বা আপেলের জমি। প্রথম জন্মানো হয়। কাজাখাস্তানের বিভিন্ন অংশে এখনও বন্য আপেল গাছ দেখা যায়।

কাজাখাস্তানে বেশ্যাবৃত্তি বা প্রস্টিটিউশন খুব জনপ্রিয়। কাজাখ নিউজপেপারসমূহে যৌনকর্মীদের ম্যাসেজ গার্ল হিসাবে উল্লেখ করে তাদের সম্মানে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে থাকে।  যৌনকর্মী রপ্তানিতে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে  কাজাখাস্তান বিশ্বের  প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। কাজাখাস্তানে ২৭ হাজার মনুমেন্ট রয়েছে। কাজাখাস্তানে দাপ্তরিকভাবে তিনটি নববর্ষ পালন করা হয়। প্রথমটি গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা অনুযায়ী জানুয়ারির প্রথম তারিখ, দ্বিতীয়টি বসন্তকালে মার্চের ২২ তারিখ এবং তৃতীয়টি সোভিয়েত সময় অনুসারে ১৪ জানুয়ারি, যা প্রাচীন নববর্ষ নামে পরিচিত।

কাজাখাস্তানের বাইকনুর কসমোড্রোম সোভিয়েত ও রাশিয়ান মহাকাশানযানের প্রধান উৎক্ষেপণ কেন্দ্র। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ও সবচেয়ে বেশি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন উৎক্ষেপণ কেন্দ্র। পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে  এখান থেকে মহাশূণ্যের কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছিল। পৃথিবীর প্রথম নভোচারী ইউরি গ্র্যাগরিন এ মহাকাশযান কেন্দ্র হতেই মহাকাশে গমন করেছিলেন। রাশিয়ান স্পেস সেন্টারের কয়েক কিলোমিটার দূরে বাইকনুর নামের একটি স্থান ছিল। প্রধান মহাকাশযান উৎক্ষেপন কেন্দ্রের অবস্থান নিয়ে সংশয় সৃষ্টি ও নিরাপত্তার জন্য কাজাখাস্তানের উৎক্ষেপন কেন্দ্রটির নাম বাইকনুর রাখা হয়েছিল। উত্তর-পূর্ব কাজাখাস্তানের সেমিপালাটিন্সক নামক স্থানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৫০০ আনবিক বোমার পরীক্ষা চালিয়েছিল। যার শক্তি হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত আনবিক বোমার ২০ হাজার গুণ।

কাজাখাস্তানের টেনজিগ (Tengiz) তেল ক্ষেত্র পৃথিবীর বৃহত্তম তেলক্ষেত্রে অন্যতম একটি। এর প্রস্থ ১৯ কিলোমিটার এবং দৈঘ্য ২১ কিলোমিটার। আয়তন ২,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। এটি বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসের বৃহত্তম আবিষ্কার। যা কাজখাস্তানের অর্থনীতিকে আমুল পাল্টে দেয়। ফলে, কাজাখাস্তান প্রথম প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, যে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে  মেয়াদপূর্তির ৭ বছর আগে আইএমএফ-কে ঋণের অর্থ সম্পূণর্  পরিশোধ করে দেয়। আর একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য হচ্ছে, ম্যান্ডালিভের টেবিলে (Mendeleev’s table) নির্দেশিত ১১০টি রাসায়নিক উপাদানের ৯৯টিই সনাক্ত করা হয়েছে কাজাখাস্তানে।

কাজাখাস্তান বিশ্ব ঐতিহ্য ও আধুনিকতায় সমৃদ্ধ একটি অপূর্ব দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যও মনোহরী। তবে সাবাধান, খাজকরা eat বললে কিন্তু খাও বুঝবেন না। কারণ খাজাক বাসায় dog এর উচ্চারণ eat ।


এস্তোনিয়া (Estonia) : ইতিহাস ও নামকরণ

ফিনল্যান্ড (Finland) : ইতিহাস ও নামকরণ

ফ্রান্স (France) : ইতিহাস ও নামকরণ

জর্জিয়া (Georgia) : ইতিহাস ও নামকরণ

জার্মানি (Germany) : ইতিহাস ও নামকরণ

গ্রিস (Greece) : ইতিহাস ও নামকরণ

হাঙ্গেরি (Hungary) : ইতিহাস ও নামকরণ

আইসল্যান্ড (Iceland) : ইতিহাস ও নামকরণ

আয়ারল্যান্ড (Irelan) : ইতিহাস ও নামকরণ

ইতালি (Italy) : ইতিহাস ও নামকরণ

সূত্র:  কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।

সাধারণ জ্ঞান সমগ্র

Knowledge Link

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক

Language
error: Content is protected !!