ড. মোহাম্মদ আমীন
গাধার বৈজ্ঞানিক নাম ই. আফ্রিকানাস এসিনাস (Equus africanus asinus)। এটি Equidae বা ঘোড়া পরিবারের অযুগ্ম খুরযুক্ত একটি চতুষ্পদ প্রাণী। যা দীর্ঘকাল যাবৎ মানুষের গৃহপালিত পশু। গাধাকে বলা হয় ঘোড়ার খুদে, কিন্তু আধুনিক ও কার্যকর সংস্করণ।একই আকারের একটি গাধা, একটি ঘোড়ার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং অধিক উপকারী ও লাভজনক।গাধার চিন্তাধারা ঘোড়া থেকে স্বাধীন এবং মানুষের জন্য উপকারী।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী “বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থে লিখেছেন : “অগাধ মানে অনেক, গাধ মানে অল্প। গাধ এবং আ যোগ করলে গাধা হয় (গাধ + আ = গাধা)। আ বর্ণে আধার বুঝুন। গাধ-এর (অল্প জ্ঞানের) আধার হলেই সে গাধা। তার পায়ের সংখ্যা দুই না চার সেটা এখানে বিবেচ্য নয়। মূল কথা হল, গাধা কম বুঝে কিন্তু বেশী চ্যাঁচায়।” তাঁদের বর্ণিত ‘গাধা’ যদি পশু হয় তাহলে এ বক্তব্য ঠিক নয়। গাধা নামে পরিচিত পশুর চরিত্র কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বর্ণনার ঠিক উলটো। সম্ভবত তাঁদের বর্ণিত গাধা, পশু-গাধা নয়, মনুষ্যগাধা। যেসব মানুষ বুঝে কম কিন্তু চ্যাঁচায় বেশি ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এ তারাই গাধা। এর ইংরেজি ass নয়; গাধাই।
গাধা, ঘোড়া থেকে যেমন সচেতন তেমনি পরিচ্ছন্ন এবং চৌকশ। গাধা পানি ও খাদ্য গ্রহণে বেশ সচেতন।তাই গাধার জন্য পরিষ্কার পানি অপরিহার্য। সে প্রতিদিন ১০ থেকে ২৫ লিটার পানি পান করে এবং কখনো নোংরা পানি পান করে না। গাধার জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতা মানুষের গড় সাধারণ মানের কাছাকাছি। অল্প প্রশিক্ষণে গাধা প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠে, যা ঘোড়া অন্য কোনো প্রাণী এত তাড়াতাড়ি পারে না। গাধার স্মৃতিশক্তি অনেক ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে স্থায়ী, প্রখর ও তীক্ষ্ম। যতই ভৌগোলিক পরিবর্তন হোক না কেন, গাধা পঁচিশ বছর আগে ভ্রমণ করেছে এমন এলাকা এবং দেখা হয়ে যাওয়া অন্য গাধাদের নির্ভুলভাবে চিনে নিতে পারে। পৃথিবীর আর কোনো প্রাণী তা পারে না- এমনকি মানুষও।
গাধা প্রচণ্ড জেদি এবং আত্মরক্ষার প্রবল ক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী একটি অত্যন্ত অভিমানী ও স্পর্শকাতর প্রাণী। আকস্মিক ঘটনায় যে-কেউ চমকে ওঠে, কিন্তু গাধা কোনো ঘটনায় সহজে চমকে ওঠে না। এরা প্রচণ্ড কৌতূহলী, কিন্তু সচেতন ও সতর্ক। তারা নিজের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রেখে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। গাধার এ স্পর্শকাতর স্বভাবটির সঙ্গে বড়ো লোকের নতুন বউ কিংবা ধনীর আদুরে সন্তানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। মানুষের মতো গাধাও নিজের বাচ্চাকে বুদ্ধিমান প্রাণীদের মতো আগলে রাখে। শুধু তাই নয়, নিজের বাচ্চা ছাড়াও গাধা অন্য প্রাণীর বাচ্চাদের দায়িত্ব নিতে দেখা যায়। পশুপালকগণ মাতৃহারা অনেক পশুর বাচ্চাকে গাধা লালিত্যে ছেড়ে দেয়। গাধা ও বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মতো আদর করে। ভয় দেখিয়ে বা জোর করে গাধা থেকে কোনো কাজ করিয়ে নেওয়া প্রায় অসাধ্য। তবে আদর দিলে এরা প্রভুর জন্য সর্বেোচ্চ ত্যাগ স্বীকারেও কুণ্ঠিত হয় না।
