চিলেকোঠার অফিসার
অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ
চিলেকোঠার অফিসার’ ড. মোহাম্মদ আমীনের লেখা একটি উপন্যাস। গুলশানের অভিজাত এলাকায় সরকারের বরাদ্দকৃত ফ্লাটে

নয়তলা বাড়ি করেছেন মুহিবুল হক চৌধুরী। তিনি ছিলেন সচিব। চাকুরি হতে অবসরের পর তিন ছেলেকে সহায়সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে দিলেন। এরপর হতে তার এবং তার স্ত্রীর কদর কমতে থাকে। দুই ছেলে তাদের ভাগে পাওয়া বাবার সম্পত্তি বড়ো ছেলে সাজ্জাদের কাছে বিক্রি করে দেশ ত্যাগ করল। বড়ো ছেলে প্যরালাইসিস রোগে আক্রান্ত মাকে রাতে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলল। বাবাকে তুলে দিল ছাদের উপর চিলেকোঠার রুমে। যেখানে একসময় তাদের বাড়ির ড্রাইভার থাকত। খাওয়া-দাওয়াও দেওয়া হতো না ঠিকমতো। অকথ্য নির্যাতনে অতীষ্ঠ হয়ে ওঠনে প্রাক্তন সচিব। একদিন সচিব সাহেব বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। ভিক্ষা শুরু করলেন রাস্তায়। ভিক্ষুক হিসেবে মারা গেলেন পথে। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করল আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম। উপন্যাসটির কয়েকটি পঙ্ক্তি নিচে দেওয়া হলো:
কাঁদো কাঁদো গলায় ভিক্ষুক লোকটি বলল, আমি চলে যাব, কিন্তু কোথায় যাব? এমন শীতে রাস্তায় থাকলে জমে যাব। মরতে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু মরার আগে মরব কেন, স্যার? প্রতিদিন আমি মানুষের আচরণ আর কষ্টমমতার নতুন অভিজ্ঞতায় ভরে উঠছি। তাই মরতে চাই না সহজে। মানুষ কেবল বাঁচার জন্য বাঁচতে চায় না, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বাঁচতে চায়।
লোকটির কথা আমাকে রাষ্টনায়কের চেয়ে রাষ্টবিজ্ঞানী হিসেব সমধিক খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪র্থ প্রেসিডেন্ট জেমস মেডিসনের কথা মনে করিয়ে দিল। প্রেসিডেন্সিয়াল অভিষেক অনুষ্ঠানে মেডিসন বলেছিলেন, “আমি দেখতে বৃদ্ধ, জীর্র্ণ; ছোটোখাটো এবং শীর্ণচর্মে আবৃত কুঁচকে যাওয়া একজন সাধারণ মানুষ।” তাঁর একথার জবাবে বিখ্যাত লেখক ওয়াশিংটন ইরভিং (ডধংযরহমঃড়হ ওৎারহম) বলেছিলেন, “জেমস মেডিসন “টসটসে রসালো আপেলে ভর্তি আপেল-গাছের বিবর্ণ ডাল।”
আহ, আগে যদি বুঝতাম! মানুষ সময়ে বুঝে না, অসময়ে বুঝে; বোঝালেও বুঝে না। এজন্য মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে নিকৃষ্ট কাজগুলো করতে মোটেও দ্বিধা করে না। মানুষের মতো এত বুদ্ধিমান অদূরদর্শী জীব বিধাতা আর সৃষ্টি করেনি।
আমি ড্রাইভার আবুলকে বললাম, সচিবকে গাড়ি নিয়ে আনতে যাওয়া স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু আবুল, ভিক্ষুককে গাড়ি নিয়ে আনতে যাওয়া অনেক

