ড. মোহাম্মদ আমীন, বিসিএস (প্রশাসন), ১০ম ব্যাচ
বিগত পাঁচ বছরের বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের পছন্দক্রম নিয়ে পারিচালিত এক গবেষণা অনুযায়ী সাধারণ ক্যাডারসমূহকে প্রার্থীর প্রথম পাঁচটি পছন্দের ভিত্তিতে নি¤œরূপে ভাগ করে আলোচনা করা যায় :
১. সর্বোচ্চ আগ্রহ
ক. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পররাষ্ট্র)
খ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পুলিশ)
গ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন)
ঘ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (শুল্ক ও আবগারি)
ঙ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (কর)
চ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (নিরীক্ষা ও হিসাব)
২. মধ্যম আগ্রহ
ক. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বাণিজ্য)
খ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (খাদ্য)
গ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্যিক)
৩. সাধারণ আগ্রহ
ক. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (আনসার)
খ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (তথ্য)
গ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (ডাক)
ঘ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (সমবায়)
ঙ. বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পরিবার পরিকল্পনা)
বিসিএস পরীক্ষায় উপযুক্ত ক্যাডার পছন্দের উপর, অনেক ক্ষেত্রে বিসিএস পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ক্যাডার প্রাপ্তির সফলতা বা ব্যর্থতা বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাই বলা হয়, সঠিক ক্যাডার পছন্দায়ন বিসিএস পরীক্ষার আবেদন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ভালো পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও ভুল ক্যাডার-পছন্দ-ক্রমের কারণে ভাইভা বোর্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারেন, ফলে বঞ্চিত হতে পারেন আপনার প্রত্যাশিত ক্যাডার থেকে। অতএব, সার্বিক বিবেচনা করে আবেদনপত্রে আপনার ক্যাডার পছন্দক্রম বিন্যস্ত করা অত্যন্ত জরুরি। অনেকেই জানতে চান, কোন কোন ক্যাডারকে প্রথম পছন্দে রাখব এবং কোনটাকে রাখব দ্বিতীয় বা তৃতীয় এবং অন্যান্য ক্রমে?
পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের যোগ্যাতা যাচাইর্প্বূক প্রার্থীর পছন্দের ক্রম এবং পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত ২৬টি ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে থাকে। আলোচ্য অধ্যায়ে মূলত সাধারণ ক্যাডারসমূহের পছন্দ নিয়ে আলোচনা করা হবে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কোন ক্যাডারটি প্রথম পছন্দে রাখবেন এবং কেন রাখবেন? অধিকাংশ প্রার্থী পররাষ্ট্র, পুলিশ, প্রশাসন, শুল্ক আবগারি, কর, নিরীক্ষা ও হিসাব – প্রভৃতি ক্যাডারকে প্রথম পছন্দে কিংবা পছন্দের সবচেয়ে উপরের দিকে রাখতে চান। তাই এই ক্যাডারগুলো নিয়ে প্রচ- প্রতিযোগিতা চলে।
তাহলে অন্য ক্যাডারগুলো অপ্রয়োজনীয়? প্রত্যেকটি ক্যাডার সরকারের জন্য অনিবার্য এবং অনিবার্য বলেই ক্যাডারগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে। অতএব, কোনোটি অবহেলার নয় এবং প্রত্যেক ক্যাডার-পদ সম্মানজনক। একটি শরীরে বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ থাকে। সবটিই প্রয়োজনীয়, তবে প্রয়োজনীয়তার মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। ক্যাডারসমূহের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সরকার যদি একটি শরীর হয়, তাহলে ক্যাডার হচ্ছে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কোনোটা চোখ, কোনোটা কান, কোনোটা নাক, কোনোটা মাথা, কোনোটা হাত ইত্যাদি।
১ নম্বর ক্রমে বর্ণিত ক্যাডারগুলোর যে-কোনোটিতে টিকতে হলে প্রচ- অধ্যবসায় প্রয়োজন। এ অবস্থায় আপনি কী করবেন? কিছুই করবেন না, শুধু আপনার যে ক্যাডারটি সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সেই ক্যাডারই প্রথম পছন্দে রাখবেন। তারপর পছন্দের ক্রমানুসারে সাজাবেন। প্রথমটি না হোক, দ্বিতীয়টি বা তৃতীয়টি তো হবে। আসল কথা হচ্ছে, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো নাম্বার। সুতরাং ক্যাডার-পছন্দ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পছন্দে ভালোটি না রাখলে পরীক্ষায় ভালো হলেও আপনি ওই ক্যাডার পাবেন না।
বিসিএস পরীক্ষায় যে কোনো ক্যাডার পেলে চাকরি করবেন- আপনার যদি এমন মনোভাব হয়, তাহলে বিজ্ঞপ্তি অনুসারে আপনি যেসব পদে আবেদন করার যোগ্য, সবগুলোর জন্য পছন্দ দিয়ে দিতে পারেন। যদি মনে করেন, নির্দিষ্ট কয়েকটা ক্যাডার না-পেলে আপনি বিসিএস ক্যাডারে চাকুরি করবেন না, তাহলে কেবল যেসব ক্যাডারে আপনি চাকুরি করতে চান, সেগুলোই পছন্দ দেবেন। আপনি একটা ক্যাডারে টিকে গেলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যোগদান করলেন না, তাহলে আপনার ওই ব্যাচের একজন যোগ্য প্রার্থী বঞ্চিত হয়ে গেল। এমন করা অনুচিত। অনেকে মজা করার জন্য বা অন্যকে নিজের কৃতিত্ব দেখানোর জন্য এমন করে থাকেন। মনে রাখবেন, আপনার খেলা অন্য জনের জন্য হতে পারে মৃত্যু।
পুলিশ ও আনসার ক্যাডারে আবেদন করতে হলে ন্যূনতম উচ্চতা ছেলেদের ক্ষেত্রে ৫’৪” আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ৫’২” চাওয়া হয়। এই উচ্চতার শর্ত যাদের পূরণ হয় না, তাদের এই দুটি ক্যাডার পছন্দ তালিকায় রাখা উচিত নয়। অধিকন্তু, যাদের বড়ো কোনো শারীরিক সমস্যা আছে, তারাও এ দুটি ক্যাডারকে পছন্দের তালিকা হতে বাদ রাখবেন। পুলিশ ও আনসার ব্যতীত অন্য ক্যাডারে আপনার উচ্চতা যাই হোক না কেন, আপনি পছন্দের তালিকায় রাখতে পারেন।
