গিনি-বিসাউ (Guinea-Bissau) : ইতিহাস ও নামকরণ

কীভাবে হলো দেশের নাম (আফ্রিকা)

ড. মোহাম্মদ আমীন

গিনি-বিসাউ (Guinea-Bissau)

গিনি-বিসাউ উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র। এর সরকারি নাম গিনি বিসাউর দাপ্তরিক নাম রিপাবলিক ডা গিনি-বিসাউ। এর উত্তরে সেনেগাল, পূর্ব ও দক্ষিণে গিনি এবং পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর অবস্থিত। মূল মহাদেশীয় ভূখ- ছাড়াও সমুদ্রে অবস্থিত প্রায় ৬০টি দ্বীপও গিনি-বিসাউয়ের সীমানাভুক্ত। এদের মধ্যে বিসাগোস দ্বীপপুঞ্জ অন্যতম। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার পূর্বপর্যন্ত দেশটি পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল। তখন নাম ছিল পর্তুগিজ গিনি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশটি পর্তুগালকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতা লাভের ঔপনিবেশিক ‘পর্তুগিজ গিনি’ নাম অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে প্রতিবেশী গিনির নামের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি এড়ানোর লক্ষ্যে নামের সঙ্গে রাজধানী ও বৃহত্তম শহর বিসাউ যোগ করে নাম রাখা হয় ‘গিনি বিসাউ’।

আফ্রিকায় একটি জাতি আছে। নাম গিনি (Guinea), এ জাতির সীমান্তবর্তী দেশের নাম গিনি-বিসাউ। প্রতিবেশি, তাই নামের মিল থাকতে পারে কিন্তু এ দুটো দেশ হতে অনেক অনেক দূরে আর একটা দেশ রয়েছে। এর নাম ইকুয়েটরিয়াল গিনি (Equatorial Guinea)। তা কেন এবং কীভাবে হলো? এবার দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসা যাক। এখানেও একটি দ্বীপ আছে, নাম নিউ গিনি (New Guinea)। যার কিয়দংশ নাম গ্রহণ করেছে পাপুয়া নিউ গিনি (Papua New Guinea)। অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকায় রয়েছে, অন্য একটি শব্দ গায়ানা (Guinea। পূর্বের গিনি (Guinea) শব্দের সঙ্গে মিল আছে। এখানে আছে, গায়ানা (Guyana), ফ্রেঞ্চ গায়ানা (French Guiana) প্রভৃতি। গিনি-বিসাউ ক্রেয়োল (Creole) ভাষার শব্দ। শব্দটির আদি উৎস ইন্দো-ইউরোপয়িান ভাষা

অনেকে মনে করেন, গিনি শব্দটি পতুগিজ গিয়েন (Guine) নামের ইংরেজিকরণ। গিনি হচ্ছে ঘানা নামের অপভ্রংশ। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে লিও আফ্রিকানাস (Leo Africanus) বলেছেন, গিনি (Guinea) শব্দটি (Djenne) শব্দ হতে এসেছে। গিনি নাইজার বদ্বীপের বিখ্যাত স্থান জেনি (Djenne) নামের অপভ্রংশ। ঘিনাবেন, এগিনাও বা এগুইনাও (ghinawen, aginaw, or aguinaou) হতে গিনি নামের উদ্ভব। এর অর্থ পোড়া মানুষ অথবা কালো বা কৃষ্ণাঙ্গ। এখানকার লোকজন অত্যন্ত কালো ছিল। তাই দেখতে পোড়া কয়লার মতো মনে হতো। এজন্য ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা এলাকাটির নাম দিয়েছিল গিনি।

১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের রাজা দ্বিতীয় জন (Senhor da Guin) বা লর্ড অব গিনি (Lord of Guinea) পদবি ধারণ করেছিলেন। মনে করা হয়, পর্তুগিজরা এ শব্দটি বেরবের (Berber ) পদ গিনিওয়েন (Ghinawen) হতে নিয়েছে। যার অর্থ পোড়া মুখ (the burned face)। কৃষ্ণাঙ্গদের মুখ পোড়ামুখের মত ছিল। বার্বার ভাষায় এগিনাউ (`aginaw’ or `Akal n-Iguinawen’) অর্থ কৃষ্ণ বা কৃষ্ণদের দেশ (black” or “land of the blacks)।

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে লিও আফ্রিকানাস (Leo Africanus) বলেছেন, গিনি (Guinea) ) শব্দটি (Djenne) শব্দ হতে এসেছে। (Djenne) ছিল আপার নাইজার নদীর একটি বিখ্যাত ও সমৃদ্ধ শহর। এটি একাদশ শতকে ঘানার পতনের পর থেকে ত্রয়োদশ শতকে, মালির আক্রমণে ব্যবসায় সংকট দেখা না দেওয়া পর্যন্ত স্বর্ণ ও লবণ বাণিজ্যের জন্য পশ্চিম আফ্রিকায় একক আধিপত্য বিস্তার করে চলছিল। এ সময় ওই শহরটি আরবীয়দের কাছে গিনিওয়াহ (Genewah) নামে পরিচিত ছিল।এর অর্থ সম্পদ, স্বর্ণ বা মুদ্রা প্রভৃতি। অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশ মুদ্রা ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিভিন্ন এলাকায় গিনি নামে পারিচিত ছিল। এখনও অনেক দেশে গিনি বলতে মূল্যবান মুদ্রা বুঝায়। হয়তো, সে গিনি হতে এ নামের উদ্ভব।