বড়ো বিষয়। এমন বড়ো কাজ যে কেউ করতে পারে না। দিনমজুরের ছেলে বিএ পাস করলে হেডলাইন হয়, কিন্তু প্রফেসরের ছেলে ক্যামব্রিজ থেকে পিএইচডি করলেও খবর হয় না। মানুষ বড়ো ভয়ঙ্কর, জঘন্য তাদের আচরণ। মনে হয়, যেন প্রফেসরের ছেলেদের লেখাপড়া করতে নেই।
আহ, আগে যদি বুঝতাম! মানুষ সময়ে বুঝে না, অসময়ে বুঝে; বোঝালেও বুঝে না। এজন্য মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে নিকৃষ্ট কাজগুলো করতে মোটেও দ্বিধা করে না। মানুষের মতো এত বুদ্ধিমান অদূরদর্শী জীব বিধাতা আর সৃষ্টি করেনি।
আমি বুঝলাম, জীবনের চেয়ে ভয়ঙ্কর বোঝা, স্মৃতির চেয়ে অসহনীয় কষ্ট এবং সন্তান-সন্ততির চেয়ে নৃশংস শত্রু আর নেই। অথচ আমি আমার পুরো জীবনটা তাদের হৃষ্টপুষ্ট করার জন্য ব্যয় করেছি। স্মৃতির জন্য কি না-করেছি, কি না-করেছি জীবন আর সন্তানসন্ততির জন্য। আমি কেন এ তিনটি জিনিসকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে গেলাম?
যদি অর্থকে ভালোবাসতাম,
তাহলে সে কখনো আমার সঙ্গে বেইমানি করত না।
অর্থ কবরেও যায়,
কিন্তু এরা!
কুকুর আর অর্থ কখনো তার মনিবের সঙ্গে বেইমানি করে না।
প্রাক্তন সচিব এম হক সাহেব পুত্রবধূকে বললেন, তুই-তুকারি না করলে কী হয় না মা? বয়সে আমি তোমার বাবার চেয়ে বড়ো।

রাস্তার অনেক ভিক্ষুকও আমার বাবার চেয়ে বড়ো, তাই বলে কি তাদের বাবা ডাকতে হবে? ছাদে উঠলি ক্যান? আমার মা এসেছে বলে? আমার মাকে তুই সহ্যই করতে পারছিস না। সে আসার পর তুই ঘন ঘন ছাদে উঠা শুরু করেছিস।
সরকরি উচ্চপদস্থ চাকুরেগণ অমানুষ হয়ে যায়, তাদের জবাবদিহি কেবল ঊর্ধ্বতনে, সাধারণ জনগণে নয়। অথচ বড়ো অফিসার হতে বড়ো বেশি কিছু জানতে হয় না, রেগুলার টিউশনি করলে হয়ে যা।
এখন এত বড়ো বিল্ডিংয়ে আমার কোনো স্বত্ব নেই। অথচ আমার রক্তঝরা শ্রম আর নৈতিকতা মাড়ানো অর্থে ভবনটি নির্মিত হয়েছিল। তৈয়বা আমাদের বুড়ো বয়সের জন্য একটা রুম করেছিল- সে রুমে এখন সাজ্জাদের ছেলেমেয়ে ক্যারাম খেলে।
যে রুমে আমার ড্রাইভার থাকত, এখন সে রুমে আমি থাকি। আমার স্ত্রী তৈয়বা আমাদের বুড়ো বয়সের জন্য সখ করে যে রুমটা করেছিল সেটাতে এখন আমার ছেলের ছেলেমেয়ে ক্যারাম খেলে।
একসময় আমার জুতো খোলার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকত অনেক আবুল। বসে থাকত— অনেক বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী,

অফিসার। এখন বুঝতে পারি, আমার জন্য নয়, সবাই আমার পদমর্যাদার জন্য আকুল হয়ে বসে থাকত আমার পদপ্রান্তে। এখন আমার পদ আছে, কিন্তু মর্যাদা নেই, তাই আমার পদপ্রান্তেও কেউ নেই। মর্যাদা না-থাকলে সম্রাট আকবরের পদও ভাঙা কুলোর মতো অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।
টুপির চেয়ে পাদুকার এবং মস্তকের চেয়ে পায়ের মর্যাদা এবং মূল্য অনেক অনেক বেশিÑ আমার বর্গাচাষী বাবাই বলতেন। বর্গাচাষী হলেও তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তাই আমাকে পদমর্যাদায় ভারাক্রান্ত করে তোলার জন্য পাগল হয়ে ওঠেছিলেন।
পদমর্যাদা দিযেই মানুষকে বিবেচনা করা হয, মস্তক-মর্যাদা দিয়ে নয়। আমার মস্তকের চিন্তা এবং মর্যাদা আগের মতোই আছে, কিন্তু পদমর্যাদা নেই বলে আমাকে কেউ আর মূল্য দিচ্ছে না।
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন
বাংলা ভাষার মজা, ড. মোহাম্মদ আমীন, পাঞ্জেরী পাবিলিকেশন্স লি.।