মনে করুন আপনার সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল পররাষ্ট্র ক্যাডার, দ্বিতীয় পুলিশ এবং তৃতীয় প্রশাসন। কিন্তু প্রথম দুই পছন্দে শূন্যপদের সংখ্যা কম দেখে আপনি প্রশাসনকে প্রথম পছন্দে রাখলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দে রাখলেন যথাক্রমে পররাষ্ট্র এবং পুলিশ- এই পছন্দ আপনার জন্য ঠিক হয়নি । ধরুন, ওই বছর বিসিএস (পররাষ্ট্র) ক্যাডারে যে ছেলেটি সর্বশেষ হয়েছে, সে নাম্বার পেয়েছে ৮০০, আপনি পেয়েছেন ৮৮২, কিন্তু প্রশাসন প্রথম পছন্দ হওয়ায় আপনাকে ওই প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগোর সুপারিশ করা হবে। যোগ্য হয়েও কেবল ক্যাডার পছন্দে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না দেওয়ায় আপনি পররাষ্ট্র ক্যাডার হতে বঞ্চিত হলেন।
আবারও বলছি, ক্যাডার পছন্দ বিসিএস পরীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেকে ক্যাডার পছন্দে বিচক্ষণতা দেখাতে না পারার কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভালো ক্যাডার পান না। মনে করুন, আপনি প্রথম দ্বিতীয় এভাবে বারোটি ক্যাডার পছন্দ করলেন। পরীক্ষায় আপনার প্রাপ্ত নম্বর এবং ক্যাডার পছন্দক্রম বিবেচনা করে আপনাকে একটি নির্দিষ্ট ক্যাডারে নির্বাচিত করা হবে। অর্থাৎ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর আপনার ক্যাডার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। মনে করুন, আপনার প্রথম পছন্দ প্রশাসন ও দ্বিতীয় পছন্দ পুলিশ এবং আপনার বন্ধু কালামের প্রথম পছন্দ ফরেন সার্ভিস ও দ্বিতীয় পছন্দ প্রশাসন। কালাম পররাষ্ট্র ক্যাডার পেলেন না, কিন্তু পরীক্ষায় আপনার চেয়ে অধিক নাম্বার পেয়েছেন, যা প্রশাসন ক্যাডার পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত। তাহলে দ্বিতীয় পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও কালাম আপনার আগে প্রশাসন ক্যাডার পাবেন। আবার ধরুন, আপনার প্রথম পছন্দ, পুলিশ এবং দ্বিতীয় পছন্দ পররাষ্ট্র এবং কালামের প্রথম পছন্দ পররাষ্ট্র এবং দ্বিতীয় পছন্দ কাস্টমস। কালাম আপনার চেয়ে কম নম্বর পেয়ে পররাষ্ট্র পেয়েছেন, কিন্তু আপনি তার চেয়ে বেশি নাম্বার পেলেও পররাষ্ট্র পাবেন না, কারণ আপনার প্রথম পছন্দ ছিল কাস্টমস। এবার কোন ক্যাডারের কী কাজ তা দেখে নিন।
বিসিএস (পররাষ্ট্র)
বাংলাদেশিদের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ। শুধু বাংলাদেশ কেন, উন্নয়নশীল সব দেশের মানুষের কাছে বিদেশ চিরন্তন আকর্ষণের উৎস যেন। মূলত এই আকর্ষণই পররাষ্ট্র ক্যাডারকে প্রথম পছন্দে রাখার কারণ। পররাষ্ট্র ক্যাডার সবাই প্রথম পছন্দে রাখতে চায়। তাই পররাষ্ট্র ক্যাডার পছন্দের তালিকায় রাখতে হলে প্রথম পছন্দে রাখা উচিত। অন্যথায়, রাখা বা না-রাখা সমান। অনেকে বলেন, ইংরেজিতে দক্ষতা না থাকলে এই ক্যাডার প্রথম পছন্দে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি তা মনে করি না, লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলে আপনি পররাষ্ট্র ক্যাডারে টিকে যেতে পারেন। আর পররাষ্ট্র ক্যাডার প্রথম পছন্দে দিলে যে, সবসময় ইংরেজিতে প্রশ্ন করা হয়- এটি ঠিক নয়। এই ক্যাডার না পেলে আপনি দ্বিতীয় ক্যাডার পাবেন। আপনি কেন পররাষ্ট্র ক্যাডার পছন্দ করবেন এবং এই ক্যাডারে আপনার সম্ভাবনা কী তা দেখে নিন :
বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের সদস্য হলে প্রথমে আপনাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব হিসেবে যোগদান করতে হবে। প্রথম অবস্থায় আপনার সব কাজই হবে প্রশিক্ষণমূলক। টাইপিং থেকে শুরু করে সংসদ অধিবেশন চলাকালীন সংসদ সচিবালয়ে দায়িত্ব পালন করার জন্য পাঠাতে পারে। এমন সব কাজ করতে হবে যে, আপনি এই ক্যাডারের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে যেতে পারেন। প্রথম অবস্থায় আপনি গাড়িও পাবেন না, কর্মস্থল হতে বাসায় আসা-যাওয়ার জন্য গণমাইক্রোবাস পাবেন।
চাকরি স্থায়ী হওয়ার পর আপনাকে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসে থার্ড সেক্রেটারি হিসেবে পদায়ন করা হবে। ছয় বছর দুটি দেশে দায়িত্ব পালন করার পর তিন বছরের জন্য ঢাকায় পোস্টিং পাবেন। এভাবে চক্রাকারে আপনার আসা-যাওয়া চলবে। দূতাবাসে পদায়ন হলে দেশের নিয়মিত বেতনের অতিরিক্ত বিদেশ ভাতা হিসেবে মাসে ১২০০ ডলার পাবেন। তার সঙ্গে বার্ষিক ২০,০০০ ডলার বাড়ি ভাড়া, মাসিক ৩০০ ডলার বিনোদন ভাতা, সর্বোচ্চ দুই সন্তানের অধ্যয়ন খরচ এবং পরিবারের সদস্যবর্গের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৯০ ভাগ পাবেন। এছাড়াও রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা।
দেশে আনার সময় ট্যাক্স দিতে হলেও বিদেশে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি কিনতে পারবেন। দেশে বিদেশে অনেক প্রশিক্ষণ করতে পারবেন, যার সব খরচ সরকার বহন করবে এবং প্রশিক্ষণ ভাতাও দেবে। কুটনীতিক না-হলেও বিদেশে গেল আপনার পরিবারের সদস্যবর্গও কুটনীতিক মর্যাদা ভোগ করতে পারবেন।
এই ক্যাডারে লোকবল কম বলে পদোন্নতির সুযোগ ভালো। তবে পদের সংখ্যাও কম। এই ক্যাডার নিয়োগ পেলে আপনি নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রদূত পর্যন্ত যেতে পারবেন। রাষ্ট্রদূতগণ যেহেতু বিদেশে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তাই যথেষ্ট সম্মান পাবেন।আপনার পাসপোর্ট হবে লাল। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পাবেন অবারিত। তবে সচিব হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম।
বিদেশে গিয়ে সর্বোচ্চ কুটনীতিক মর্যদা পেতে চাইলে, সহজে বিদেশে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিতে চাইলে, বিদেশে গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়াতে চাইলে, আপনার সন্তানদের সরকারি খরচে বিদেশে পড়াতে চাইলে, বিদেশে প্রভাবশালী মন্ত্রী-শাসকদের সঙ্গে রাজকীয় জীবনযাপন করতে চাইলে এই ক্যাডারের কোনো বিকল্প নেই এবং এই ক্যাডারকেই প্রথম পছন্দ হিসেবে রাখুন।
