প্রথমেই বলে রাখছি, আমার এ লেখায় আমি চামড়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে সাফাই গাইছি না, তাদের চক্রান্ত ও অনৈতিক সুবিধা পাওয়ার অনুকূলে সরকারের এবং আমাদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত, অযোগ্যতা এবং খামখেয়ালী ও হুজুগে মনোভাবকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। যা অনেকে এড়িয়ে যান। ব্যবসায়ীরা লাভের জন্যই ব্যবসায় করেন, তবে লাভ যেন দেশের ক্ষতি না করে, জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা দেখার এবং সে মতে যোগ্য স্থাপনা গড়ে তোলার ও কার্যকর নজরদারি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সরকারের। তা আমরা কতটুকু পেরেছি?
২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কয়েকটি পত্রপত্রিকায় হাজারিবাগের ট্যানারিশিল্পের বিরুদ্ধে জোরেসোরে লেখালেখি শুরু করে। অভিযোগ – “হাজারিবাগের চামড়াশিল্প পরিবেশ দূষণ করছে, বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষতিকর ভারী ধাতু, বুড়িগঙ্গার পানিকে করে দিচ্ছে বিষ। চামড়াশিল্প এখান থেকে সরিয়ে দিলে ঢাকা দুষণমুক্ত হবে।” যে দেশের জনগণ যত অজ্ঞ ও অদূরদর্শী এবং হুজুগে সে দেশের জনগণ পত্রিকার খবরের উপর তত বেশি নির্ভরশীল। তারা কোনো বিবেচনা ছাড়াই পত্রিকার খবরকে বিজ্ঞানবাক্য মনে করে সদ্য পা-গজানো ব্যাঙের মতো লাফালাফি শুরু করে দিল। পত্রিকার খবর পড়ে জনগণের বিশ্বাস হলো, এমন করা হলে ঢাকা শহর সত্যি সত্যি দূষণমুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের এটি ভাবার মতো প্রজ্ঞা ছিল না যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা আধুনিক শিল্পই পরিবেশ দূষণ করে এবং বাতাসে ভারী ধাতু ছড়ায়। অধিকন্তু, ট্যানারিশিল্প সরিয়ে যেখানেই নেওয়া হোক না কেন, সেখানেও পরিবেশ দূষণ হবে। পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য প্রয়োজন “কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন”, যার দায়িত্ব পুরোপুরি সরকারের, কিন্তু সরকার যা করতে পারেনি; অথচ এ নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা ছিল না এবং নেই। যত দোষ সব চামড়া ব্যবসায়ীদের, অন্যরা কী ধোয়া সিরামিকের চকচকে প্লেট?
হাজারিবাগ ট্যানারি-শিল্প অঞ্চলের বিরুদ্ধে লেখালেখির সুযোগে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন-পন্থি আইনজীবি মোনজিল মোরশেদ হাইাকোর্টে একটা রিট করে দেন- “ঢাকা শহরের মানুষকে বাঁচানোর জন্য হাজারিবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সরিয়ে দিতে হবে।” রিটের পর ট্যানারি শিল্পের মালিকগণ অস্থিরতায় পড়ে যান। তাদের অস্থিরতা চামড়া শিল্পে ভর করে। ফলে শক্তিশালী চামড়া শিল্প নড়বড়ে হতে শুরু করে। মূলত এটাই চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
রিট হওয়ায় জনগণ মহাখুশি। হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নিলে ঢাকা ভুটানের মতো কার্বন ঋণাত্বক দেশ হয়ে যাবে। মানুষের কোনো রোগ হবে না; হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা পুরিয়ে যাবে।ঢাকার হাসপাতালের জায়গায় মুরগির ফার্ম দেওয়া যাবে। জনগণ আর পত্রপত্রিকার এ হুজুগ বিচারকদের উপরও ভর করলো। হাইকোর্ট ট্যানিারি সরিয়ে নেওয়ার রায় দিল। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিনপন্থী প্রধান বিচারপতি ইসকনভক্ত এসকে সিনহা সুপ্রীম কোর্ট-এর আপিল বিভাগ থেকে চূড়ান্ত রায় দিলেন- “হাজারিবাগের ট্যানারিগুলো দ্রুত সরিয়ে দিতে হবে।”
আদালতের রায় ও পত্রিকার প্রচারে অসহায় সরকার সিনহার আদেশের পর হাজারিবাগের ট্যানারি অঞ্চলে গ্যাস-পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। জনগণ উৎফুল্ল – এবার সত্যি সত্যি ঢাকা হয়ে যাবে সুইজ্যারল্যান্ডের জেনেভা। বুড়িগঙ্গা হয়ে যাবে যুবতীগঙ্গা, লেক জেনেভা; কিন্তু এ হাসি যে অপরিনামদর্শী, অদূরদর্শী হুজুগেরা তা বুঝল না, যেমন বুঝেনি- আদমজি বন্ধ করে দেওয়ার মতো আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের পরিণতি। সরকার ঘোষণা করল, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে সকল কারখানা সাভারে স্থানান্তর করতে হবে। কিন্তু নতুন এ শিল্প নগরে আধুনিক কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) চালু না হওয়ায় শিল্প বর্জ্য দূষণ করছে ধলেশ্বরীকে।
