ড. মোহাম্মদ আমীন
চর্যাপদ, চট্টগ্রামই চর্যাপদের জন্মভূমি চর্যাপদের ভাষা চট্টগ্রামের আদি আঞ্চলিক ভাষা আস্কর আলী পণ্ডিতের গানেও চর্যাপদের মতো বাক্য বিন্যাস |
চচর্যাপদ যে, বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই| এখন প্রশ্ন হলো, চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হলে নেপালে গেল কীভাবে? এবং এর উৎস বা লেখার স্থানই বা কোথায়? আলোচ্য প্রবন্ধে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।
বাংলাদেশে বৌদ্ধের আবির্ভাবের প্রারম্ভ হতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য ছিল। চর্যাপদের ভাষা, শব্দগঠন, না- বোধক শব্দের অবস্থান, উৎপত্তিগত ইতিহাস, রচয়িতাদের ধর্ম, প্রাকৃতিক পরিবেশ, আধুনিক চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ও চাটগাঁইয়া ভাষার সাহিত্যকর্ম প্রভৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, চর্যাপদের রচয়িতাগণের অধিকাংশই ছিলেন চট্টগ্রামের অধিবাসী এবং তাই তারা দোহা বা চর্যাপদ নামের যে কাব্য রচনা করেছেন, তা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়।
চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ইতিহাস সুপ্রাচীন। সুস্পা কাহ্নপো লিখিত Ôপাগসাম জোন-জন’ ও লামা-তারানাথ লিখিত Ôকাবাভদুন দন’ নামের তিববতীয় গ্রন্থে চট্টগ্রামে বৌদ্ধ প্রাধান্য ও তাদের ধর্মমুখী সাহিত্যচর্চার কথা উল্লেখ আছে। ওই গ্রন্থদ্বয় থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম `জালনধারা| প্রসঙ্গক্রমে, তখনকার চট্টগ্রাম বর্তমান বাংলাদেশের অংশ ছিল না।
খিস্ট্রীয় আনুমানিক অষ্টম শতকে পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামে পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। পণ্ডিতবিহারের অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। আধুনিক গবেষণা প্রতীয়মান হয়েছে যে, চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড়ের দক্ষিণাংশে ঝিওরী ও হাজিগাঁও গ্রামে পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল।
এখন দেখা যাক, চর্যাপদ কী? তিববত বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাত পন্ডিত শরচ্চন্দ্র দাস, লামা তারানাথ-এর তিববতী গ্রন্থ থেকে পন্ডিতবিহার সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি গ্রন্থ দুটি পর্যালোচনা করে বলেছেন, পূর্ববঙ্গে মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মবিষয়ক শিক্ষা ও ধর্মপ্রচারের প্রধান কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রামের পন্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ অধ্যাপনা, অধ্যয়ন ও যোগ সাধনার পাশাপাশি অবসর-অবকাশে যে সব গান-দোঁহা রচনা করেছিলেন তাই পরবর্তীকালে চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষা ও বাংলা কাব্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত লাভ করে।
পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে অনুমান ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চট্টগ্রামের চক্রশালায় একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল। এটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর চক্রশালা পূর্ববঙ্গে সাহিত্যসাধনা ও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত। সিদ্ধাচার্যগণ এখানে বসে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ভাষা তথা প্রাচীন বাংলা ভাষায় বিভিন্ন কবিত, পদ প্রভৃতি রচনা করতে শুরু করেন। এগুলোই হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনের সূচনা।
চট্টগ্রামে বসে এসব চর্যা বা দোহাগাণ রচিত হয়েছে বলে, চর্যাপদের বাক্যের গঠনে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। এ প্রসঙ্গে কবি ভূসুকপাদের একটি পদ চর্যাপদ উল্লেখ করা যায় :
কাহেরে যিনি মেলি আছহ কীস,
বেড়িল পড় অ চৌদীষ।
আপনা মাংস হরিণা বৈরী,
খনহন ছাড় ভূসুক আহেরি।
তিন ন’চ্ছই হরিণা পিবই ন’পানী,
হরিণা হরিণীর নিল অন জানি।
এখানে বর্ণিত আছহ কীস, খনহন ছাড়, ন’চ্ছই ন’পানী, অন জানি প্রভৃতি শব্দগুচ্ছের ব্যবহার কেবল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দেখা যায়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় না- বোধক শব্দ বাক্যের আগে বসে। চর্যাচর্য বিনিশ্চয়ের চর্যাসমূহে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার এমন নজির বহু রয়েছে।
