ঘেটো লেটো নজরুল

 ইউসুফ খান

ঘেটো লেটো নজরুল

কালকে ঘেঁটুপুত্র নিয়ে শুবাচের একটা পোস্টে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে হুমায়ূন আহমেদের সিনেমা দেখা জ্ঞান নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। সেখানে ঘেঁটুগানকে অনেকে অহেতুক অপমান করেছেন। অনেক তর্ক-বিতর্কের মধ্যে এক আধটা অতি উৎসাহী জনকে দেখলাম নজরুলকে একজন ঘেঁটুপুত্র বলতে চাইছেন। ঠারেঠোরে এটাও বোঝাতে চাইছেন নজরুল কোনও বড়লোকের ঘেঁটু ছিলেন। তাদের মূল সাক্ষী হুমায়ূন আহমেদ এবং ওয়াকিল আহমেদ। এখানে আমার কিছু বক্তব্য আছে।

আমি বর্ধমানের গ্রামের ছেলে। লেটোর আঁতুড়ঘর বর্ধমান জেলা। আমাদের গ্রামে প্রতিবছর চৈত্রের ১৫ তারিখ থেকে ১৫ দিনের একটা মেলা হয়। সেখানে পনেরো-কুড়ি দিন ধরে প্রতি রাতে সারারাত লেটো হয়। আজও হয়। বহু যুগ আগে থেকেই হয়। তাই এ

ইউসুফ খান

ব্যাপারে আমার মুয়ানা অভিজ্ঞতা আছে, যেটা হুমায়ূন আহমেদের বা ওয়াকিল আহমেদের হয়তো নেই। কৈশোরে বহু লেটো দেখেছি। সেই অধিকারে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

লেটো মানে নেটো, নাট্য। লেটোতে মানুষের আটপৌরে সামাজিক জীবন নিয়ে সিচুয়েশনাল কমেডি তৈরি করে হাসি ঠাট্টার নাট্যপালা পরিবেশন করা হতো। সেখানে মূল আকর্ষণ ছিলেন সঙদার। উইটি হাজির-জবাব তাঁর ঠোঁটের ডগায় রেডি থাকতো। তিনি লেটো দলের সবচেয়ে বয়স্ক একজন লোক এবং তাঁকে ঘিরেই দলটা। দলের কোনও নাম থাকত না কিন্তু দলের পরিচয় হতো তাঁর নাম দিয়ে, যেমন কিরাই-এর দল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঙদারই হতেন দলের মালিক। সঙদারদের চেহারা কেলেকুলো রোগা শিরিঙ্গে বা বাঁটকুল হতো। যাদের চেহারা দেখলেই হাসি পায়। আমার প্রিয় দুই সঙদারের একজন ছিলেন চিমড়ে কালো, একজন বেঁটে কালো। অনেক সঙদারকে আমি খেটো ধুতি পরে, খালি গায়ে, কাঁধে গামছা ফেলে পুরোটা পালা পরিবেশন করতেও দেখেছি। সঙদার আসরে ঢুকলেই, তিনি মুখ খোলার আগেই আমরা বাচ্চারা হাসি হাসি মুখে দাঁত বার করে চৌকন্না হয়ে যেতাম, এই কী বলে ফেলে শোনার জন্য। সঙদাররা প্রান্তিক মুসলমান সমাজ থেকে উঠে আসা খেটে-খাওয়া চাষীভুষি মানুষ। ফসল তোলা শেষ হয়ে গেলে, হাতে চাষের কাজ না থাকলে, সঙদার তার দল নিয়ে লেটোর মাঠে নেমে পড়তেন। জীবন দিয়ে বোঝা দুঃখ কষ্টকে কথার মুক্তো দিয়ে পালায় পরিবেশন করতেন। কথার উইটে এবং ডবল মিনিং ভরা কানঘেঁষা কথা দিয়ে তিনি সারারাত আসর মাতিয়ে রাখতেন। একেক জন সঙদার এতই বিখ্যাত সেলিব্রিটি হতেন যে গোটা বর্ধমান জেলা এবং বীরভূম মুর্শিদাবাদের লোকেরা এক ডাকে এদের চিনতো। লেটো রাতে হতো। লেটোর দিন বিকেলে বিখ্যাত সঙদারের নাম আগে ঘোষণা হতো, সেই বুঝে আমরা সন্ধে থেকে মঞ্চের চারদিকে নিজের বোড়া চাটাই পেতে রাতে বসার জায়গার দখল নিয়ে রাখতাম।

লেটো পালা আগে থেকে বেঁধে রাখা হতো। প্রথমদিকের শো-তে বাঁধা কথাগুলো পুরোটা মুখস্থ না হলে পালাদারেরা ডায়লগ ভুলে যেতো। তখন উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে, দরকারে অন্য পালার ডায়লগ ঝেড়ে দিয়ে তারা দারুণ ম্যানেজ দিতো। পাঁড় দর্শক, যে অন্য গ্রামে পালাটা আগে দেখেছে, তার সব সিন মুখস্থ, সেও পর্যন্ত ম্যানেজ দেওয়া সিনটা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেতো। আমাদের গ্রামে একই রাতে পরপর দু-তিনটে পালা হতো, দুই বা তিনটে দলে করতো। শেষ পালা শেষ হতে হতে সকাল হয়ে যেতো। পালার কোয়ালিটি নিয়ে ভেতরে ভেতরে দলে দলে কম্পিটিশন ছিলো, কিন্তু কবিগানের লড়াই এর মতো কোনও লেটোর লড়াই হতোনা। কারণ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা পালা, আলাদা সময়ে অনুষ্ঠিত হতো। লেটোর লড়াই – এই ভুল কথাটা অনেকে বলছে কিছু না জেনেই।

