মহাপ্রতিভাধর কবি নজরুলের কালীসাধনা
প্রমিতা দাশ লাবণী
জীবদ্দশায়, বিশেষ করে সাহিত্যকর্মপ্রসারের স্বর্ণসময়ে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত ও প্রতিভাবান কবি।তিনি প্রায় ৪,২০০ গান রচনা করেছেন। যার মধ্যে অনেকগুলো গান সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। পৃথিবীর কোনো ভাষায় একক হাতে এত বেশি সংখ্যক গান রচনার নজির নেই। এসকল গানের অধিকাংশই নজরুল নিজেই সুরারোপ করেছেন।গানে নজরুলের জনপ্রিয়তার সূচনার কারণ শ্যামাসংগীত। তবে তিনি কেবল হিন্দুদের ভালোবেসে শ্যামাসংগীত লিখেননি, শ্যামাসংগীত লিখিছিলেন শ্যামার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে। মুসলমানদের মধ্যে নজরুলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো অভিযোগের কারণ ছিল– শ্যামাসংগীত রচনা।
রবীন্দ্রনাথ কয়টি নাতে রসুল বা ইসলামি সংগীত রচনা করেছেন? একটাও না, অথচ নজরুল প্রায় আটশ শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন, ইসলামি সংগীত রচনা করেছেন কমবেশি একশ। এক সময় পূর্ববঙ্গের বেতারে নজরুলের শ্যামাসংগীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। মুসলিম হওয়ার কারণে হিন্দুদের একটা শ্রেণি নজরুলকে বিজাতি মনে করত। অন্যদিকে হিন্দু ধর্মের প্রতি অতি আগ্রহ এবং কালীভক্তির জন্য একশ্রেণির মুসলমানও নজরুলকে কাফের ঘোষণা করেছিল। কাফের ঘোষণা করায় ক্ষুব্ধ-নজরুল ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় লিখেছিলেন–
‘‘মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘মোল্লারা ক’ন হাত নেড়ে,
দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!’’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পুরো ভারতবর্ষ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত, চারদিকে উদ্দীপনা। শক্তির প্রয়োগ তখন বিজয় অর্জন ও প্রাপ্তির অন্যতম উপায় হয়ে দাঁড়ায়। সে সময় ‘শাক্তদর্শন’ নজরুলকে এত ব্যপকভাবে প্রভাবিত করেছিল যে, তিনি কালী সাধনা শুরু করেন এবং একই সঙ্গে শাক্তধর্মে আনত হয়ে পড়েন। এসময় নজরুল ইসলামি বিশ্বাসের উপর আস্থাহীন হয়ে অন্তরে শাক্তধর্মকে লালন করতে শুরু করেন। শাক্তধর্ম মানে শক্তিবাদ। যারা শক্তির পুজো করেন তাদের বলা হয় শাক্ত। এটি হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি ভাগের অন্যতম। হিন্দু দিব্য মাতৃকা শক্তি বা দেবী পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর– এ মতবাদের ওপর ভিত্তি করে শাক্তধর্মের উদ্ভব। বস্তুত এই শাক্তদর্শন থেকে নজরুলের শ্যামাসংগীত রচনার সূচনা এবং বিস্তার।
শ্যামাবন্দনা বা শ্যামাদেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত গানকে শ্যামাসংগীত বলা হয়। দুর্গাদেবীর একটি বিশেষ রূপ ‘কালী’ এবং কালীদেবীর অন্য নাম শ্যামা। শ্যামা কে? শ্যামা মায়ের পরিচয় দিতে গিয়ে নজরুল লিখেছেন–
“মার হাতে কালি মুখে কালি,
মা আমার কালিমাখা, মুখ দেখে মা পাড়ার লোকে হাসে খালি।
মোর লেখাপড়া হ’ল না মা, আমি ‘ম’ দেখিতেই দেখি শ্যামা,
আমি ‘ক’ দেখতেই কালী ব’লে নাচি দিয়ে করতালি।”