বিসিএস (প্রশাসন)
আমি যখন বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করি, তখন প্রশাসন ক্যাডারের অবস্থা ছিল অন্য রকম। ম্যাজিস্ট্রেসি ছিল প্রশাসন ক্যাডারের হাতে। এই সুবাদে আমি দুটি উপজেলার উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম- একটি হাতিয়া এবং অন্যটি চকরিয়া, কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেসি প্রশাসন ক্যাডার থেকে চলে যাওয়ার পর প্রশাসন ক্যাডার অনেকটা এতিম হয়ে যায়। বিশেষ করে, মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের যে জৌলুশ ছিল তা এখন আর নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরও প্রশাসন ক্যাডার ছিল অধিকাংশ প্রার্থীর প্রথম পছন্দ। প্রশাসন চলে এসেছে তৃতীয়তে। তারপরও কার্যকরণগত কারণে এখনও প্রশাসন অনেকের প্রথম পছন্দের ক্যাডার।
একসময় পুলিশের উপর প্রশাসন ক্যাডারের কিছুটা কর্তৃত্ব ছিল। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন লিখতেন, ভ্রমণ বিলে স্বাক্ষর করতেন, ছুটিছাটা দিতেন; এখন জেলা প্রশাসকের হাতে পুলিশের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আগে নি¤œ আদালতের বিচার করতেন প্রশাসন ক্যাডারের ম্যজিস্ট্রেটগণ। এখন ওই বিচার করেন বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটগণ। বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটগণ পিএসসি দ্বারা নিয়োজিত হয় না, এরা নিয়োজিত হয় সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা। তাই প্রশাসন ক্যাডার এখন পছন্দের তৃতীয় তালিকায় চলে গেছে। তারপরও যদি সচিব হতে চান, বৈচিত্র্যময় কর্মক্ষেত্র চান, তাহলে প্রশাসন ক্যাডারকে প্রথম পছন্দে রাখতে পারেন। কেন রাখবেন তা অনুধাবনের জন্য বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কিছু কর্ম খতিয়ান দেখতে পারেন :
বলা হয় যদি মঙ্গলগ্রহে বাংলাদেশ সরকার কোনো শাখা খোলার চিন্তাভাবনা করে তবে তা বাস্তবায়নের আগে একটি পদ সৃষ্টি করে তাতে প্রশাসন ক্যাডারের একজন সদস্যকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের অন্যতম কাজ হলো অন্য সকল ক্যাডার কর্মকর্তৃবৃন্দের কাজের সমন্বয়, মোবাইল কোর্ট পরিচলনা, আইনশৃঙ্খলা পর্যবেক্ষণ, সরকারকে প্রত্যাশিত বিষয়ে প্রতিবেদন প্রদান, মাঠ পর্যায়ের কর্মকা-ের সরকারের যোগসূত্র স্থাপন প্রভৃতি এই ক্যাডারের সদস্যবর্গের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সদস্য হতে পারলে আপনাকে প্রথমে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রে হিসেবে জেলায় কর্মজীবন শুরু করতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারে চাকুরি জীবনে আপনার কমপক্ষে ১৮টি ভিন্ন পরিম-লে বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশে চাকুরি করার অভিজ্ঞতা হবে। মাঠ পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক, মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব, সরকারের সকল অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরের প্রধান নির্বাহী, সরকারের সকল প্রতিষ্ঠানের প্রধান-সহ পাটকল, চিনিকল, মিল্ক ভিটা সবগুলো কর্পোরেশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার বেসামরিক বিমান পরিবহণের সদস্য হওয়া, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা সদস্য হওয়ার,। সিটি কর্পোরেশন, জেলাপরিষদ, ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার এবং এর আওতাধীন স্কুল, কলেজ, অবকাঠামো প্রশাসন ক্যাডারের ব্যবস্থাপক হওয়ার সুবিধা কেবল প্রশাসন ক্যাডারেই আছে। চাকুরিতে যোগদানে দুই/তিন বছরের মধ্যে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে পদায়িত হওয়া যায়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপজেলার সবচেয়ে মর্যাদাবান অফিসার, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাংলো এবং সার্বক্ষণিক গাড়ি রয়েছে।
সচিবালয় অর্থ সচিবের আলয়; মূলত প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণই সচিবালয় পরিচালনা করে থাকেন। সরকারের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তৃগণের ৭৫ ভাগ প্রশাসন থেকে নিযুক্ত এবং বাকি ২৫ ভাগ অন্যান্য ক্যাডারের। রাজনৈতিক দিক থেকে দেশকে পরিচালিত করেন মন্ত্রীগণ, কিন্তু মন্ত্রীদের চালান প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যবর্গ। কেউ যদি নিজেকে দেশের নীতি প্রণয়নে যুক্ত হতে চান, তাহলে তিনি প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য হতে পারেন।
প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য হলে চাকুরির বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাজের পরিধিও বাড়বে। চাকুরি থাকাকালীন আপনি সম্মান পাবেন, অবসরে আরও বেশি সম্মান পেতে পাবেন। সরকারের সাংবিধানিক সংস্থাগুলোয় নিয়োগে প্রশাসন ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত সদস্যবর্গের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন, নির্বাচন কমিশনের প্রধানগণ এডমিনের প্রাক্তন সচিব ছিলেন। বিসিএস ইকনোমিক ক্যাডার এখন প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একিভূত করে ফেলা হয়েছে। তাই প্রশাসন ক্যাডারে চাকুরি হলে আপনি ইকনোমিক ক্যাডারের সদস্যবর্গের যাবতীয় সুবিধা, মর্যাদা ভোগ এবং দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন।