এবার দেখা যাক, বাংলার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ কীভাবে নেপাল গেল। পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর চক্রশালা বৌদ্ধ বিহারের সমদুয় কাগজপত্র দেয়াঙ পাহাড়ে অবস্থিত পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। পন্ডিতবিহারের প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন পটিয়া উপজেলার চক্রশালায় জন্মগ্রহণকারী প্রজ্ঞাভদ্র। প্রজ্ঞাভদ্র সংস্কৃত ও পালি মিশ্রিত ভাষায় ছয়টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ইতিহাসবেত্তাদের ধারণা, প্রজ্ঞাভদ্রের জন্মস্থান চট্টগ্রাম হলেও তিনি সারা জীবন চট্টগ্রাম কাটাননি। অনেক ইতিহাসবেত্তা প্রজ্ঞাভভদ্র লিখিত অচিন্ত্য মহামুদ্রনাম গ্রন্থটি বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এটি ‘যশঃপালপুরঃ’ নামক স্থানে লিখিত হয়েছিল। স্থানটি নেপালে অবস্থিত। তিনি চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেপাল যাবার সময় সঙ্গে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গ্রন্থ নিয়ে যান। তার সঙ্গে চর্যাচর্য বিনিশ্চয় গ্রন্থসমূহও ছিল। যা ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগার হতে উদ্ধার করেন।
অতএব দেখা যায়, চর্যাপদ চট্টগ্রামে বসে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হয়েছে। তাই বলা যায়, বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হচ্ছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। চর্যাপদ চট্টগ্রামের লোকগানের আদিরূপ।
চর্যাপদের গীতিকাগুলোর সুরছন্দ, লয়তান ও বিন্যাস-দ্যোতনায় চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ভাষার গানের অনুভব পাওয়া যায়। মধ্য যুগের কবিদের মধ্যে আলাওল, সৈয়দ সুলতান, দৌলত উজির বাহরাম খান, মোহাম্মদ মুকিম, আব্দুল হাকিম প্রমুখ প্রসিদ্ধ কবিদের নাম আমরা পাই।
চর্যাপদের পূর্ব থেকে শুরু হয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক লোকগীতি ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে। চতুর্দশ শতক হতে ঊনবিংশ শতক ছিল চট্টগ্রামের আঞ্চলিক লোকগীতির স্বর্ণযুগ। এসময়কালের লোকগীতিকারদের মধ্যে আলী রজা ওরফে কানুফকির (১৭৫৯-১৮৩৭), শতকে আস্কর আলী পণ্ডিত (১৮৪৬-১৯২৭), আবদুল জলিল সিকদার (১৮৫৭-১৯৩৪), সেকান্দর গাইন (১৮৬০-১৯৪২), খাদেম আলী (১৮৭০-১৯৪৭) প্রমুখের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আস্কর আলী পণ্ডিতের বারমাসী ‘ইন্না আমীনের বারমাস’ একটি হৃদয়বিদারক কাব্যকথা। এখানে ইন্না আমীন নামক পুত্রের অকাল মৃত্যুতে আলীমদ্দির বিলাপ মূর্ত হয়েছে। কথিত হয়, ওই সময় আস্কর আলী পণ্ডিতের একজন সন্তান মারা যায়। পুত্রশোকে বিপর্যস্ত আস্কর আলীর শোক এখানে ফুটে ওঠেছে।


আস্কর আলী পণ্ডিতের মাজারে
লোক কবি আস্কর আলী পণ্ডিত ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চ বর্তমান সাতকানিয়া উপজেলার পুরণাগড়ে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকাল হতে সপরিবারে পটিয়া উপজেলার শোভনদন্ডি গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাঁর পিতার নাম মোসরফ আলী এবং পিতামহের নাম দোলন ফকির। তিনি ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ মতান্তরে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ নিজ গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত তাঁর পুঁথি-পুস্তিকা – জ্ঞান চৌতিষা, পঞ্চসতি পেয়ারজান,গানের বই -গীত বারমাস, নন্দ সাগর, নন্দ বিলাস, বর্গশাস্ত্র প্রভৃতি অন্যতম।
জ্ঞান চৌতিসায় তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন –
তথা হীন মুই দীন আস্কর আলী নাম
দুঃখের বসতি এই শোভনদন্ডী গ্রাম।
ধনজনহীন আর বুদ্ধি বিদ্যাহীন
তেকারণে নিজ কর্ম্মে নয় মনলিন।
জনক মোসরফ আলী গুণে সুরচির
তান পিতা নাম শ্রেষ্ঠ দোলন ফকির।
পন্ডিত আস্কর আলীর বাল্যকাল ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। জ্ঞান চৌতিসা রচনায় তিনি লিখেছেন-
ধনজন হীন বিদ্যা শিখিতে না পারি।
কিঞ্চিত দিলেক প্রভু সমাদর করি।
আস্কর আলী পণ্ডিত ছিলেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ধারার লোকগানের শিল্পী। তাই আস্কর আলীর লেখায় তার পূর্ববর্তী ও সামসময়িক কবিয়াল/ লোকশিল্পীদের প্রভাব রয়েছে। তেমনি তাঁর পরবর্তী শিল্পিী কবিদের গানেও আস্কর আলী পণ্ডিতের প্রভাব লক্ষণীয়। শিক্ষিত ছিলেন না বলে, তৎকালীন আধুনি সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। তবু তার রচিত গান চট্টগ্রামের গ্রামীণ সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল। তাঁর পিতামহ দোলন ফকিরও লোকসংগীত শিল্পী ছিলেন।
আস্কর আলী পন্ডিত আঠার-ঊনিশ শতকের লোককবি আলী রজা ওরফে কানুফকির (১৭৫৯-১৮৩৭) এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
আস্কর আলী পন্ডিতের তিন স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী রাহাতুননেছা, দ্বিতীয় স্ত্রী মিছরিজান ও তৃতীয় স্ত্রী আতরজান। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে লতিফা খাতুন প্রকাশ লেইস্যা খাতুন, দ্বিতীয় স্ত্রীর
গর্ভে আবদুল ছমদ ও বাচা মিয়া, তৃতীয় স্ত্রীর গর্ভের সন্তান-সন্ততিদের নাম ছিল : আবদুর রশিদ, ছমন খাতুন, ফজরজান, নছিমন, বদল মনির আলী মোট ৬ সন্তান।
কি দুঃখ দি গেলা মোরে এবং ডাইলেতে লড়ি চড়ি বইও তার লেখা গানের মধ্যে জনপ্রিয় দুটি গান।
আস্কর আলী পণ্ডিতের লেখা গান করছেন পণ্ডিতের নাতি। শুনুন : আস্কর আলী পণ্ডিতের নাতির কণ্ঠে আস্কর আলী পণ্ডিতের গান।