গোরু: মনুষ্য সভ্যতার প্রথম প্রধানশিক্ষক

ড. মোহাম্মদ আমীন

বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘গোষ্ঠ’ অর্থ— গোশালা, গোচারণভূমি, সভাস্থল, জোট প্রভৃতি। গোষ্ঠ থেকে গোষ্ঠী। গোষ্ঠ বা গোশালার প্রধানকে বলা হতো গোষ্ঠীপতি। এখন বলা হয় অবস্থানভেদে— সর্দার, কুলপতি, নেতা, সভাপতি, সরকার প্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান প্রভৃতি। অভিধানমতে, বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘গোষ্ঠী’ অর্থ পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বংশ, গোত্র, দল, সম্প্রদায় প্রভৃতি। কিন্তু এমন নাম কেন?  কারণ, মানুষ গোরুদের কাছে নানা বিষয়ে নানাভাবে ঋণী। মানুষের সম্প্রদায় বা জোট প্রভৃতির গঠনবিষয়ক জ্ঞান গোরুর আচরণ থেকে প্রাপ্ত গো-বিষয়ক ধারণার নির্যাস। তাই মানুষের এতদ্‌বিষয়ক প্রথম গুরু গোরু, প্রথম প্রধানশিক্ষক গোরু, প্রথম উপাচার্য— তাও গোরু। ‘গবেষণা’ শব্দের বিশ্লেষণ করলে এটি আরও পরিষ্কার হবে। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন মর্যাদাশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ, লোগো বা অন্যান্য চিহ্নে এখনও গৃহপালিত পশুর ছাপ দেখা যায়। এটি  গোরুর প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতার প্রমাণ। এমন না করলেও চলত। কিন্তু করছে। অন্তত  এ বিবেচনায় হলেও মানুষকে অকৃতজ্ঞ প্রাণী বলা যায় না। 

মানুষ, মানুষের আগে গোরুকে গোষ্ঠীকলহ ব্যতীত যথাসম্ভব গোষ্ঠীসৌহৃদ্য বজায় রেখে দলবদ্ধ হয়ে বাস করছে দেখতে পায়। এখান থেকে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাসা করার শিক্ষা পেয়েছে। বর্তমান যুগের শহর, শিল্পকারখানা, বিক্রয়কেন্দ্র, রাজধানী, অফিস-আদালত, রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের কার্যালয়, যোগাযোগ কেন্দ্র, বন্দর প্রভৃতির মতো প্রচীনকালে গোশালা বা গোচারণ ভূমিই ছিল প্রভাবশালী-সহ সর্বস্তরের মনুষ্য সমাগমের প্রধান কেন্দ্র। অভিধানমতে, সংস্কৃত গোষ্ঠাগার মানে সভাগৃহ। এখন যেমন বিভিন্ন সভাগৃহে আলোচনা হয়, সভা হয়; তখন গোশালা বা গোচারণ ভূমিতে সভাদি হতো। নেতৃবৃন্দের পাশে মনের সুখে ঘাস খেয়ে চলত গোদল। গোষ্ঠীপতি ও ধর্মগুরুরা তদরক করত সব। গোরুর মলও ছিল গোরুর মতো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ধর্ম গঠনেও গোরুর অবদান ছিল।

শ্রীকৃষ্ণের অপর নাম গোপাল। গোশালা ও গোচারণ ভূমি অর্থাৎ গোষ্ঠই ছিল মানুষের একত্রিত হওয়ার প্রধান কেন্দ্র। গোশালা বা গোচারণভূমিতে একীভূত মানুষ মিথষ্ক্রিয়ার মাধম্যে গোষ্ঠী অর্থাৎ পরিবার, বংশ, দল, সম্প্রদায় প্রভৃতি গঠনের শিক্ষা বা প্রেরণা পেয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আগত সব অবতারই পশুপালক বা রাখাল হিসেবে কাজ করেছেন। রাখাল না-হয়ে কেউ অবতার হতে পারেননি। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি ইসলাম ধর্মের প্রচারক মুহাম্মদ (স.)ও রাখাল ছিলেন।  তখন রাখালগিরি ছিল খুবই সম্মানজনক পেশা, এখন যেমন সরকারি চাকুরি। তখন গোশালার রাখাল-নেতারা ছিল বর্তমান কালের ক্যাবিনেট সেক্রেটারি বা তদুর্ধ্ব মন্ত্রীর সমমর্যাদায়র প্রশাসক। গোশালা বা গোচারণ ভূমিকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে আধুনিক নগর, সভ্যতা, সভ্যতার কেন্দ্র, বিজ্ঞান, সম্পদ, সঞ্চয়প্রবণতা প্রভৃতি। এজন্য ভারতীয় হিন্দুদের অনেকে এখনও গোমূত্রকে মাতৃদুদ্ধের মতো পবিত্র মনে করে থাকে।

 গোষ্ঠী বা গোরুর পরিবার থেকে সৃষ্টি হয়েছে মানুষের দল, মানুষের সম্মিলন-স্পৃহা।  এজন্য মানুষের গোষ্ঠী, দল, সম্প্রদায়, সভা কিংবা মিলনকে গোসভা বা গোমিলন বলা যায়। মানুষের দল বলতে  মনে পড়ে যেতে পারে গোরুর দল।বস্তুত, মানুষের সভ্যতার সূচনায় গো নামক নিরীহ প্রাণীটার অবদান সবচেয়ে বেশি। তাই মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গোরুর কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণী।মানব সভ্যতা গোসভ্যতার পাদপীঠ।

গোষ্ঠী বানানে ঈ-কার। ব্যাকরণের কোনো সূত্র এই গোষ্ঠী ভাঙার অনুমতি দেয়নি। এজন্য  গোষ্ঠী যেখানে যাক, যার সঙ্গে কিংবা আগে-পরে যেখানে যুক্ত হোক না কেন, ঈ-কার অক্ষুণ্ন রেখে  সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে সেঁটে বসে। যেমন: গোষ্ঠীপতি, গোষ্ঠীশুদ্ধ, শাসকগোষ্ঠী, গোষ্ঠীবদ্ধ,  বিচ্ছিন্নগোষ্ঠী, সরকারিগোষ্ঠী, রাজকীয়গোষ্ঠী, গোষ্ঠীগত, গোষ্ঠীকল, গোষ্ঠসুখ প্রভৃতি।


All Link

বিসিএস প্রিলি থেকে ভাইভা কৃতকার্য কৌশল

ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা বইয়ের তালিকা

বাংলা সাহিত্যবিষয়ক লিংক

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক

বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১

Language
error: Content is protected !!