আমলা বলতে সাধারণত প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের বলা হয়। সচিবালয়ে পোস্টিং হলে আপনি সরকারের পাঁচটি সচিবালয় যথা বাংলাদেশ সচিবালয়, পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় ছাড়াও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সহকারী সচিব হিসেবে যোগদান করবেন। দেশের বাইরে বিভিন্ন দূতাবাসেও আপনার পদায়ন হতে পারে। কর্মবৈচিত্র্য হচ্ছে এই ক্যাডারের সবচেয়ে অন্যতম আকর্ষণ। অন্য ক্যাডারের সদস্যগণ শুধু নিজের ক্যাডারের একমুখী কর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যগণ সরকারের সব প্রতিষ্ঠানে, এমনকি দেশরক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন বেসামরিক পদেও কাজ করার সুযোগ পান। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য হলে আপনি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, বোর্ড, ইন্সটিটিউট, কর্পোরেশনসমূহেও চাকুরি করার সুযোগ পাবেন। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরাই মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব হন। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের প্রচুর বিদেশ প্রশিক্ষণ এবং বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আছে। লিয়েন ও প্রেষণে কাজ করারও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের। এই ক্যাডার থেকে ক্যাবিনেট সচিব হন, যার মর্যাদা সংসদ সদস্যের চেয়ে বেশি। সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিশে জনগণকে খুব কাছে থেকে দেখে তাদের সেবা করার জন্য প্রশাসন ক্যাডার সবচেয়ে উত্তম।
পররাস্ট্র ক্যাডার না হয়ে ও অনেকে বিদেশে কূটনৈতিক মিশনে কাজ করার সুযোগ পান, এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়র রেকর্ড ও এই ক্যাডারের লোকের আছে। অধিকাংশ সাংবিধানিক পোস্টে এই ক্যাডারের সদস্যগণ বিভিন্ন পদে নিয়োগ পান। পিএসসির চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের অধিকাংশই এই ক্যাডার থেকে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।
তবে, এই ক্যাডারে একি ব্যাচের লোকের যেমন উপসচিব হয়ে অবসরে যাওয়ার রেকর্ড আছে তেমনি ওই ব্যাচেরই একজনের কেবিনেট সচিব হওয়ারও রেকর্ড আছে, সরকারের সচিব বা সচিব পদমর্যাদার পোস্ট গুলোতে অ্যাডমিন ক্যাডাররাই অধিষ্ঠিত হন।
বিভিন্ন ক্যাডার থেকে উপসচিব পদ নিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে আসার প্রবণতা এখন অনেক বেশি। তাই প্রশাসন ক্যাডারে বাস্তব পদোন্নতি অনেক কম। পদোন্নতি দেওয়া হলেও তা এমন যে, সিনিয়র সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করতে হয় অনেক অতিরিক্ত সচিবকে।
আপনার বয়স যদি কম হয় এবং তুলনামূলকভাবে কম বয়সে বিসিএস পরীক্ষা দিতে যান, তাহলে আমার পরামর্শ,আপনি প্রশাসন ক্যাডারকেই প্রথম পছন্দ দেবেন। তাহলে আপনি ক্যাবিনেট সচিব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন। অনেক বিখ্যাত হতে পারবেন। অন্য কোনো ক্যাডারে তা সম্ভব হবে না।
তবে, আপনি যদি অন্য কোনো ক্যাডার ১৪/১৫ বছর চাকুরি করার পর ওই ক্যাডার ছেড়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে আসতে চানা তাহলে আপনি প্রশাসন ক্যাডারকে প্রথম পছন্দে কখনও রাখবেন না।
বিসিএস (পুলিশ)
রাষ্ট্রে বা সরকারে এমন কোনো বিষয় নেই, যেখানে পুলিশ প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে না। প্রশাসন বা আদালত আদেশ দিয়ে থাকে, সেই আদেশ কার্যকর করে পুলিশ। বর্তমান রাজনীতিক, আর্থসামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কারণে সবাই পুলিশের উপর প্রচ-ভাবে নির্ভরশীল। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে নিরাপত্তা এবং তা দেখভালের দায়িত্ব পালন করে পুলিশ। ক্যাডার সার্ভিসের সর্বশেষ ধাপ পুলিশ ভ্যারিফিকেশন- এই কাজটিও করে পুলিশ। আপনি পুলিশ ক্যাডারে চাকুরি করতে পারলে আপনার আত্মীয়স্বজনের যত উপকার করতে পারবেন, অন্য ক্যাডারে চাকুরি করে তা কখনও পারবেন না। সব ক্যাডারের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক না-থাকলেও সবাই পুলিশকে ভয় পায়, কারণ যে-কোনো সময় আপনার বা আপনার আত্মীস্বজনের প্রয়োজনীয়তার কারণে আপনাকে পুলিশের দ্বারস্থ হতে পারে । এজন্য পুলিশ ক্যাডার অনেকের প্রথম পছন্দ। এছাড়া পুলিশ প্রশাসন প্রথম পছন্দের আর কী কারণ থাকতে পারে দেখুন :
বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের সদস্য হলে আপনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এএসপি বা অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেন্ডেট অফ পুলিশ পদে যোগদান করবেন। সেখান থেকে আপনাকে এক বছরের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য রাজশাহীর সারদায় অবস্থিত বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে পাঠানো হবে। বেসামরিক চাকুরির মধ্যে পুলিশ ক্যাডারের প্রশিক্ষণই সবচেয়ে কার্যকর এবং কর্মমুখী বলে বিবেচনা করা হয়। সারদায় প্রশিক্ষণের মধ্যে আছে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, ঘোড়া চালনা, ড্রাইভিং, ডিফেন্সিভ টেক্টিকস, শারীরিকপ্রশিক্ষণ ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ চলাকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি মাস্টার্স করাও হয়ে যাবে। বিভাগীয় প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর বিপিএটিসিতে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ করতে হয়। এ ছাড়া চাকরিজীবনে দেশে-বিদেশে নানান প্রশিক্ষণের সুযোগ আছে।