প্রবল আবেগের অতল গভীরতা আর ঐকান্তিক প্রেমমুগ্ধতার কারণে নজরুলের শ্যামাসংগীত এত চমৎকার হয়েছিল যে, তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান তিনি। নজরুলেল শ্যামাসংগীত হিন্দুদের পূজার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। নজরুল, কালীভক্ত ও শাক্তধর্মানুরাগী হওয়ায় হৃদয়ের গভীর থেকে শ্যামাসংগীতের মাধ্যমে শ্যামার প্রতি পরম ভক্তি নিবেদন করতে পেরেছিলেন। তাঁর সেই ভক্তি সাকার হয়েছিল গানের ভাষায়। অবিচল প্রেম ও ঐকান্তিক বিশ্বাস ছাড়া তা কখনো সম্ভব ছিল না। নজরুল লিখেছেন–
“ভক্তি, আমার ধুপের মত,
ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত।
শিবলোকের দেব দেউলে,
মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।”
নজরুলের লেখা গানের এক বড়ো অংশই শ্যামা সঙ্গীত। নজরুলের সংগীতবিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘রাঙাজবা’। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ১০০টি শ্যামা সঙ্গীত নিয়ে প্রকাশিত এই গ্রন্থটিতে শক্তি পূজায় তাঁর ভক্ত হৃদয়ের অনিমেষ আকুলতা ও চরম আত্মসমর্পণ ‘রাঙা-জবা’র গানের মধ্যে রূপায়িত হয়। নজরুল লিখেছেন-
রাঙা-জবা কাব্য গ্রন্থটিতে যে সকলশ্যামাসঙ্গীত ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে–
বলে রে জবা বল
মহাকালের কোলে এসে
ভুল করেছি ওমা শ্যামা বনের পশু বলি দিয়ে
তোর কালো রূপ লুকাতে মা বৃথাই আয়োজন
(ওমা ) দুঃখ অভাব ঋণ যত মোর
(আমায় )আর কতদিন মহামায়া
ফিরিয়ে দে মা ফিরিয়ে দে গো
মোরে আঘাত যত হানবি শ্যামা
এস আনন্দিতা ত্রিলোক-বন্দিতা
ওরে আলয়ে আজ মহালয়া, মা এসেছে ঘর
কে বলে মোর মাকে কালো
মা গো আমি তান্ত্রিক নই
মা গো তোমার অসীম মাধুরী
কে পরালো মুন্ডামালা
নাচে রে মোর কালো মেয়ে
আনন্দের আনন্দ
মা এসেছে মা এসেছে
দেখে যারে রুদ্রাণী মা
মাতল গগন অঙ্গন ঐ
শ্মশানকালীর নাম শুনে
মা হবি না মেয়ে হবি
মা গো আজো বেঁচে তোরি প্রসাদ পেয়ে
দুর্গতিনাশিনী আমার
যে নামে মা ডেকেছিল সুরথ আর শ্রীমন্ত তোরে
পরম পুরুষ সিদ্ধ-যোগী মাতৃভক্ত যুগাবতার
জয় বিবেকানন্দ বীর সন্ন্যাসী
আমার হৃদয় অধিক রাঙা মা গো
মায়ের চেয়েও শান্তিময়ী
কেঁদো না কেঁদো না মাকে কে বলেছে কালো
তুই পাষাণ গিরির মেয়ে হলি
মা গো আমি মন্দমতি
শক্তের তুই ভক্ত শ্যামা
মা গো আমি আর কি ভুলি
ওমা নির্গুণেরে প্রসাদ দিতে
আমায় যারা দেয় মা ব্যথা, আমায় যারা আঘাত করে
করুণা তোর জানি মা গো
আয় নেচে আয় এ বুকে
আজও মা তোর পাইনি প্রসাদ
কোথায় গেলি মা গো আমার
মা কবে তোরে পারব দিতে
জগৎ জুড়ে জাল ফেলেছিস্
কালী কালী মন্ত্র জপি
আদরিণী মোর শ্যামা মেয়ে রে
শ্যামা তোর নাম যার জপমালা
আমি নামের নেশায় শিশুর মত (ওমা) বক্ষে ধরেন শিব যে চরণ
রক্ষা-কালির রক্ষা-কবচ আছে আমায় ঘিরে
(আমার) মুক্তি নিয়ে কি হবে মা
(মায়ের) অসীম রূপ-সিন্ধুতে রে
(আমার) কালো মেয়ে পালিয়ে বেড়ায়
জাগো যোগমায়া জাগো মৃন্ময়ী
অসুর বাড়ির ফেরৎ এ মা
আঁধার ভীত এ চিত যাচে মা গো আলো আলো
মা তোর চরণ-কমল ঘিরে
আয় মা চঞ্চলা মুক্তকেশী শ্যামা কালী
শ্মশানে জাগিছে শ্যামা
আয় অশুচি আয় রে পতিত
দীনের হতে দীন দুঃখী অধম যথা থাকে
(মা) এক্লা ঘরে ডাকব না আর
(তুই) বলহীনের বোঝা বহিস্ যেথায় ভৃত্য হয়ে