রায়ের পর ট্যানারির মালিকগণ পড়ে গেলেন মহাবিপদে। কয়েকশ বছরের চেষ্টায় গড়ে উঠা ট্যানারি শিল্পকে রাতারাতি সরিয়ে ফেলতে হবে- এটি সহজ কথা নয়। তাদের গুদামে লাখ লাখ টুকরো চামড়া পড়ে আছে। এগুলো রাখার জন্য নতুন স্থানে নতুন গুদাম তৈরি, স্থানান্তর এবং নতুন স্থানে নতুনভাবে কারখানা গড়ে তোলার কথা মুখে বলা যত সহজ, বাস্তবে তা ছিল অত্যন্ত কঠিন। জায়গা ক্রয়, ভবন-নির্মাণ, স্থানান্তর প্রভৃতি ছিল বিশাল খরচের বিষয়। সব মালিকের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। সম্ভব হলেও এটি ছিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার; অথচ হাজারিবাগে গ্যাস-বিদ্যুৎ নেই। তাদের দুরবস্থা দেখে জনগণ হাসল, কিন্তু এটি ভাবল না যে- চামড়াগুলো যদি তারা গুদাম ও প্রক্রিয়াজাত করার সুযোগ না পায়, তাহলে কিনবে না। সেক্ষেত্রে সারা দেশই দূষিত হয়ে পড়বে, সারা দেশই বিষাক্ত ভারী ধাতুতে ভরে যাবে। হলোও তাই। হাজারিবাগের ব্যবসায়ীরা সত্যি সত্যি বিপদে পড়ে গেল। এ অবস্থায় অনেক চামড়া ব্যবসায়ী নামমাত্র মূল্যে নিজের চামড়ার চেয়ে সযত্নে রক্ষিত ‘পশুর চামড়া’ বিক্রি করে দিল, অনেকে চামড়া শিল্প থেকে সরে গেল। চামড়ার ক্রেতা কয়েক মাসের মধ্যে ৯০ ভাগ হ্রাস ফেল একই সঙ্গে হ্রাস ফেল ৯০ ভাগ দাম।
২০০৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরের কাজ শুরু হয়। তবে এখনো শিল্প মন্ত্রণালয় তা শেষ করতে পারেনি ।কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) প্রস্তুত করা হয়নি। ফলে বর্জ্য সরাসারি নদীতে ফেলা হচ্ছে। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। ফলে বাংলাদেশের চামড়াশিল্প আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (LWDG)- এর সনদ পায়নি। সেজন্য বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশের চামড়া কিনছেন না।তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে- এ সুযোগে চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম কমানোর যৌক্তিকতাকে যা নয়, তার চেয়ে আরো প্রকটভাবে তুলে ধরে অনৈতিক কিছু সুবধিাও আদায় করে নিচ্ছে। সরকার বর্ণিত কারণে তা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয় মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী এবং তৃণমূল বিক্রেতাগণ।
প্রতিবছর কুরবানি উপলক্ষ্যে প্রায় ৫৬ লাখ গরুর চামড়া এবং ৩৮ লাখ ছাগল-মহিষ-ভেড়ার চামড়া-সহ মোট ৯৪ লাখ চামড়া সংগ্রহ করা প্রয়োজন হয়। যার প্রায় সবগুলোই হাজারিবাগের চামড়া ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করত। কিন্তু রাতারাতি, হাজারিবাগের ট্যানারি শিল্প বন্ধ করে দেওয়ায় এ বিপুল সংখ্যক চামড়া মওজুদ ও প্রক্রিয়াজাত করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে গেল। ফলে, দুই হাজার টাকা মূল্যের চামড়ার দাম নেনে এল দুইশ টাকার নিচে। কোথাও তা হয়ে গেল ত্রিশ-চল্লিশ টাকা। এক হিসেবে দেখে গেছে প্রতি চামড়ায় ক্ষতি হচ্ছে ১২০০ টাকা। সে হিসেবে শুধু এক ইদে সর্বমোট ক্ষতি হয় ১১২৮ কোটি টাকা।
শতবর্ষের চেষ্টায় গড়ে উঠা হাজারিবাগ থেকে অসহায় ট্যানারি মালিকগণ তাদের কারখানা সাভারে সরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন, কিন্তু কাজটি কি এত সহজ? টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কয়েক মিনিটে, কিন্তু এটি গড়তে লেগেছিল এক যুগের অধিক সময়। এখানেও হলো তা, রাতারাতি হাজারিবাগের ট্যানারি শিল্প ধ্বংস হয়ে গেল; কিন্তু তখন নতুন স্থানে বলতে গেলে কোনো স্থাপনাই গড়ে তোলা হয়নি। তাহলে তারা কোথায় রাখবে চামড়া, কোথায় করবে এত চামড়ার প্রক্রিয়াজতকরণ? আন্তর্জাতিক বাজারেও দাম পাচ্ছে না, কী করবেন তারা? ফলে সারা দেশই হয়ে গেল ট্যানারি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় :
To provide the best experiences, we use technologies like cookies to store and/or access device information. Consenting to these technologies will allow us to process data such as browsing behavior or unique IDs on this site. Not consenting or withdrawing consent, may adversely affect certain features and functions.
Functional
Always active
The technical storage or access is strictly necessary for the legitimate purpose of enabling the use of a specific service explicitly requested by the subscriber or user, or for the sole purpose of carrying out the transmission of a communication over an electronic communications network.
Preferences
The technical storage or access is necessary for the legitimate purpose of storing preferences that are not requested by the subscriber or user.
Statistics
The technical storage or access that is used exclusively for statistical purposes.The technical storage or access that is used exclusively for anonymous statistical purposes. Without a subpoena, voluntary compliance on the part of your Internet Service Provider, or additional records from a third party, information stored or retrieved for this purpose alone cannot usually be used to identify you.
Marketing
The technical storage or access is required to create user profiles to send advertising, or to track the user on a website or across several websites for similar marketing purposes.