প্রশিক্ষণ শেষে আপনার পোস্টিং জেলা পুলিশে হবে। সেখানে এএসপি হিসেবে কাজ করবেন। মেট্রোপলিটন এলাকাতেও আপনার পোস্টিং হতে পারে। মেট্রোপলিটন পুলিশে হলে আপনি সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে যোগদান করবেন। পুলিশ ক্যাডারে চাকরি জীবনের শুরু থেকেই সার্বক্ষণিক গাড়ি, বাড়ি, ড্রাইভার, বডিগার্ড পাওয়া যায়। তা ছাড়া বিশেষ বাহিনী হিসেবে র্যাব এবং আরো কয়েকটি বাহিনীতে কাজ করলে বেতনের অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া হয়। পুলিশ সার্ভিসে ইউনিফর্ম বাধ্যতামূলক, তাই ইউনিফর্মের জন্যও পুলিশ সদস্যরা ভাতা পেয়ে থাকেন, পেয়ে থাকেন রেশন। এ ছাড়া পুলিশ ক্যাডারের অফিসাররা পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্রাধিকার ও বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ পুলিশ ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করছেন। সিভিল সার্ভিসের ক্যাডারগুলোর মধ্যে একমাত্র পুলিশ ক্যাডারেরই সব অফিসার ইউএন মিশনে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। মিশনে গেলে এক বছরে আপনি বিশ থেকে চল্লিশ লাখ টাকা আয় করতে পারবেন। এ ছাড়া সামাজিকভাবে পুলিশ ক্যাডার অন্য সব ক্যাডারের চেয়ে নিরাপদ অবস্থানেই থাকেন। দেশে থাকলে ঝুকি ভাতা এবং রেশন পাওয়া যায়। পুলিশ হাসপাতালে পাওয়া যায় সুচিকিৎসা।
এত আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধার পরও আর একটি আকর্ষণ এখানে রয়েছে সেটি হচ্ছে কর্মপরিম-লের বহুমুখীনতা এবং বিস্তীর্ণ পরিসর। যাঁরা কাজের বৈচিত্র্য পছন্দ করেন তাঁদের জন্য এই ক্যাডারই সবচেয়ে উপযুক্ত। রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে বস্তির সাধারণ নাগরিক- সবার নিরাপত্তা এবং অন্যবিধ সেবা দিয়ে থাকেন পুলিশ। রেঞ্জ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), সোয়াট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ব্যাটালিয়ন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), ট্যুরিস্ট পুলিশ, রেলওয়ে পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ইত্যাদিতেও ভিন্ন আবহে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ভিভিআইপিদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এসএসএফ- দলেও কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
তবে এই ক্যাডারে সদস্য হলে আপনাকে সার্বক্ষণিক কাজ করতে হবে। এখানে আপনার দায়িত্বে নয়টা পাঁচটা ভুলে যেতে হবে। সারা রাত এবং সারাদিনও কাজ করতে হবে। গভীর রাতে আপনার ডাক আসতে পারে, অমুক জায়গায় অমুক ঘটনা ঘটেছে, এক্ষুনি চলে যাও।
পুলিশ ক্যাডার হতে চাইলে আমার কী লাগবে? এই প্রশ্নের উত্তর বলছি, আপনার কী যোগ্যতা প্রয়োজন সে প্রসঙ্গে। বিসিএস পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার যোগ্য যে কেউ পুলিশকে প্রথম পছন্দে রাখতে পারেন। তবে অন্য ক্যাডারের চেয়ে এখানে দুটি শর্ত বেশি আছে। তা হলো পুরুষের বেলায় উচ্চতা থাকতে হবে কমপক্ষে ৫’৪” আর নারীদের বেলায় ৫’২”। চোখের দৃষ্টি হতে হবে ৬/৬। যদি আপনি পুলিশ ক্যাডার হতে চান তবে বিসিএস পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে হবে। কারণ, এ ক্যাডার অনেকেই প্রথম পছন্দ দিয়ে থাকেন। তাই যার নম্বর বেশি, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তারাই পছন্দের ক্যাডার পেয়ে থাকেন। এতকিছুর পরও পুলিশ ক্যাডার প্রচ- ইমেজ সংকটে আছে। অনেকে পুলিশকে পছন্দ করেন না। মনে করেন, পুলিশের চাকুরে মানেই ঘুসখোর। আসলে তা সবক্ষেত্রে ঠিক নয়
বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি)
কাস্টমস ক্যাডারের সদস্যগণ অর্থমন্ত্রণালয়ের আইআরডি-এর অধীন এনবিআর-এর একটি উইং এর অধীনে কাজ করে। কাস্টমস এক্সসাইজ অ্যান্ড ভ্যাট, দেশের সমস্ত আমদানি ও রপ্তান পণ্যের উপর শুল্ক বসিয়ে থাকে। দেশ-বিদেশের সব বড়ো ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের সঙ্গে অল্পসময়ে তাদের খাতির গড়ে উঠে। তাই এটিও পছন্দের তালিকায় প্রথমদিকে থাকে। এ কারণে বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডার অনেক প্রার্থীর প্রথম পছন্দ। এই ক্যাডারের চাকুরি নিরিবিল, কিন্তু বেশ জৌলুশময়। চাকুরিতে যোগদানের সঙ্গে গাড়ি পাওয়া যায়। এই ক্যাডারে নিযুক্ত হলে প্রথমে আপনাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সহকারী কমিশনার (কাস্টমস) পদে যোগদান করতে হবে। শুল্ক ও আবগারী বিভাগ, সরকারের পক্ষ থেকে পরোক্ষ কর সংগ্রহ করে থাকে। এই ক্যাডারের চাকুরেদের শুল্ক গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করারও সুযোগ আছে। কাস্টম হাউজ, স্থল বন্দর ও বন্ডে কাজ করতে পারবেন।
এই ক্যাডারে বৈধ উপায়েও প্রচুর আয় করা যায়। চোরাচালান ও কর ফাঁকি ধরতে পারলে সরকারিভাবে মূল্যভেদে ১০% হতে ৪০% পুরস্কার বা গ্র্যান্ট অব রিওয়ার্ড পাওয়া যায়। এই ক্যাডারের সদস্যদের পুলিশ বা প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের মতো ব্যাপকভাবে ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ নেই, তবে দেশের বড়ো ধনী ব্যবসায়ী ও আমদানি-রপ্তানি কারকদের উপর তাদের প্রচ- প্রভাব রয়েছে।
এই ক্যাডারের পদক্রম হচ্ছে যথাক্রমে, সহকারী কমিশনার, উপ-কমিশনার, যুগ্ম-কমিশনার, অতিরিক্ত কমিশনার, কমিশনার এবং সদস্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। পদোন্নতি অতিরিক্ত কমিশনার পর্যন্ত ভালো, কিন্তু অনেকে যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার কমিশনার হওয়ার আগেই উপসচিব পদমর্যাদায় গিয় পুল সিস্টেমের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে উপসচিব হয়ে প্রশাসন (ক্যাডারে) চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ ক্যাডারের মতো এই ক্যাডারে ইমেজ সংকট অত্যন্ত খারাপ। অতিমাত্রায় দুর্নীতি এই ক্যাডারের একটি অভিশাপ।
যাদের শুধু টাকায় মন ভরে না, প্রভাব, ক্ষমতা এবং পরিচিতি চান তাদের এই ক্যাডারের না-আসা উত্তম। যারা চাকুরি বয়সের অন্তিমে এসে চাকুরি নেন, তাদের জন্য এই ক্যাডারই সবচেয়ে উত্তম। এই ক্যাডারের সদস্যরা যত টাকাই আয় করুক না কেন, তাদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এনবিআর-এর চেয়ারম্যান আসে প্রশাসন ক্যাডার থেকে। অতএব আপনি এই ক্যাডারকে শধু অর্থের জন্য প্রথম পছন্দে দেবেন কি না ভেবে দেখতে পারেন।
বিসিএস (কর)
