ড. মোহাম্মদ আমীন
‘কালাপাহাড়’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশাল ও ভয়ংকর প্রকৃতির লোক, প্রচলিত সংস্কার বা রীতিনীতি যিনি গ্রাহ্য করেন না, বিদ্রোহী। গৌড়ের সুলতান সুলায়মান কররানির সেনাপতি কালাপাহাড়-এর নাম থেকে কালাপাহাড় কথার উদ্ভব।ইতিহাসে তিনি প্রবল হিন্দুবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত। কৃষ্ণ বা কালো চামড়ার অধিকারী রাজুর শরীর ছিল পাহাড়ের মতো বিশাল। দূর থেকে দেখলে মনে হতো কালো পাহাড়। তাই তাঁর নাম হয় কালাপাহাড়।

কালাপাহাড় মনে করতেন, হিন্দুদের দেবমন্দির কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। কথিত হয়, পূর্বে আসাম, দক্ষিণে উড়িষ্যা ও পশ্চিমে কাশী পর্যন্ত কোনো দেবমন্দির কালা পাহাড়ের ধ্বংসাত্মক আক্রমণ হতে রেহাই পায়নি। এ ঘটনা থেকে যে ব্যক্তি প্রচলিত প্রথা বা বিশ্বাসকে ধ্বংস করে তাকে কালাপাহাড় বলা শুরু হয়। আসামের অনেক অঞ্চলে তিনি ‘কালযবন’ নামেও পরিচিত।
কালাপাহাড়(১৫৩৪-১৫৮৩ খ্রি. ) ছিলেন কররানি রাজবংশের সেনাপতি। তাঁর বাড়ি ছিল অধুনা বাংলাদেশের নওগাঁর (নিয়ামতপুর ) বীরজাওন গ্রামে। তাঁর আসল নাম রাজীবলোচন রায়। ডাকনাম রাজু।তিনি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন এবং নিয়মিত বিষ্ণু পূজা করতেন।তিনি বিদ্বান ও বুদ্ধিমান ছিলেন। রাজুর পিতার নাম ছিল নয়ানচাঁদ রায়। নবাব সুলায়মান খান কররানির কন্যা দুলারি বিবি তাঁর প্রেমে পড়েন। ইসলাম ধর্ম অনুসারে সুলায়মানের কন্যার সঙ্গে রাজুর বিবাহ হয়। বিয়ের পর তিনি প্রধান সেনাপতি পদে উন্নীত হন।
মুসলমান কন্যা বিবাহ করায় বর্ণবাদী হিন্দু সমাজ রাজুকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। মায়ের অনুরোধে রাজু বাংলার হিন্দু ধর্মগুরুদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইলে তারা বিধান দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর তিনি পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্তের সংকল্প করেন। কিন্তু পুরীর ধর্মগুরুরা তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। এ কারণে রাজু মর্মাহত হন এবং প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এ কারণে প্রতিশোধস্পৃহায় অন্ধ হয়ে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ‘মহম্মদ পরমালি’ নাম ধারণ করেন। হিন্দুরা তখন থেকেই তাঁকে কালাপাহাড় ডাকতে শুরু করে।
১৫৬৭-৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কালাপাহাড় উড়িষ্যা ও নিকবর্তী অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরগুলো ধ্বংস করে দেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করেন এবং মন্দিরের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। কালাপাহাড় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে নিয়ে হুগলি নদীর তীরে আগুনে পুড়িয়ে দেন। মন্দির ধ্বংসের ঘটনা উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না।কররানিদের কোচবিহার আক্রমণকালে কালাপাহাড় আসামের কামাখ্যা মন্দির-সহ আরো কিছু মন্দির ধ্বংস করেন।
বঙ্গদেশ ও বিহারে আকবরের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ হয় কালাপাহাড় তাতে যোগদান করেন। অনুমান করা হয় তিনি এই যুদ্ধে নিহত হন (১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলের মধ্যভাগে ) । কালাপাহাড়ের মৃত্যু হলে তাঁকে উড়িষ্যার সম্বলপুরে মহানদীর তীরে কোনো এক স্থানে সমাধিস্থ করা হয়। সম্বলেশ্বর কলেজ বিল্ডিঙের গায়ে অসংখ্য সমাধি দেখে অনুমান করা হয় এগুলি কালাপাহাড়ের সহযোদ্ধাদের। এ ভেবে একদল উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী (ভারতীয় পত্রপত্রিকা ও সরকারের ঘোষণামতে ) ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে তা ধ্বংস করে দেয়।
নজরুল লিখেছেন:
কোথায় চেঙ্গিজ, গজনি মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙ্গে ফেল অই ভজনালয়ের তালা দেওয়া দ্বার।
উৎস: পৌরাণিক শব্দের উৎসকথন ও বিবর্তন অভিধান, ড. মোহাম্মদ আমীন।
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
তিনে দুয়ে দশ: শেষ পর্ব ও সমগ্র শুবাচ লিংক
এই পোস্টের ওয়েব লিংক: কিছু প্রয়োজনীয় পোস্ট