দক্ষিণ আমেরিকায় প্রচলিত গিয়ানা (Guiana) স্থানীয় ভাষার শব্দ। এর অর্থ নদীর দেশ। কিন্তু আফ্রিকায় প্রচলিত গিনি (Guinea) শব্দটি এসেছে তুয়ারেগ (Tuareg) ভাষা হতে। এর অর্থ ভাষাহীন মানুষ (speechless people)। কারণ তুয়ারেগরা স্থানীয় ভাষা বুঝত না। সুতরাং দুটি নামের সামঞ্জস্যতা কেবল কাকতালীয়। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর উপকূলে তিনটি দেশ ছিল। যাদের নাম – British Guiana, Dutch Guiana Ges French Guiana ।

ব্রিটিশ গিয়ানা স্বাধীন হওয়ার পর নাম হয় গিয়ানা। ডাচ গিয়ানার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্চ গিয়ানা এখনও ফ্রেঞ্চ এর অংশ। আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূলে রয়েছে গিনি (Guinea), গিনি-বিসাউ (Guinea-Bissau), গিনি উপসাগর (the Gulf of Guinea) এবং ইকুয়েটরিয়াল গিনি (Equatorial Guinea)। প্রতিটি দেশ পৃথক হলেও নামটি এসেছে অভিন্ন উৎস হতে। যদিও নিউ গিনির কিয়দংশ ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে। এটাও আফ্রিকার দেশ গিনি হতে নামটি নিয়েছে বা পেয়েছে। কারণ অভিযাত্রীরা এ সকল ভূখ-ের আদিবাসীদের আচার-আচরণে সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিলেন। গিনি-বিসাউ ও কেপ বার্ডে দ্বীপপুঞ্জ ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এক দেশ ছিল। একটি অভ্যুত্থানের কারণে ভূখ-টি দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

গিনি-বিসাউর আয়তন ৩৬,১২৫ বর্গকিলোমিটার বা ১৩,৯৪৮ বর্গমাইল। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে জনসংখ্যা ১৬,৯৩,৩৯৮ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ৪৪.১। আয়তন বিবেচনায় গিনি-বিসাউ পৃথিবীর ১৩৬-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় ১৪৮-তম। অন্যদিকে, ঘনত্ব বিবেচনায় এটি পৃথিবীর ১৫৪-তম জনবহুল দেশ। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর দেশটি স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর পর্তুগাল হতে স্বাধীনতা লাভ করে।

২০১৪ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে গিনি-বিসাউর জিডিপি (পিপিপি) ২.৫০২ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ১,৪৩৯ ইউএস ডলার। অন্যদিকে, জিডিপি (নমিনাল) ১.০৪০ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৫৯৮ ইউএস ডলার। মুদ্রার ওয়েস্ট আফ্রিকান সিএফএ ফ্রাঙ্ক। রাজধানী বিসাউ। সরকারিভাবে গিনি-বিসাউর নাগরিকদের বিসাউ-গিনিয়ান বলা হয়। সরকারি ভাষা পর্তুগিজ।

রাজধানী বিসাউসহ গিনি-বিসাউ ৮টি অঞ্চল ও ৩৭টি সেক্টরে বিভক্ত। জলবায় গরম ও আদ্র। জুলাই হতে আগস্ট মাস পর্যন্ত বৃষ্টি পড়ে। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে সবচেয়ে উচুঁ বিন্দু ৩০০ মিটার। তবে এখনও এটির কোনো নাম রাখা হয়নি। আটলান্টিক মহাসাগর সবচেয়ে নিচু বিন্দু।

কাজুবাদা, মাছ, চিংড়ি, চিনাবাদা, পাম কার্নেল, চেরাইকাঠ প্রভৃতি গিনি বিসাউর রপ্তানি দ্রব্য। বয়স্কদের মধ্যে শিক্ষিতের হার ৩৯%। গড় আয়ু মাত্র ৪৬ বছর। অধিকাংশ লোক কৃষক। তারা গ্রামে ছোট ছোট কৃষিখামারে বাস করে। এখানে টিম্বার, গ্রানাইট, ক্লে, বক্সাইট, মৎস্য ও ফসফেট ছাড়াও আরও অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে জিডিপি বৃদ্ধির হার ২.৩%। বিসাউ ও বাপাতা দেশের বড় শহর। এটি একটি গরীব দেশ। জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ দারিদ্র্রসীমার নীচে বাস করে।

কীভাবে হলো দেশের নাম (Guinea) : ইতিহাস ও নামকরণ

ঘানা (Ghana) : ইতিহাস ও নামকরণ

রোয়ান্ডা (Rwanda) : ইতিহাস ও নামকরণ

সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম (আফ্রিকা), ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।

Language
error: Content is protected !!