বিসিএস (কর) ক্যাডারের সদস্যগণ অর্থমন্ত্রণালয়ের আইআরডি-এর আওতাধীন এনবিআর-এর নিয়ন্ত্রণে চাকুরি করেন। এনবিআর-এর চেয়ারম্যান থাকেন প্রশান ক্যাডারের সদস্য। এই ক্যাডারে চাকরি হলে আপনাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সহকারী কর কমিশনার হিসেবে যোগদান করতে হবে। আয়কর বিভাগ. সরকারের একমাত্র বিভাগ যা দেশের জন্য প্রত্যক্ষ রাজস্ব আহরণ করে থাকে। আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় এই ক্যাডারের সদস্যদের কাজের চাপ বাড়ে, তবে সারা বছর তেমন চাপ থাকে না। চাকুরির প্রথম দিকে ঢাকার বাইরে থাকতে হয়, তবে কয়েক বছর পর ঢাকায় পদায়ন হওয়ার সুযোগ বেড়ে যায়। সাধারণভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতা অনেক কম, তবে পদোন্নতি পেয়ে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে উপনীত হলে বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের উপর প্রভাব খাটানো যায়। এ সুযোগে অনেকে নানাভাবে আয় করার সুযোগ নিতে ছাড়েন না।
সরকারি বেসরকারি কোনো আয়ের বিষয়ে এই বিভাগের সদস্যরা গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে আহরিত রাজস্বের জন্য মোটা অঙ্কের গ্র্যান্ট অব অ্যাওয়ার্ড পাওয়া যায়। এই ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে- সদস্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং পদক্রম হচ্ছে যথাক্রমে, সহকারী কর কমিশনার, উপ কর কমিশনার, যুগ্ম কর কমিশনার, অতিরিক্ত কর কমিশনার, কর কমিশনার এবং সদস্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। চাকুরির শুরুতে সুবিধাদি ভালো হলেও কাস্টমস ক্যাডারের মতো নয়। পদোন্নতিও দ্রুত, তবে মাঝপথে গিয়ে স্থবির হয়ে যায়। এজন্য এই ক্যাডারের অনেক সদস্য যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার যুগ্ম-কর কমিশনার হওয়ার আগে উপসচিব হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অবসরে গেলে আয়কর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা যায়। আপনি যদি চাকুরির বয়স কম পান, তাহলে অল্পসময়ে চাকুরি করে কিছু মোটা আয় রোজগার করার জন্য এই ক্যাডারকে পছন্দের প্রথমদিকে রাখতে পারেন।
বিসিএস (নিরীক্ষা ও হিসাব)
এই ক্যাডারের নিয়োগ পেলে আপনি মহাহিসাব নিরীক্ষক এর কার্যালয়ে সহকারী হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে যোগদান করবেন। এখান থেকে আপনাকে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হবে এবং সেক্ষেত্রে পোস্টিং ভেদে পদের নাম ভিন্ন হতে পারে। তবে নাম যাই হোক কাজ প্রায় অভিন্ন। এখানে বিভিন্ন দপ্তরে চাকুরি করতে হলেও কাজে কোনো বৈচিত্র্য নেই। বিসিএস নিরীক্ষা ও হিসাব এমন একটি ক্যাডার, যে ক্যাডারের বিস্তারের চেয়ে রাজনীতিক প্রভাব তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত কম।
সরকারের যত হিসাব-নিকাশ এবং অর্থসংক্রান্ত তদন্ত আছে, তার সব এই ক্যাডারের সদস্যগণ করে থাকেন। মূলত সরকারের অর্থের হিসাব এবং তার যথার্থ ব্যয় ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এই ক্যাডারের অন্যতম কাজ। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন, পেনশন, ট্রেনিং বিল, জ্বালানি বিল, ক্রয়সহ যেখানে সরকারী অর্থ ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত সেখানেই এই ক্যাডার পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে থাকেন। সব ক্যাডারেই সরকারি অর্থ ব্যয় হয়। যেহেতু অর্থ ব্যয়ে অনিয়ম বা ভুলত্রুতি ধরা এই ক্যাডারের সদস্যবর্গের কাজ এবং ভুল যেহেতু ঘটেই, তাই সব অফিসে সব ক্যাডারই এই ক্যাডারের সদস্যদের সম্মান দিয়ে থাকেন। বিদেশ ভ্রমণও আছে প্রচুর। যেসব প্রকল্পের আর্থনীতিক তদারকির দায়িত্বে থাকা হয়, সেসব প্রকল্পের হর্তকর্তারাই আপনাকে বিদেশ নিয়ে যাবেন। আমিও করেছি।
দেশে-বিদেশে সরকারে সব অফিসেই এই ক্যাডারের সদস্যের প্রত্যক্ষ পদচারণা লক্ষণীয়। এই ক্যাডারের সদস্য হলে আপনি সম্মান পাবেন, কারণ আপনাকে অর্থ খরচ করতেই হয়, ভুলও হয়; না হলেও হয়। সঙ্গে প্রয়োজনীয় সুবিধাদিও পাবেন। সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিফ একাউন্টস অফিসার আছে। এই ক্যাডারে নব্বই ভাগ পদায়ন হয় ঢাকায় হয়। ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক; এটি একটি সাংবিধানিক পদ।
আপনি যদি সাংবিধানিক পদের অধীনে থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান এবং প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারসহ বাংলাদেশের সব ক্যাডারের সর্বোচ্চ সমীহ পেতে চান, সব অফিসে কাজ করতে চান এবং চাকুরির পরও কোনো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষা ও হিসাব বিভাগে কাজের অনুরোধ পেতে চান, তাহলে আপনাকে বলব, এটিই আপনার ক্যাডার পছন্দের তালিকায় প্রথম আসা উচিত।
বিসিএস (খাদ্য)
মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথম বিষয় হচ্ছে খাদ্য। কেউ খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারে না। মানুষের প্রাত্যহিক কর্মকা-ের মূলেই রয়েছে খাদ্য। তাই বিসিএস (খাদ্য) ক্যাডার নামের মধ্যে একটি অন্য রকম ভাব পাওয়া যায়। এই ক্যাডারে নির্বাচিত হলে আপনাকে প্রথমে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করতে হবে৷ সেখান থেকে আপনাকে খাদ্য অধিদপ্তরে ন্যস্ত করা হবে। এরপর খাদ্য অধিদপ্তর থেকে জেলায় পদায়ন করা হয়। সাধারণ জনগণের কাছে থেকে ধান, চাল, গম ইত্যাদি খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাজার স্থিতিশীল রাখা এবং বিদেশ থেকে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য আমদানি করা, ওএমএস, ভিজিএফ, ভিজিডি, কাবিখা, টিআর, ভিআর খাতে খাদ্যশস্য বিতরণ করাই এই ক্যাডারের কাজ। সরকারি খাদ্য গুদামগুলো এই ক্যাডারের সদস্যদের অধীনে পরিচালিত হয়।
