ঘানা (Ghana) : ইতিহাস ও নামকরণ

ড.  মোহাম্মদ আমীন

ঘানা (Ghana)

ঘানা, গিনি উপসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর অঞ্চলে অবস্থিত পশ্চিম আফ্রিকার একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এর পশ্চিমে আইভরি কোস্ট, উত্তরের বুরকিনা ফাসো, পূর্বে টোগো এবং দক্ষিণে গিনি উপসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর অবস্থিত। ঘানা বা গানা পশ্চিম আফ্রিকার একটি রাষ্ট্র। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এটি গোল্ড কোস্ট নামের একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। ওই বছর এটি সাহারা-নিম্ন আফ্রিকান দেশগুলির মধ্যে প্রথম দেশ হিসাবে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। আধুনিক ঘানার কয়েকশত মাইল উত্তর-পশ্চিমে ঊর্ধ্ব নাইজার নদীর তীরে অবস্থিত মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্য ঘানার নামে দেশটির নামকরণ করা হয়।

ঘানা, মেন্ডে ভাষার শব্দ। পশ্চিম আফ্রিকার সোনিনক (Soninke) জাতির লোকেরা ম্যান্ডে ভাষায় কথা বলতেন। এখনও সেনেগাল, আইভরি কোস্ট, দি গাম্বিয়া, মৌরিতানিয়া, গিনি-বিসাউ, গিনি ও ঘানায় এখানো প্রায় দশ লক্ষাধিক লোক এ ভাষায় কথা বলে। ম্যারেন্ড ভাষায় ঘানা (Ghana) শব্দের অর্থ সৈনিক রাজা (warriors king। মধ্যযুগের পশ্চিম আফ্রিকার ঘানা সাম্রাজ্যের রাজাগণ এ উপাধি গ্রহণ করতেন। অনেকে মনে করেন, ঘানা (ghana) নামটির উৎসমূলে রয়েছে গিনি (Guinea)। যা ফ্রেঞ্চ ভাষায ঢুকে, Guinoye হয়ে ম্যান্ডে ভাষায় ঢুকেছে। ব্যুৎপত্তি যেটাই হোক না কেন, ঘানা শব্দের সঙ্গে গিনি বা গায়ানা নামের কোনো সম্পর্ক নেই। ১৫শ ও ১৬শ শতকে যেসব ইউরোপীয় এখানে সোনার খোঁজে এসেছিল। তারা অঞ্চলটিকে গোল্ড কোস্ট নাম দেয়।

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে গোল্ড কোস্ট ব্রিটিশ টোগোল্যান্ডের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পর অথবা ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার পর জে বি ড্যানকোয়শের (J. B. Danquah) পরামর্শে প্রাক্তন মালিয়ান ঘানা সা¤্রাজ্যের (MalianGhana Empire) শাসকদের পদবির সম্মানার্থে দেশটির নাম ঘানা রাখার প্রস্তাব করেন। এর প্রাচীন নাম ছিল টোগোল্যান্ড এবং ব্রিটিশ টোগোল্যান্ড।

ঘানার মোট আয়তন ২,৩৮,৫৩৫ বর্গকিলোমিটার বা ৯২,০৯৯ বর্গমাইল। জলীয়ভাগের পরিমাণ ৪.৬১% বা ৪,২৪৭ বর্গমাইল। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে ঘানার মোট জনসংখ্যা ২,৭০,০০,০০০ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ১০১ জন। আয়তন বিবেচনায় ঘানা পৃথিবীর ৮২-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু মোট জনসংখ্যা বিবেচনায় ৪৫-তম। তবে, জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এট্ িপৃথিবীর ১০৩-তম জনবহুল দেশ। ঘানার মুদ্রার নাম চেদি এবং রাজধানী আক্রা। ঘানার নাগরিকগণ ঘানাইয়ান (এযধহধরধহ) নামে পরিচিত। সরকারি ভাষা ইংরেজি। এ ছাড়া আরও অনেকগুলো ভাষায় ঘানাইয়ানরা কথা বলে। সিংহভাগ লোক খ্রিস্টান। স্বল্পসংখ্যক মুসলিম এবং আঞ্চলিক ধর্মবিশ্বাসী লোকও দেখা যায়।

