কাতার (Qatar) : ইতিহাস ও নামকরণ

কীভাবে হলো দেশের নাম (এশিয়া)

ড. মোহাম্মদ আমীন

কাতার (Qatar)

কাতারা (Qatara) শব্দ হতে কাতার শব্দের উৎপত্তি। আজ থেকে প্রায় ৭৫০০ বছর আগে জুবারা (Zubara) নামক এক রাজ্য ছিল। সে রাজ্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহরের নাম ছিল কাতারি (Qatari)। এটি প্রাচীন মেসোপোটামিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। তাইগ্রিস ও ইউপ্রেতিস নদীর কোলে অবস্থিত এ ভূখণ্ডটি ভৌগোলিক অবস্থার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সামুদ্রিক যোগাযোগের দ্রুত বিস্তৃতির কারণে অল্পসময়ের মধ্যে আরব উপদ্বীপের সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়। তাই প্রাচীনকার থেকে কাতারি ছিল বিখ্যাত। এ কাতারি শহর থেকে কাতারি নামের উৎপত্তি। টলেমির আরব বিশ্ব মানচিত্রে কাতারা নামটি প্রথম পরিচিতি পায়। বিংশ শতকের প্রথম দিকে ইংরেজভাষীরা Qatar শব্দকে Cutter হিসেবে উচ্চারণ করত। তবে এখন, কাতার শব্দের প্রচলিত ইংরেজি উচ্চারণ Kuh-tahr। রোমান লেখক প্লিনি দ্যা এল্ডার বলেছেন, প্রথম শতকের মধ্যভাগে আরব উপদ্বীপের এ অঞ্চলে কাতারেরি (Catharrei) নামের এক প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী বসবাস শুরু করে। তাই অনেকে মনে করেন, এ জনগোষ্ঠীর নাম হতে কাতারি নামের উৎপত্তি এবং কাতারি নাম হতে কাতার নামের উপত্তি।

কাতারিরা তাদের দেশের নাম ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। অথচ পাশে বসা মেয়ে দেখার জন্য মাথাকে ৩৬০ ডিগ্র ঘোরাতে পারে। দেশের নাম উচ্চারণ নিয়ে কাতারিদের কোনো মাথাব্যথা নেই। অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের মতো ভোগই তাদের ধ্যানজ্ঞান। দেশের নাম উচ্চারণে কাতারিরা ব্যক্তিবিশেষে যে শব্দ উচ্চারণ করে তা হচ্ছে : কু-তার, কা-তার, কা-তর, কাতারাহ্ প্রভৃতি। আঞ্চলিক আরবীয় উচ্চারণে তা অনেকটা গিটার (guitar) এর মতে শোনায়। এজন্য অনেকে বলেন, প্রাচীনকালে গিটার শব্দের ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে কাতার নামের উৎপত্তি। কাতারের রাজধানী দোহা। কাতারিরা বলে আদ দাওহা (Ad Dawha)। সেন্টার ফর জিওগ্র্যাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম অনুযায়ী এর অর্থ গোলাকার (roundness)।

কাতারের আয়তন ১১,৫৮৬ বর্গকিলোমিটার বা ৪,৪৬৭ বর্গমাইল। তন্মধ্যে কোনো জলভাগ নেই বললেই চলে। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে কাতারের জনসংখ্যা ২১,৫৫,৪৪৬ জন। প্রতি বর্গকিলোমিটার জনসংখ্যা ১৭৬। আয়তনের দিক হতে কাতার পৃথিবীর ১৬৪-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যার দিক হতে ১৪২-তম। আবার জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় কাতার পৃথিবীর ৭৬-তম জনবহুল দেশ। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর কাতার স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং একই বছর ৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্য হতে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ডিসেম্বর কাতার জাতীয় দিবস প্রতিষ্ঠিত হয়।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, কাতারের জিডিপি (পিপিপি) ২৯৮.৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার (৪৯-তম), সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ১,৪৫,৮৯৪ ইউএস ডলার (প্রথম)। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ২১৩.৭৮৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ১,০২,৭৮৫ ইউএস ডলার (প্রথম বা দ্বিতীয়)। মুদ্রার নাম রিয়াল।

কাতার অত্যন্ত ধনীদেশ। অনেকের মতে এটি পৃথিবীর প্রথম ধনাঢ্য দেশ। অনেকের মতে, প্রথম নয় তবে দ্বিতীয়। এরা কত ধনী ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের একটা হিসাব থেকে বুঝা যায়। যদি আমেরিকার জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ১০০ ধরা হয়, তবে যুক্তরাজ্যের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ৭৫.৬ কিন্তু কাতারের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ১৮৭.১। ২০০০-২০১০ খ্রিষ্টাব্দে চায়নার আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৫% কিন্তু কাতারের আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২.৯%। এটি আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধিতে পৃথিবীর চতুর্থ কিন্তু উন্নত দেশসমুহের প্রবৃদ্ধিতে প্রথম।

