ভদ্রলোক স্টলের সামনে এসে দাঁড়াতেই ‘ভাইজান’ বলে ডাক দিলেন যুব। ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, কিছু বলবেন?
যুব : একটা বই নিন।
আমি কেতাব পড়ি, বই পড়ি না।
যুব : কেতাব মানেই তো বই।
কেতাব, আরবি ফার্সি হিন্দি এবং উর্দু ভাষায় লেখা হয়। বই, অন্য ভাষায়। আমি বই পড়তে পারি না। কেতাব থাকলে দিন।
যুব : আপনি ছাড়া আপনার আর কেউ নেই?
মা-বাবা, ভাইবোন, চাচা-চাচি, ভাতিজা-ভাতিজি অনেক আছে।
অথই : তাদের জন্য একটা বই নিয়ে যান।
আমাদের বাসার কেউ বই পড়ে না। কেতাব পড়ে।
যুব : মানে আরবি ফার্সি উর্দু আর হিন্দি ভাষায় লেখা বই?
বই আর কেতাব এক নয়। বাংলা বই পড়ি না। এই ভাষা সংস্কৃতের বোন। সংস্কৃত হচ্ছে গিয়ে হিন্দু ভাষা। কেতাব থাকলে দিন।
যুব : কেতাব নেই।
তাহলে যাই।
পরিকল্পনাটা নিয়েছে অথই এবং যুব। স্টলে কেউ এলে তাকে এমনভাবে অনুপ্রাণিত করবে, যেন বই কিনতে বাধ্য হয়। কাউকে বই না কেনে যেতে দেবে না। দুজনেই ছাত্রী। চৌকষ ষোড়শী, সুন্দর চেহারা এবং ছটফটে বিদুষী। সেজেছে বইয়ের মতো নীরব ব্যক্তিত্বে।
চট্টগ্রামের মুসলিম ইন্সটিউট হলের মাঠে তিন দিনের বইমেলা শুরু হওয়ার প্রথম দিনে প্রচুর বই বিক্রি করে ফেলে দুই ষোড়শী। মেয়ে, তদুপরি ঝমঝম কথুয়া, দর্শককে ক্রেতা বানাতে বেগ পেতে হয়নি। গোল বাঁধাল এক ভদ্রযুবক, তাও শেষ দিনে। তিনি বই কিনবেন না।
ভদ্রলোক চলে যাবার জন্য পা বাড়ালেন।
যুব ডাক দিলেন, ভাইজান, আমাদের স্টলে একটা বই আছে। বইটার নাম ‘গৃহকর্মী থেকে অধিক কর্ম আদায় করার কৌশল’। একের ভিতর দশ।
গৃহকর্মীর বই নিয়ে আমি কী করব?
যুব : আপনি পড়বেন।
আমি বাংলা বই পড়ি না। কেতাব থাকলে দিন।
যুব : আপনার পড়তে হবে না। গৃহকর্মীকে পড়তে দেবেন। বাসার গৃহকর্মী দক্ষ হয়ে ওঠবে। দশ দিনের কাজ একদিনে পেয়ে যাবেন। এজন্যই তো বলা হয়, বই কিনে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
আমাদের বাসায় গৃহকর্মী নেই। আমরাই আমাদের কাজ করি।
অথই : বিদ্যুৎ চলে গেলে কী করেন?
বিদুতের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক কী?
অথই : আছে ভাইজান। ধরুন, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। শরীর থেকে কর্ণফুলী নদীর মতো ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। তখন কী করবেন? একটা বই নিয়ে যান। বাতাস করতে পারবেন। গরম লাগবে না। পাখার চেয়ে সস্তা। বাচ্চাদের বই। শক্ত কিন্তু পাতলা কভার। হাতের আগে চলবে। দশ বছর ব্যবহার করতে পারবেন। গ্যারান্টি দেব। বই গরমের শান্তি।
আমাদের বাসায় আইপিএস আছে। বিদ্যুৎ যাওয়ামাত্র চালু হয়ে যায়। হাতপাখা ব্যবহার করি না। কেতাব থাকলে দেন। উর্দু হলেও আপত্তি নেই।
যুব : বিদুৎ যায় না কিন্তু মশা মাছি তো আছে। তাই না?
এদের কথা আর বইলেন না সিস্টার। মারাত্মক ডিস্টার্ব করে। কেতাব পড়তে পারি না মশার জ্বালায়।
অথই : তাহলে ভাইজান কম দামের একটা পাতলা বই নিয়ে যান। পচিশ পারসেন্ট কমিশন দেব। এটা দিয়ে মশামাছি তাড়ানো যাবে। বই শুধু পড়তে হবে, এটা কে বলেছে আপনাকে?
