ড. মোহাম্মদ আমীন
চুমাচুমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: এমন নাম কেন?
বাংলা চুমা অর্থ (বিশেষ্যে) স্নেহ বা অনুরাগের বশে পরস্পরের ওষ্ঠাধর স্পর্শন বা চুম্বন।চুমাচুমি অর্থ একে অন্যকে চুম্বন, সৌহার্দ বিনিময়। প্রাচীন পার্বত্য ভাষায় চুমাচুমি অর্থ কেবল পরস্পরকে চুম্বন করে স্বাগত জানানো নয়, তাদের কাছে চুমাচুমি অর্থ ছিল আশীর্বাদ, সৌহার্দ, পারস্পরিক সহযোগিতা
প্রভৃতি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চুমাচুমির মাধ্যমে পরস্পরকে স্বাগত ও বিদায় জানানোর রীতি প্রচলিত। পার্বত্য এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকুরিকালীন শ্রুত তথ্য থেকে যতটুকু জেনেছি তা এখানে উল্লেখ করলাম।

আমার এ বর্ণনা দলিল নয়, শ্রুত ঘটনা। নামকরণ নিয়ে নানা প্রবাদ প্রচলিত থাকে। কারো ভিন্নমত জানা থাকলে বলবেন। লেখাটি ত্রুটিমুক্ত ও সমৃদ্ধ হবে।
চুমাচুমি আমাদের অনেকের কাছে অশালীন বা হাসির বিষয়। কিন্তু অশালীন চিন্তক ছাড়া অন্য সবার কাছে তা সম্মান, সম্প্রীতি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আশীর্বাদ আর স্নেহপ্রেমের বিষয়। যারা চুমাচুমিতে মায়ের পরশ, বাবার আদর, স্বজনের মমতা, গুরুজনের আশীর্বাদ এবং বৈশ্বিক অনুপমতা দেখেন তারা চুমাচুমি শব্দটিকে অশালীন ভাবতে পারেন না।
জুরাছড়ি, রাঙ্গামাটি জেলার জুরাছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এটি জুরাছড়ি, কুসুমছড়ি এবং লুলাংছড়ি নামের ৩টি মৌজা নিয়ে গঠিত। যতটুকু

জানা যায়, যক্ষা মহাজনের প্রপিতামহ এলাকাবাসীর সহযোগিতার মাধ্যমে এলাকায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এলাকাবাসী তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরস্পর সহযোগিতা বা পরস্পর ঐচ্ছিক দান ও স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠার আয়োজন সম্পন্ন করতে সক্ষম হন।
এলাকাবাসীর সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল বলে বিদ্যালয়টির নাম রাখা হয় চুমাচুমি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সবার উপস্থিতিতে অনাবিল পরিবেশে এটি উদ্বোধন করা হয়। অতঃপর পরস্পর সৌহার্দ ও সম্প্রীতি নিদর্শক চুমাচুমির মাধ্যমে পরস্পরের আশীর্বাদ কামনা করে বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করা হয়।
আবার অনেকের মতে, সুমাসুমি শব্দটির অর্থ উপত্যকা এবং চুমাচুমি হচ্ছে সুমাসুমি শব্দের বিকৃতরূপ বা অপভ্রংশ। কারো কারো অভিমত, বিদ্যালয়টির নামে উপত্যকা অর্থদ্যোতক সুমাসুমি শব্দটি বিকৃত হয়ে চুমাচুমি নামে ঠাঁই পেয়েছে। তবে অনেকে তা ঠিক মনে করেন না। তাদের বক্তব্য: লিখিত ভাষায় বিকৃতি সাধারণত বিরল। সুমাসুমিও পাহাড়ে পাহাড়ে চুমাচুমি বা হার্দিক মিলন। যেটাই হোক, চুমাচুমি নিয়ে হাসাহাসির কিছু নেই।
অনেকে চুমাচুমি নাম নিয়ে হাসাহাসি করেন। যে ভাষার কিছু লোক সোনা (স্বর্ণ) বাল (বালক), বোদা (বোদ্ধা)-এর মতো সুন্দর-শালীন ও অর্থবহ শব্দকে গালি বানিয়ে তামাশা করতে পারেন, হাত ধোন কথাটির অর্থ করেন হাত শিশ্ন তাদের কাছে চুমাচুমির মতো উত্তম শব্দ নিয়ে হাসিহাসি করা বেইজ্জতের বিষয়।জ্ঞান মানুষের ভেতর থেকে ভাষা হয়ে মুখে আসে। মাতৃভাষার প্রতি এমন উপহাসকারীদের উদ্দেশ করে বলেছিলেন সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম:
“যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।”
এখনও পাহাড়িদের সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতির চেয়ে অনেক বিষয়ে মার্জিত ও ঈর্ষণীয়। তারা অন্তত মাতৃভাষা নিয়ে উপহাস করে না, মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে না। আমার মাতৃভাষা আমার মা। আমার মা প্রতিবন্ধী হলেও আমার কাছে বিশ্বনন্দি।
———–
শুবাচ গ্রুপের লিংক: www.draminbd.com
— — — — — — — — — — — — — — — — — — —