কেন আমায় আনলি মা গো মহারানীর সিন্ধুকূলে
ভাগীরথীর ধারার মত সুধার সাগর পড়–ক ঝরে
মা গো তোরি পায়ের নূপুর রাজে
জ্যোতির্ময়ী মা এসেছে আঁধার আঙিনায়
তোর কালো রূপ দেখতে মা গো
বল্ মা শ্যামা বল্ তোর বিগ্রহ কি মায়া জানে
মাকে ভাসায়ে জলে কেমনে রহিব ঘরে
কে সাজালো মাকে আমার
(আমার) আনন্দিনী উমা আজো
আমার উমা কই
গিরিরাজ সংসারেই দোলনাতে মা
মহবিদ্য আদ্যাশাক্তি
প্রণমামি শ্রীদুর্গে নারায়ণী
নন্দলোক থেকে আমি এনেছি রে
মায়ের আমার রূপ দেখে যা
নিপীড়িতা পৃথিবী ডাকে
মোরে আঘাত যত হানবি শ্যামা
কেন আমায় আনলি মা গো মহাবাণী সিন্ধুকূলে
আয় বিজয়া আয় রে জয়া
সর্বনাশি ! মেখে এলি এ কোন চুলোর ছাই
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে
শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে
মা ত্রিনয়নী ! সেই চোখ দে
মা ! আমি তোর অন্ধ ছেলে
আমার শ্যামা বড় লাজুক মেয়ে
আমার মা আছে রে সকল নামে
ওমা তোর ভুবনে জ্বলে এত আলো
ওমা তুই আমারে ছেড়ে আছিস
আমার মানস-বনে ফুটেছে রে শ্যামা লতার মঞ্জরী
শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ-ধূপকাঠিতে
ওমা খড়্গ নিয়ে মাতিস রণে
আমার হৃদয় হবে রাঙা জবা
দেহ বিল্বদল
যে কালীর চরণ পায় রে
তোরই নামের কবচ দোলে
মাতৃ নামের হোমের শিখা
আয় মা ডাকাত কালী আমার ঘরে কর ডাকাতি
আমি মুক্তা নিতে আসিনি মা
আমি সাধ করে মোর গৌরী মেয়ের
আমর ভবের অভাব লয় হয়েছে
থির হয়ে তুই বস দেখি মা।
এটি যখন প্রকাশিত হয় নজরুল তখন কালী সাধনায় এতই মগ্ন ছিলেন যে, কালী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারতেন না। তখনই একদল মুসলিম নজরুলকে কাফের ঘোষণা করে এবং অচিরে তাকে বোবা, অথর্ব এবং পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে।
নজরুলের কালীভক্তি কেবল তার শ্যামা সংগীতে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তা তাঁর কবিতাতেও প্রকাশ পায়। ধূমকেতু কাব্যের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য নজরুলের এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। সেই কবিতাতেও ছিল শাক্তসাধনায় তাঁর বিহ্বল প্রকাশ। তিনি লিখেছেন–
“আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?”
অনেকে বলেন, নজরুল নাস্তিক ছিলেন– না, আসলে তিনি নাস্তিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন শাক্ত। কোনো মুসলিম কালী মায়ের পায়ে জবা দিয়ে মসজিদে যেতে পারেন না। আবার কোনো নাস্তিক শ্যামাসংগীত যেমন রচনা করতে পারেন না, তেমনি পারেন না লিখতে নাতে রসুল। তিনি ছিলেন একজন সুবিধাভোগী। তাঁর লেখা নাতে রসুল ও শ্যামাসংগীতের সংখ্যা এবং কবিতায় ইসলামের পরিবর্তে কালীর সীমাহীন প্রভাব দেখলে বোঝা যায় তিনি ছিলেন শাক্তধর্মের অনুসারী। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, নজরুলের কবিতায় যে পরিমাণ উত্তেজনা ছিল সে পরিমাণ পুষ্টি…ছিল না…। যে-যাই বলুক, আমি মনে করি, বাংলা সাহিত্যে নজরুল অপ্রতিরোধ্য এক বিস্ময়, এমন ক্ষণজন্মা প্রতিভা বিশ্বে তেমন একটি জন্মায়নি।
শুদ্ধ অশুদ্ধ পাজি দুষ্ট ও খটকা বানান
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন
সরকারি স্বীকৃতি ছাড়াই নজরুল জাতীয় কবি