চাকুরিতে যোগদানের পর প্রথমদিকে যাতায়াতের জন্য মাইক্রোবাস সার্ভিস পাবেন। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হলে গাড়ী পাওয়া যাবে। পদোন্নতি মোটামুটি সন্তোষজনক এবং কাজের চাপ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। রেডক্রিসেন্টসহ নানা আন্তর্জাতিক খাদ্যবিষয়ক সংস্থার সঙ্গে এই ক্যাডারের সদস্যদের কাজ করতে হয়। জেলা পর্যায়ে দায়িত্বকালীন খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীগণ বেশ সমীহ করে থাকেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে। এই ক্যাডারের পদক্রম হচ্ছে, সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, আঞ্চলিক পরিচালক, অতিরিক্ত পরিচালক, পরিচালক, মহাপরিচালক।
আপনি যদি কৃষকপ্রেমী হন, সাধারণ মানুষের অন্নের প্রতি আপনার দরদ থাকে এবং নিরিবিলি অবস্থায় থেকেও প্রত্যন্ত ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত প্রভাবপ্রতিপত্তির সঙ্গে কাজ করতে চান, তাহলে খাদ্য ক্যাডারকে পছন্দের তালিকায় প্রথম দিকে রাখতে পারেন।
বিসিএস (বাণিজ্য)
বিসিএস (বাণিজ্য) ক্যাডার খুব স্বল্প পরিচিত ক্যাডার। তবে ক্যাডার সদস্যবর্গের কাজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বাণিজ্য ও আমদানি রপ্তানিতে এই ক্যাডারের ভূমিকা রয়েছে। এই ক্যাডারে নিয়োগ প্রাপ্ত হলে আপনাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সহকারী নিয়ন্ত্রক হিসেবে যোগদান করতে হবে। পোস্টিং মন্ত্রণালয়ে অথবা যেকোনো বিভাগীয় শহরেও হতে পারে।
এই ক্যাডারের সদস্যদের বিদেশ ভ্রমনের সুযোগ আছে৷ দুতাবাসেও পোস্টিং পাওয়া যায়। যথাসময়ে পদোন্নতিও হয়। যাওয়া আসার জন্য গাড়ি সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে। কাজের চাপ কম বল প্রয়োজনীয় সময়ে ছুটি পাওয়া যায়। এই ক্যাডারের পদক্রমহচ্ছে, সহকারী নিয়ন্ত্রক, উপ-নিয়ন্ত্রক, যুগ্ম-নিয়ন্ত্রক, নিয়ন্ত্রক, উপ-প্রধান নিয়ন্ত্রক এবং প্রধান নিয়ন্ত্রক। এইসব সুবিধা পেতে চাইলে আপনার প্রথম পছন্দ হতে পারে বিসিএস (বাণিজ্য) ক্যাডার। অনেকে মনে করেন, এই ক্যাডারটি আসলে অপ্রয়োজনীয়, ধারণা করাহচ্ছে, ইকনোমিক ক্যাডারের মতো এটি প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একিভূত হয়ে যেতে পারে।
বিসিএস (আনসার)
বিসিএস আনসার ক্যাডারের সদস্য হলে আপনাকে নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আপনাকে প্রথমে আনসার ও ভিডিপি অধিদপ্তরের অধীনে সহকারী জেলা এ্যাডজুটেন্ট হিসেবে পদায়ন করা হবে। এই ক্যাডারের চাকুরিতে তেমন ঝামেলা নেই, দায়িত্বও তেমন কঠিন নয়। চাকুরি জীবনের শুরু থেকে গাড়ি, বাড়ি ও বর্ডিগার্ড সুবিধা পাওয়া যায়। পদোন্নতিও সন্তোষজনক। ভালোভাবে সবকিছু মানিয়ে নিতে পারলে মহাপরিচালক পর্যন্ত হওয়া যায়। মহাপরিচালকের উপরে যাওয়ার কোনো সুবিধা নেই। কারণ এর উপরের পদাধিকারীগণ প্রতিরক্ষা বাহিনী তথা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী বা বিমানবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে আসেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তার অধিনে থাকতে হয় বলে অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আনসার ক্যাডারকে প্রথম পছন্দে রাখতে চান না। বিভাগীয় ট্রেনিং হয় গাজীপুরে আনসার ও ভিডিপি একাডেমিতে। পুলিশের মতো এই বাহিনী আইন প্রয়োগকারী কতৃপক্ষ নয়, তারা কেবল সহায়ক বাহিনী হিসেবে কাজ করে।
রেজিমেন্টাল লাইফ তথা স্যালুট, ইউনিফরম, অস্ত্র, চাকুরির প্রথম থেকে সার্বক্ষণিক গাড়ি, বডিগার্ড ও বাসস্থান সুবিধা; র্যাব, এসএসএফ-সহ সকল আন্তঃবাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে এবং পুলিশের মতো সুযোগ-সুবিধাসহ ইউএন মিশনে গিয়ে বছরে ২০- ৪০ লাখ টাকা আয় করতে চান তাহলে আপনার জন্য এই ক্যাডার হতে পারে পছন্দের প্রথমদিকের একটি।
বিসিএস (তথ্য)
বিসিএস (তথ্য) ক্যাডারের সদস্য হলে প্রথমে আপনাকে সহকারী পরিচালক বা সমমানের পদে যোগদান করতে হবে। সহকারী পরিচালক (অনুষ্ঠান) পদে পদায়িত হলে টিভিতে ও বেতারে অনুষ্ঠান প্রচারের দায়িত্ব পালন করতে হবে। জেলায় বদলি হলে আপনার পদবি হবে জেলা তথ্য অফিসার। পদটি নামে বড়ো হলেও প্রভাব-বিস্তারক নয়। চাকুরিতে প্রবেশের অল্প সময়ের মধ্যে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। এটি ব্যক্তিগত পরিচয় বিস্তার করার অন্যতম একটি ক্ষেত্র। মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীগণের পিআরও বা চঁনষরপ জবষধঃরড়হং ড়ভভরপবৎ (চজঙ), বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কয়েকটা দূতাবাসে তথ্য কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে তথ্য কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করা যায়। এই ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে প্রধান তথ্য অফিসার। এই ক্যাডারে বেশি দিন চাকুরি করতে পছন্দ না হলে আপনি নির্দিষ্ট সময় পর পছন্দ দিয়ে উপসচিব হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারে চলে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। প্রচার মাধ্যমে কাজ করার আলাদা স্বাদ নিতে হলে এবং সহজে বিভিন্ন মিডিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে চাইলে, তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে আপনার প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত বিসিএস (তথ্য) ক্যাডার।
বিসিএস (ডাক)