গাধা সঙ্গপ্রেমী প্রাণী। তারা একা থাকতে চায় না। সঙ্গী হিসেবে স্বজাতি বা অন্য প্রাণী তাদের পছন্দ। প্রতিবন্ধীদের সঙ্গী হিসেবে গাধা প্রাচীনকাল থেকে খুব সহানুভূতিশীল এবং সহমর্মী প্রাণী হিসেবে পরিচিত। আধুনিক গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, গাধার সঙ্গে সময় কাটালে প্রতিবন্ধীরা মানসিকভাবে সুস্থবোধ করে। অসুস্থ বা আহত ঘোড়াদের সঙ্গী হিসেবেও গাধা অত্যন্ত উপকারী। গাধার আর একটি আকর্ষণীয় গুণ হচ্ছে নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা প্রদান। তাই বিশ্বের বিখ্যাত সব পশুপালকদের খামারের জন্য গাধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিজ্ঞ পশুপালক তার পশুরাজির নেতা হিসেবে একটি শক্তিশালী গাধাকে নির্ধরণ করে সব পশুর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন। গৃহপালিত পশুপাখিদের অন্য হিংস্র পশু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু গাধা, এমন একটি প্রাণী, তার নখর না-থাকলেও নেকড়ে বা অন্য হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে খামারের পশুকে আক্রমণের সংকেত জানিয়ে সজাগ করে দিতে পারে।
গাধা, আঁটসাঁট পথের মোড়ে সহজে বাঁক নিতে পারে। পিচ্ছিল পথেও সাবলীলভাবে চলতে পারে। বেড়া দেওয়া সরু ও আঁকাবাঁকা পথের মধ্যে দিয়ে চলতেও তার কোনো বেগ পেতে হয় না।এরা বড়ো-ছোটো সব ধরনের বোচকা যে-কোনো জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে। যানজটের মধ্যে অধৈর্য গাড়ির চালকরা যেখানে গাড়িতে বসে বিরক্ত হয়ে হর্ন বাজায়, সেখানে গাধারা সহজে নিজেদের পথ খুঁজে নিয়ে এগিয়ে যায়। গাধা যখন উলটো পথ দিয়ে একমুখী রাস্তায় প্রবেশ করলে, কোনো পুলিশই তাকে জরিমানা করার কথা চিন্তা করে না। একটা গাধার মূল্য ও লালন খরচ একটা মোটরগাড়ির ক্রয়মূল্য পরিচর্যা খরচের সঙ্গে তুলনা করলে গাধাই হয়ে যায় শ্রেষ্ঠ; এমনকি আইনস্টাইন-নিউটনের, এডিসন, তেসলা কিংবা ফোর্ড আর বিল গেটস-এর চেয়েও। পৃথিবীর সব বিজ্ঞানী মিলেও হয়তো গাধার মতো বুদ্ধিমান একটি কম্পিউটার আবিষ্কার করতে পারবে না। আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা পরিবহণের জন্য কত কিছু আবিষ্কার করেছেন, কিন্তু খরচ ও সর্বব্যাপী প্রয়োগ্য বিবেচনায় গাধার মতো একটা যন্ত্রও আবিষ্কার করতে পারেনি।
গাধা পালনে খুব একটা রক্ষণাবেক্ষণ খরচ নেই। এরা নিজেদের খাবার নিজেরাই যোগাড় করে নেয় এবং প্রায় সর্বভূক। ভালো ব্যবহার করা হলে গাধারা তাদের প্রভুদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠে। ধৈর্যশীল ও অভ্রান্তচারী পশু, গাধা হচ্ছে পরিবহণের এক আদর্শ মাধ্যম। এদের গন্তব্যপথ সম্পর্কে চমৎকার স্মরণশক্তি থাকে। সঙ্গে কেউ না গেলেও এরা পাঁচ/দশ মাইল দূর থেকেও জল নিয়ে আসতে পারে, যদি দু জায়গা থেকে একজন জল চাপিয়ে এবং আরেকজন তা নামিয়ে নেয়। এদের গলায় ঘন্টাও বাঁধা থাকে, যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আওয়াজ শুনে মালপত্র নিয়ে নিতে পারে। যদিও গাধারা কঠোর পরিশ্রমী কিন্তু এরা সবচেয়ে বেশি কতখানি ওজন বহন করতে পারবে ও সেইসঙ্গে কখন তাদের বিশ্রাম-প্রয়োজন, তা তাদের প্রভুকে জানিয়ে দিতে পারে। যখন বোঝা অত্যন্ত ভারী হয় কিংবা পিটে ব্যথা অনুভব করে তখন এরা শুয়ে পড়ে। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবাকে বলে গাধার শহর, ঢাকা যেমন রিকশার শহর। ওই শহরে ত্রিশ লাখ মানুষ আর গাধার সংখ্যা হচ্ছে উনত্রিশ হাজার।