মূলত মুসলমান নাট্যদল বলে এখানে পৌরাণিক কিছু নিয়ে কোনও পালা হতে দেখিনি। মেয়েরা লেটো করতো না বলে পালাতে নারী চরিত্রও থাকতো না। ধীরে ধীরে এক আধটা মহিলা লেটোয় আসতে শুরু করলে, পালাতে হয়তো একটা নারী চরিত্র ঢোকানো হতো। সে কম বয়সী মেয়ে হলে তাকে দিয়েই বাজার চলতি সিনেমার কোনও গানের সঙ্গে একটা আইটেম ডান্সও নাচিয়ে নেওয়া হতো, যার সঙ্গে মূল পালার কোনও সম্পর্ক নেই। দর্শকদের রাতজাগা ঢুলেপড়া চোখগুলোকে একটু চাঙ্গা করার জন্যই এই নাচগানের রিলিফ। লেটোর টার্গেট অডিয়েন্স ছিলো পালাদারদের মতই অন্যান্য খেটে খাওয়া চাষাভুষো মদ্দ মানুষ। দর্শকদের মধ্যে সব সম্প্রদায়েরই মানুষ থাকতো। আমাদের গ্রামের মহিলারা লেটো দেখতে যেতো না, নাকউঁচু ভদ্দলোকরাও লেটো দেখতো না। আমরা ছোটোরা তার মধ্যে গলে গিয়ে নিজেদের পেছন পাকাতাম। সকালে সঙদারদের দেওয়া ডায়লগ মুখস্থ বলতাম।

লেটোয় নারী চরিত্রে সরাসরি কোন মহিলাই অভিনয় করতো। মাখন মাখন চেহারার ফর্সা ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে নাচানো লেটোর দস্তুর ছিলোনা। তবে এক আধটা যাত্রাপালায় এটা হতে দেখেছি।

বর্ধমানের সঙদারের লেটো আর কলকাতার জেলেপাড়ার সঙ দুটো আলাদা জিনিস। ফর্ম কন্টেন্ট কন্টেক্সট এবং রিলিজিয়ান কানেকশন সবেতেই। এমনকি মুর্শিদাবাদের কাপ আলকাপ কাটাকাপ এগুলোর একটাও লেটো নয়।

মাঠে ময়দানে বসা লেটো আর ঘাটে ঘাটে ঘোরা ঘেটো – দুটো আলাদা জিনিস। লেটো সামাজিক, ঘেটো পৌরাণিক। লেটো পালা, ঘেটো গান। লেটো বসন্তে, ঘেটো বর্ষায়। লেটো মূলত মুসলমানদের, ঘেটো মূলত হিন্দুদের। লেটো রাঢ়ের, ঘেটো ভাটির। লেটো সঙদার-কেন্দ্রিক, ঘেটো লওন্ডা-কেন্দ্রিক। লেটো করে মরকুট্টে মিনশেয়, ঘেটো করে মাখন-মাখন মাকুন্দে।

লেটোর মিনশে সঙদার, কোনও বড়লোক কি কোনও জমিদারের খাট গরম করছে, এমন অলুক্ষুণে কথা জীবনে শুনিনি। তাছাড়া নজরুল ছিলেন লেটোর বাঁধনদার, সঙদারও না। রাঢ়ের লেটোর বাঁধনদার ভাটির ঘেটুর ছোকরা হবে, এটা একেবারে আবাতুলে কথা। তাই নজরুল ঘেঁটু এই ইঙ্গিত অত্যন্ত গর্হিত।

ইউসুফ খান, কলকাতা, ২০২০ জুন ০৮

সূত্র: ঘেটো লেটো নজরুল, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)

———————————————————-

ঈশ্বরচন্দ্র কেন শর্ম্মা, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)

বাঁকুড়া থেকে বগুড়া, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)

বেশ্যারা প্রস্টিটিউট নয়, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)

ইত্যাদি প্রভৃতি প্রমুখ. ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)

শুবাচ গ্রুপ এর লিংক: www.draminbd.com

All Link

All Links/1

All Links/2 শুবাচির পশ্ন থেকে উত্তর

উৎস: ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পবিলেকশন্স লি.

বাক্য: গঠন-অগঠন/১

বাংলা শব্দের পৌরাণিক উৎস, ড. মোহাম্মদ আমীন

মৌলবাদ ও মৌলবাদী শব্দের অর্থ কী জানতে চাই

বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পবিলেকশন্স লি.

আল্লাহ শব্দের বাংলা

শুবাচ বিসিএস বাংলা/১

শুবাচির প্রশ্ন থেকে উত্তর/৩২

শুবাচির প্রশ্ন থেকে উত্তর/ ৩৩

বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দের শুদ্ধ বানান/১২ ড. মোহাম্মদ আমীন

ইত্যাদি প্রভৃতি প্রমুখ

বেশ্যারা প্রস্টিটিউট নয়

বাঁকুড়া থেকে বগুড়া

ঈশ্বরচন্দ্র কেন শর্ম্মা

ঘেটো লেটো নজরুল

Language
error: Content is protected !!