তওবা তওবা, কেতাব দিয়ে এমন করা যায় না। কেতাব পবিত্র জিনিস। বই দিয়ে করা যায়। আমাদের বাসায় মশা-মাছি তাড়ানোর যন্ত্র আছে। কেতাব থাকলে দিন, পড়ব।
অথই : পেয়ে গেছি।
কী পেয়েছেন?
অথই : আপনার জন্য অতি আবশ্যক একটা বই, বলে অথই শক্ত কভারের একটা ভারী এবং ছোটো বই ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিলেন, “সবসময় হাতে রাখবেন। প্রয়োজনে স্ত্রীর দিকে ছুড়ে দিতে পারবেন। রক্তপাত হবে না কিন্তু দিব্যি কাজ হয়ে যাবে। এই বই কিনে অনেকে উপকার পেয়েছেন। বই কিনলে স্ত্রী পর্যন্ত ঠান্ডা হয়ে যায়।
আমি তো বিয়ে করিনি।
যুব : কিন্তু আপনার চাচা তো বিয়ে করেছেন, বড়ো ভাই করেছেন।
হ্যাঁ।
যুব : নিশ্চয় তাদের শিশু আছে। এখানে ওখানে মল ছাড়ে।
আছে।
যুব : তারা মল ছেড়ে ময়লা করে না ঘরদোর?
শিশুরা তো ঘরদোর ময়লা করবেই। হঠাৎ বিছানায় এখানে সেখানে পেশ্রাব করে দেয়।
তাহলে এই বইটা নিয়ে যান, বলেই যুব একটা বই এগিয়ে দিল ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক বইটির দিকে তাকিয়ে বললেন, বই দিয়ে আমি কী করব?
যুব : শিশুরা ময়লা করলে বইয়ের পাতা ছিড়ে পরিষ্কার করে নেবেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। বই মানুষের মন পরিষ্কার করে। বাড়ি পরিষ্কার করতে পারবে না? আট ফর্মার বই। চৌষট্টি পৃষ্ঠা। চৌষট্টি বার পরিষ্কার করতে পারবেন।
ভদ্রলোক বললেন, আমরা টিস্যু দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করি।
অথই : টিস্যুর মতো পাতলা কাগজ দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করতে গেলে আপনার হাতই ময়লা হয়ে যাবে। বিশটা টিস্যু দিয়ে যা করতে পারবেন না এই বইয়ের একটা পৃষ্ঠা দিয়ে তা করতে পারবেন। নিয়ে যান স্যার।
আমাদের পরিবারের সবাই বিদেশ থাকে। বাসায় আমি একা। কোনো শিশু নেই। ময়লা পরিষ্কার করতে হয় না।
অথই : তাহলে তো নিজেকে রান্নবান্না করে খেতে হয়। তাই না স্যার?
হ্যাঁ।
অথই নতুন একটা বই মেলে ধরে বলল, এটা নিয়ে যান।
এটা তো বই। আমরা বই পড়ি না। কেতাব দেন। আরবি ফার্সি উর্দু হিন্দি।
অথই : নিয়ে যান ভাইজান। অনেক কাজে লাগবে।
কী কাজে লাগবে?
অথই : ধরুন, গভীর রাতে চা খেতে ইচ্ছ করল। রান্না ঘরে গিয়ে দেখলেন গ্যাস নেই। তখন কী করবেন? বইয়ের পাতা জ্বালানি করে চা বানিয়ে নেবেন। পাঁচ পৃষ্ঠা পুড়লে তিন কাপ। দশ পৃষ্ঠা পুড়লে নয় কাপ। বই শুধু মনের ক্ষুধা মেটায় না, পেটের ক্ষুধাও মেটায়।
আমি চা খাই না।
যুব : কেন? কেন স্যার? চা তো আর বই নয়। বই না হয় দোষ করল কিন্তু চা কী দোষ করল?
বাসায় খুব মেহমান আসে। তারাই সব খেয়ে ফেলে।
যুব : কয়জন মেহমান আসে?
প্রতিদিন গড়ে তিন জন। বছরে এক হাজার পঁচানব্বই। বাসা খালি থাকে। তাই মেহমান এলে যেতেই চায় না। মিডল ইস্ট থেকে পাঠানো সব টাকা মেহমানদারিতে চলে যায়। বিদেশ হতে কাড়ি কাড়ি রিয়েল আসে কিন্তু কোনো বরকত পাই না।
অথই : ভাইজান তাহলে এই বইটা দেখুন। খুব কাজে আসবে। এতক্ষণ এটি বলেননি কেন? আপনার এত সময় নষ্ট হতো না।
যুব : আপনাদের মেহমান বই পড়তে পারে তো?
পারে। কিন্তু তাদের জন্য আমি বই নেব কেন? খাওয়াতে হয়, পরাতে আবার পড়াতেও হবে না কি? কী বলেন এসব!