২০১৫ খ্রিস্টাব্দের হিসাবমতে, ঘানার জিডিপি (পিপিপি) ১৪৮.৫৯৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার (৭০-তম) এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৫,১২৩.৯১৩ ইউএস ডলার (১২৬-তম)। অন্যদিকে, জিডিপি(নমিনাল) ৫১.৫০৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার (৬৯-তম) এবং মাথাপিছু আয় ১,৭৭৬.১১৩ ইউএস ডলার (১২৬-তম)।

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ যুক্তরাজ্য হতে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ হতে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই পর্যন্ত রাজত্ব (জবধষস) ছিল। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ এপ্রিল বর্তমান সংবিধান গৃহীত হয়। স্বাধীনতার পর আফ্রিকান বাকী দেশগুলির স্বাধীনতার জন্য ঘানা নেতৃত্ব দেয়।

ঘানার অর্থনীতি আফ্রিকার অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতিগুলির একটি, কিন্তু এখনও কৃষি দেশটির অর্থনীতির মূল ভিত্তি এবং এখানকার বেশির ভাগ লোকই দরিদ্র। স্বর্ণখনিশিল্প, চকোলেটের উপাদান কোকা উৎপাদন এবং পর্যটন দেশটির আয়ের প্রধান উৎস। কয়েকশ বছর আগে ঘানা সোনার একটি উৎস বলে পরিচিত ছিল। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ঘানার এক কূটনীতিক কাফি আনান জাতিসংঘের মহাসচিব হন।

সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশসমূহের মধ্যে ঘানাই প্রথম, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ মার্চ উপনিবেশ শক্তি হতে স্বাধীনতা লাভ করে। গ্লোবাল পিচ ইনডেক্স (Global Peace Index) অনুযায়ী ঘানা আফ্রিকার সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশ। ভোল্টা অঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মনুষ্যনির্মিত হ্রদ ভোল্টার ৩.৬% ঘানার সীমানায় পড়েছে। ঘানার কারেন্সি চেদি’ স্থানীয় ভাষার শব্দ। স্থানীয় ভাষায় এর অর্থ কড়ি শেল (cowry shell) বা সামুদ্রিক শামুক। মুদ্রা বা টাকা আবিষ্কারের পূর্বে ঘানায় ওই শামুক বা কড়ি বিনিময়ের মাধ্যম ছিল। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে ঘানা উপকূলে তেল পাওয়া যায়। খনি শুরুর পাঁচ বছর পর হতে দৈনিক ২ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করা হয়। তেল আবিষ্কার ঘানার আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়।

আইভরি কোস্ট এর পর কোকো উৎপাদনে ঘানার স্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। ঘানা সা¤্রাজ্য লবণ ও স্বর্ণ বাণিজ্য শুরু করেছিল। এজন্য ব্রিটিশ ব্যবসায়ীগণ ঘানাকে গোল্ড কোস্ট নাম দিয়েছিল। ঘানানিয়ানসরা ১০টি অঞ্চলে ৪০টি ভাষায় কথা বলে। ইংরেজি সরকারি ভাষা হলেও ঘানার প্রত্যেক নাগরিক একাধিক ভাষা বলতে পারে। ঘানার পতাকায় অঙ্কিত কালো তারকা কিংবদন্তির প্যান আফ্রিকান নেতা মারকুস গার্ভেইর (Marcus Garvey) আন্তর্জাতি নিগ্রো উন্নয় সংস্থা (Universal Negro Improvement Association) ও আফ্রিকান কমিউনিটিস লিগ হতে গৃহীত। এর দ্বারা কৃষ্ণ মানুষ, তাদের সংহতি, উন্নয়ন ও বীরত্বকে প্রকাশ করা হয়েছে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ঘানার পতাকা গৃহীত হয়।

সূত্র : কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।

Language
error: Content is protected !!