বিসিএস (ডাক) ক্যাডারের সদস্য হলে আপনাকে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল বা পোস্ট মাস্টার জেনারেলের কার্যালয়ে সহকারী পোস্ট মাস্টার জেনারেল হিসেবে যোগদান করতে হবে। ডাক বিভাগের যাবতীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম, নথিপত্র প্রস্তুত ও রক্ষণ, যাচাই-বাছাই, দরপত্র প্রস্তুত, অধস্তনদের পদায়ন, পোস্ট অফিস সঞ্চয় প্রভৃতি দেখভাল আপনার কাজ। এখানে কাজের চাপ তেমন নেই, নয়টা হতে পাঁচটা পর্যন্ত চাকুরি। চাইলে ছুটি পাওয়া যায়। রাজশাহীতে পোস্টাল একাডেমিতে এই ক্যাডারের সদস্যদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পদোন্নতির গতি তেমন সন্তোষজনক নয়। প্রভাবও তেমন নেই। পদক্রম হচ্ছে যথাক্রমে, সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল, ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল, অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল, পোস্টমাস্টার জেনারেল, অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং মহাপরিচালক।এই ক্যাডার ভালো না লাগলে ১৮/২০ বছর চাকুরি করার পর আপনি উপসচিব হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে যেতে পারেন।
বিসিএস (সমবায়)
বিসিএস সমবায় ক্যাডারের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলে আপনার প্রথম পদবি হবে সহকারী নিবন্ধক। ওই নামের পদেই আপনাকে জেলা অফিসে যোগদান করতে হবে। জেলা ছাড়াও বিভাগীয় অফিস এবং সমবায়ের সদরদপ্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশ সমবায় একাডেমি ও আঞ্চলিক সমবায় ইন্সটিটিউটে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যাবে।
বিভিন্ন সমবায় সমিতির নিবন্ধন প্রদান, বার্ষিক অডিট সম্পাদন, বিভিন্ন সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঋণদান, সমবায় অধিদপ্তরকে শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় সমবায়ীগণের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা, সমবায় সমিতিতে সমবায় বাজার স্থাপনসহ অন্যান্য বিভাগীয় কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকিই হবে আপনার দায়িত্ব ও কর্তৃব্য। এই ক্যাডারে পদোন্নতি মোটামুটি তবে কাজের চাপ কম। বিভাগীয় ট্রেনিং হয় ঢাকায়। পদক্রম হচ্ছে যথাক্রমে সহকারী নিবন্ধক, উপ-নিবন্ধক, যুগ্ম-নিবন্ধক, অতিরিক্ত নিবন্ধক এবং নিবন্ধক। কাজের ধরণ সাধারণ, একমুখীনতা এবং যানবাহন সুবিধা ও প্রভাবপ্রতিপত্তি কম বলে এই ক্যাডার সাধারণত পছন্দের তালিকার নিচের দিকে অবস্থান করে। এই ক্যাডার ভালো না লাগলে ১৮/২০ বছর চাকুরি করার পর আপনি উপসচিব হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে যেতে পারেন।
বিসিএস রেলওয়ে পরিবহণ ও বাণিজ্যিক ক্যাডার
বিসিএস রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্যিক ক্যাডারের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেলে প্রথমে আপনাকে সহকারী ট্রাফিক সুপারিন্টেনডেন্ট পদে যোগদান করতে হবে। এই পদে চাকুরি করলে ক্রমান্বয়ে আপনি রেল পরিদর্শন অধিদপ্তরের পাশাপাশি রেলওয়ের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, রেলপথ মন্ত্রণালয়সহ প্রেষণে আরও অনেক উচ্চপদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন।
যোগদানের পর যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এবং রেলওয়ের প্রাশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন। পদোন্নতিতে ধীরগতি। এই ক্যাডারে কাজের চাপ কম। ছুটি পাবেন। চট্রগ্রামের রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমিতে সাড়ে চার মাসের বিভাগীয় প্রশিক্ষণ করার পর আপনাকে দায়িত্ব পালন শুরু করতে হবে। এই ক্যাডারের পদক্রম হচ্ছে : সহকারী ট্রাফিক সুপারিন্টেনডেন্ট > সিনিয়র সহকারী ট্রাফিক সুপারিন্টেনডেন্ট, ট্রাফিক সুপারিন্টেনডেন্ট, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, মহাপরিচালক। তবে মহাপরিচালক হওয়ার সম্ভাবনা এই ক্যাডার থেকে খুবই কম। কারণ রেলওয়েতে কারিগরি ক্যাডার থেকেই বেশির ভাগ মহাপরিচালক হয়ে থাকে। এই ক্যাডার ভালো না লাগলে ১৮/২০ বছর চাকুরি করার পর উপসচিব হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে আসার চেষ্টা করতে পারেন। অনেকে করেন।
বিসিএস (পরিবার পরিকল্পনা)
বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় এবং উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়। বিসিএস (পরিবার পরিকল্পনা) ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে আপনাকে এসব কার্যালয়ের যে-কোনো একটায় প্রথমে সহকারী পরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হবে। আপনার কাজ হবে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যাবতীয় কার্যাদি সম্পন্ন করা এবং দৈনিন্দিন প্রাশাসনিক কার্যাদি পরিচালনা করা। এই ক্যাডারের সদস্যদের অধিকাংশ সময় মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হবে।
স্থানীয় প্রশাসন বা প্রশাসন ক্যাডারের আওতায় থেকে সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং নিবিড় প্রচারণায় আত্মনিবেদিত থাকতে হবে। আপনার অধিক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনার সফল বাস্তাবয়ানের সব দায়িত্ব আপনার উপরই থাকবে। উপজেলা কাজ করতে হলে আপনাকে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার কিংবা তার পক্ষে সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করতে হবে। কয়েক বছর পর এমনও হতে পারে, আপনি এমন একটা উপজেলায় বদলি হয়েছেন, যে উপজেলায় আপনার ব্যাচম্যাট বা আপনার জুনিয়র উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দায়িত্বে আছেন। এজন্য এটাকে সাধারণত পছন্দের একেবারে শেষদিকে রাখা হয়। এই ক্যাডারের পদক্রম হচ্ছে যথাক্রমে, সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক, অতিরিক্ত পরিচালক এবং মহাপরিচালক। এই ক্যাডার ভালো না লাগলে ১৮/২০ বছর চাকুরি করার পর আপনি উপসচিব হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চলে যেতে পারেন।
এখানে বিসিএস-সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাসের সহায়ক কয়েকটি বইয়ের ছবি দেওয়া হলো। বইগুলো সংগ্রহ করতে পারেন:
আলমগীর ০১৯১৫১-৬৫৩৩৩ (পুথিনিলয়)।