অথই : বই পড়বে মেহমান কিন্তু লাভ হবে আপনার। এটি জাদুকরি বই। এর ক্ষমতার কথা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। তিন দিনের মেলায় নয়শ কপি বিক্রি হয়েছে। আর মাত্র কয়েকটা কপি আছে।
বইটির নাম কী?
অথই : বইটির নাম, ‘শ্রেষ্ঠ মেহমান আপনাকে সালাম’।
এটা দিয়ে আমি কী করব?
অথই : আপনার বাসায় মেহমান যেসব জায়গা বসেন, খান, ঘুমান, গল্প করেন সেসব জায়গায় বইটি রেখে দেবেন। খুব সুন্দর মলাট। দেখামাত্র টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করবে আপনার মেহমান। পড়ার পর বুঝতে পারবে, শ্রেষ্ঠ মেহমান হতে হলে কী করতে হয়। শ্রেষ্ঠ মেহমান হওয়ার জন্য আপনার মেহমান না খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাবে। অল্প দাম। মাত্র একশ টাকা।
শ্রেষ্ঠ মেহমান কে?
অথই : সেই শ্রেষ্ঠ মেহমান। যে কারো মেহমান হয় না। হলেও বেশিক্ষণ থাকে না। না খেয়ে চলে যায়।
ঠিক বলছেন তো?
যুব : বিশ্বাস না হয় আপনি পড়ে দেখুন।
আমি বই পড়ি না। কেতাব পড়ি। আরবি ফারসি উর্দু হিন্দি।
অথই : আপনাকে পড়তে হবে না। আপনি শুধু লাভ নেবেন। বই যে পড়ে কেবল তাকে লাভবান করে না। যে পড়ায় তাকেও লাভবান করে।
কীভাবে লাভবান করবে?
অথই : তিন জন মেহমান এক বেলা কম খেলে প্রতিদিন নয়শ টাকা বাঁচবে। বছরে যদি এক হাজার পঁচানব্বই জন মেহমানকে এই বইটি অন্তত একবেলা কম খাওয়ানোর প্রেরণা দিতে পারে তাহলে প্রতিবছর বাঁচবে তিন লাখ আটাশ হাজার পাঁচশ টাকা। মাসে আয় হবে সাতাশ হাজার তিনশ পঁচাত্তর টাকা।
যুব : এখন স্যার, আপনিই বলুন বইটি নেবেন কি না?
লাভ লোভের মা। লাভের অঙ্ক শুনে ভদ্রলোক চোখদুটো ছানাবড়া করে লোভাতুর চোখে দুই সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এত উপকারী বই আছে জানতাম না। তাহলে এতদিন কেতাব পড়েছি কেন?
অথই : বই নেবেন?
আচ্ছা দেন।
অথই : কয়টি?
একটি ডাইনিং টেবিলে, একটি ড্রয়িং রুমে। চার শোবার ঘরে চারটি এবং তিন বাথরুমে তিনটি। মোটি নয়টি হলে চলবে। কত দাম?
নয়শ টাকা।
কমিশন দেবেন না?
ভাইজান, এমন উপকারী বই হতেও যদি কমিশন চান তাহলে কী হবে? বই তো আপনি পড়বেন না। আপনি পড়লে কিছু কমিশন না হয় দিতাম।
আমিও পড়ার চেষ্টা করব। শ্রেষ্ঠ মেহমান কে না হতে চায়।
অথই : আপনার নয়শ টাকা দিতে হবে না, পাঁচশ দিলে হবে।
কেন?
অথৈ : এত উপকারী বই কি থাকে? পাঁচটাই আছে। বাকিগুলি বিক্রি হয়ে গেছে। পালা করে পড়তে দেবেন মেহমানদের।
To provide the best experiences, we use technologies like cookies to store and/or access device information. Consenting to these technologies will allow us to process data such as browsing behavior or unique IDs on this site. Not consenting or withdrawing consent, may adversely affect certain features and functions.
Functional
Always active
The technical storage or access is strictly necessary for the legitimate purpose of enabling the use of a specific service explicitly requested by the subscriber or user, or for the sole purpose of carrying out the transmission of a communication over an electronic communications network.
Preferences
The technical storage or access is necessary for the legitimate purpose of storing preferences that are not requested by the subscriber or user.
Statistics
The technical storage or access that is used exclusively for statistical purposes.The technical storage or access that is used exclusively for anonymous statistical purposes. Without a subpoena, voluntary compliance on the part of your Internet Service Provider, or additional records from a third party, information stored or retrieved for this purpose alone cannot usually be used to identify you.
Marketing
The technical storage or access is required to create user profiles to send advertising, or to track the user on a website or across several websites for similar marketing purposes.