কাতার পারস্য উপসাগরের একটি দেশ। এটি আরব উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল থেকে উত্তর দিকে প্রসারিত কাতার উপদ্বীপে অবস্থিত। এর দক্ষিণে সৌদি আরব, এবং পশ্চিমে বাহরাইন অবস্থিত। আরব উপদ্বীপের মত কাতারও একটি উত্তপ্ত ও শুষ্ক মরু এলাকা। এখানে ভূ-পৃষ্ঠে কোনো জলাশয় নেই এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যাও যৎসামান্য। বেশির ভাগ লোক শহরে, বিশেষত রাজধানী দোহা শহরে বাস করে।

দেশটিতে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুদ আছে। খনিজ তেল আবিষ্কারের পূর্বে এটি ছিল অন্যান্য আরবীয় মুসলিম দেশের ন্যায় মিসকিন রাষ্ট্র। ১৯শ শতকের শেষভাগ থেকে আল-থানি গোত্রের লোকেরা কাতার অঞ্চলটিকে আমিরাত হিসাবে শাসন করে আসছে। বিংশ শতকের শুরুর দিকে দেশটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। কাতার পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে রাউন্ডএবাউটস (Roundabouts) আসলে রাউন্ড নয়। ম্যাকডোনাল্ডসের খাদ্য কাতারে অত্যন্ত দামি। গাড়ির তেলের ট্যাংক ভর্তি করতে যত খরচ হবে, কাতারে ম্যাকডোনাল্ডে একবার খেতে হলে তার চেয়ে বেশি খরচ হয়।

কাতারে অ্যালকোহল কিনতে হলে নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার নিকট হতে আয়ের সনদপত্র নিতে হয়। অথচ এখানে শুকরের মাংশ দিয়ে তৈরি দ্রব্যাদি বেশ সহজলভ্য এবং এটি খাওয়ার জন্য কোনো সনদ নিতে হয় না।। অ্যালকোহল নিষিদ্ধ হলেও কাতার এয়ারওয়েজের যাত্রীদের প্রচুর অ্যালকোহল পান করতে দেওয়া হয়। কাতার এয়ারওয়েজ থেকে অ্যালকোহল ক্রয় করা যায় কিন্তু অ্যালকোহল নিয়ে কাতারে ঢুকার অনুমতি পাওয়া যায় না। অবশ্য পেটে করে নিয়ে গেলে অসুবিধা নেই। অর্থের জন্য কী না করতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মতো কাতারেও মানবাধিকার অত্যন্ত সীমিত। এখানে বাকস্বাধীনতা নেই বললেই চলে। সংবিধান অনুযায়ী সুলতানের সমালোচনা করা নিষিদ্ধ। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানে বাকস্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হলেও, সুলতানের পাগলাটে ও লোভাতুর কর্মকা-ের সামান্য সমালোচনা করায় কবি মুহাম্মদ ইবনে আর দি আর আযমিকে আজীবন কারাদ-ে দ-িত করা হয়। পরে অবশ্য তা কমিয়ে ১৫ বছর করা হয়।

সুলতান কত বিলাসী, অপরিনামদর্শী ও স্বেচ্ছাচারী তা একটি ঘটনা দিয়ে প্রমাণ করা যায়, কয়েক বছর আগে কাতারের বুড়ো আমির শেখা হামান ৩৭.৪ মিলিয়ন ডলার দিয়ে লন্ডনের পার্ক লেনে ডুডলি হাউজ ক্রয় করেন। ক্রয়ের পর বাড়িটি সংস্কার করার জন্য ওই বুড়ো ৭৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি। সংস্কারকদের বলেছিল, আরও খরচ করতে। কয়েক বছর পর তেল এর মওজুদ শেষ হলে বিংশ শতকের মতো আবারও তারা নির্ঘাত মিসকিন হয়ে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হবে।


নেপাল (Nepal) : ইতিহাস ও নামকরণ

নর্থ কোরিয়া ( North Korea) : ইতিহাস ও নামকরণ

ওমান (Oman) : ইতিহাস ও নামকরণ

পাকিস্তান (Pakistan) : ইতিহাস ও নামকরণ

প্যালেস্টাইন (Palestine) : ইতিহাস ও নামকরণ

ফিলিপিনস (Philippines) : ইতিহাস ও নামকরণ

সূত্র:  কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।

Language
error: Content is protected !!