বিশ্ব সভ্যতার ঐতিহ্য গড়ার ক্ষেত্রে মানুষের পর দ্বিতীয় কৃতিত্ব দিতে হয় গাধাকে। তৎকালে অগম্য পথে ভারী সব উপকরণ বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে গাধাকে।মিশরীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর অধিকাংশ ধাতুর বাহক ছিল গাধা। গ্রিস, রোম, ভারত প্রভৃতি এলাকায় সংকীর্ণ পথে কাজ করার জন্যও গাধা ব্যবহার করা হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন মরু ও দুর্গম অঞ্চলের অন্যতম বাহন গাধা।নবি অব্রাহাম মোরিয়া পর্বতে যাওয়ার সময় গাধায় চড়ে পাহাড়ি অঞ্চলগুলো পার হয়েছিলেন (আদিপুস্তক ২২:৩)। মোজেস (মুসা)-এর ইস্রায়েল জাতির ইতিহাসে গাধা ছিল প্রাত্যহিক জীবনের অনিবার্য সঙ্গী। বিজয়ী যিশু খ্রিষ্ট গাধায় চড়ে জেরুজালেম প্রবেশ করেছিলেন (মথি ২১:১-৯.)
তাহলে গাধাকে মানুষ গালি হিসেবে কেন ব্যবহার করে?
গাধার বিশ্বস্ততা অতুলনীয়। সে সহনশীল স্থৈর্য, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তীক্ষ্ম বুদ্ধি, প্রখর স্মরণশক্তি, জীবন এবং বিবেচনা বোধ কেবল প্রভুর মঙ্গলে নিবেদিত থাকে। প্রভুর জন্য সে কোনোরূপ ক্লান্তি ছাড়া সারাদিন পরিশ্রম করে। প্রভুর খরচ হবে বলে নিজের খাদ্য নিজেই খুঁজে নেয়- প্রভুর মঙ্গলের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার জন্যই কেবল বেঁচে থাকতে চায়; এ ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্য থাকে না।সে প্রভুর সঙ্গে প্রতারণা করে না, প্রভুর সব আদেশ মেনে চলে। প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করেও প্রভুর বোঝা বয়ে বেড়ায় নির্বিবাদে। তাই গাধাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ প্রাণী। গাধা নিজের মঙ্গল চিন্তা না-করে তার প্রভুর জন্য সারাক্ষণ নিঃস্বার্থভাবে শ্রম দিয়ে যায়। এজন্য ‘গাধা’কে মনুষ্য সমাজে গালি হিসেবে উপস্থাপন করে বলা হয়ে, গাধার খাটুনি, গাধার শ্রম, গাধার বুদ্ধি। যে নিজের লাভ বুঝে না, কেবল অন্যের লাভ করে বেড়ায় সে তো আসলে গাধাই- হোক না ছেলে, হোক না বাপ, ভাই বা স্বামী-স্ত্রী; তাতে কী?
এতগুলো গুণ যার, তাকে গাধা না বলে কী লর্ড ক্লাইভকে গাধা বলা হবে? মানুষ হিসেবে মানুষের সাধারণ স্বার্থ রক্ষা বা অর্জনের স্বভাব যদি আইনস্টাইন, নিউটন বা পৃথিবীর কল্যাণের সর্বোতভাবে নিবেদিত- এমন লোকদের কারো না-থাকত, তাহলে হয়তো গাধা গালিটা ওই নামটা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হতো। সৃষ্টি হতে এ পর্যন্ত অন্তত একটা গাধা যদি পৃথিবীর নেতা হতো তাহলে, পুরো পৃথিবীটাই হয়ে যেত প্রশান্তির উৎস।
Total Page Visits: 318 - Today Page Visits: 1
I like what you guys are up too. Such intelligent work and reporting! Keep up the superb works guys I’ve incorporated you guys to my blogroll. I think it will improve the value of my website :).