কীভাবে হলো দেশের নাম (ইউরোপ)
ড. মোহাম্মদ আমীন
চেক রিপাবলিক (Czech Republic)
চেক প্রজাতন্ত্র মধ্য ইউরোপের একটি স্থলবেষ্ঠিত রাষ্ট্র। ঐতিহাসিক বোহেমিয়া ও মোরাভিয়া অঞ্চল এবং সাইলেসিয়া অঞ্চলের কিয়দংশ নিয়ে দেশটি গঠিত। ২০শ শতকের অধিকাংশ সময় জুড়ে দেশটি স্লোভাকিয়ার সঙ্গে মিলিতভাবে প্রাক্তন চেকোস্লোভাকিয়ার অংশ ছিল। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চেকোস্লোভাকিয়া দুই ভাগ হয়ে যায়। চেক প্রজাতন্ত্রের উত্তরে পোল্যান্ড, পূর্বে স্লোভাকিয়া, দক্ষিণে অস্ট্রিয়া এবং পশ্চিমে জার্মানি। চেক প্রজাতন্ত্রের পর্বতবেষ্টিত পাহাড়ি পশ্চিমাংশের নাম বোহেমিয়া আর পূর্বের নিম্নভূমির নাম মোরাভিয়া। উত্তরের নিম্নভূমি অঞ্চল সাইলেসিয়া নামে পরিচিত। সাইলেসিয়া দক্ষিণ পোল্যান্ডেও বিস্তৃত।
চেক ও শ্লোভাকদের দেশ বা ভূমিকে চেকোশ্লোভাকিয়া বলা হয়। চেক, শ্লোভাক শব্দের সঙ্গে ইয়া প্রত্যয় যুক্ত হয়ে গঠিত হয় চেকোস্লোভাকিয়। এর আক্ষরিক অর্থ চেক ও স্লোভাক জাতির লোকদেও আবাসভূমি। চেক ও শ্লোভাকদের ভূমির নাম চেকোশ্লোভাকিয়া। এর পূর্বে দেশটির নাম ছিল চেকোশ্লাভাক নেশন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটির নাম পরিবর্তন করে চোকোশ্লাভিকিয়া রাখা হয়। বহেমিয়ান উপজাতিগোষ্ঠীর লোকের চেক নামে পরিচিত ছিল। চেক ও স্লোভা জাতিগোষ্ঠীভুক্ত লোক একত্রিত হতে জনপদটি গড়ে তুলেছিলেন। তাই এর নাম চেকোস্লোভাকিয়া। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি চেকোশ্লাভাকিয়া ভেঙে চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া নামের দুটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে যায়।
চেক জাতিগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যে স্থানে বসবাস করে তাই চেক। চেক জাতিগোষ্ঠীর কিছু কিছু লোক স্লোভাক জাতিগোষ্ঠীর লোকের সঙ্গে একীভূত না হয়ে নিজেরাই একটি জনপদকে বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছিল। একটি চেক রাষ্ট্র। এটাকে ঘিরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আধুনিক চেক রিপাবলিক। প্রথাগত ইংরেজি নাম বহেমিয়া, লাতিন বোইহামাম থেকে বহেমিয়া নামের উৎপত্তি। এর অর্থ বইয়াদের বাড়ি। বর্তমান নামটি এন্ডওনিয়াম ‘চেখ’ থেকে এসেছে। এর উচ্চারণ ও বানান পোলিশ ভাষার অনুকরণ। মূলত নামটি স্লাভিক উপজাতি থেকে এসেছে। কথিত আছে তাদের আদি ও প্রভাবশালী নতা ‘চেখ’ জাতিগোষ্ঠীভুক্ত লোকদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসাবে রিপ মাউন্টেন-এর উপর বসতি স্থাপনের জন্য নিয়ে আসেন। ‘চেখ’ তার জাতিগোষ্ঠীভুক্তদের বসবাসের স্থান বা ঘর দিয়েছেন। তাই এলাকাটির নাম রাখা হয় চেখ বা চেক।
চেক রিপাবলিকের মোট আয়তন ৭৮,৮৬৬ বর্গকিলোমিটার বা ৩০,৪৫০ বর্গমাইল। তন্মধ্যে জলীয় ভাগের পরিমাণ ২.০%। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, চেক রিপাবলিকের মোট জনসংখ্যা ১,৫৪,৪১,৪৬৬ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১৩৪। আয়তন বিবেচনায় এটি পৃথিবীর ১১৬-তম বৃহত্তম দেশ কিন্তু জনসংখ্যা বিবেচনায় ৮১-তম। আবার জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এটি পৃথিবীর ৮৭-তম জনবহুল দেশ।
চেক রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ। দাপ্তরিক ভাষা চেক, তবে সংখ্যালঘুদের ভাষাও আঞ্চলিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃত। সরকারিভাবে চেক রিপাবলিকের অধিবাসীগণ চেক নামে পরিচিত। এটি একটি অনন্যসাধারণ ধর্ম-উদার দেশ। জনগণের ১০.৩% অধিবাসী রোমান ক্যাথলিক এবং ৮০% অধিবাসী কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী নন। হয়ত এজন্য এটি পৃথিবীর অন্যতম শান্তিপূর্ণ দেশ। চেক প্রজাতন্ত্র বিশ্বের ১১তম শান্তিপূর্ণ দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। দিন দিন বিশ্ব যেখানে অশান্তির ডামাডোলে ঢেকে যাচ্ছে, চেকপ্রজাতন্ত্র সেখানে শান্তির অনুপম ধারায় নন্দিত হচ্ছে।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ অক্টোবর চেকশ্লোভাকিয়া গঠিত হয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি এটি চেক সোসাইলিস্ট রিপাবলিকে এবং ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি চেক রিপাবলিকে পরিণত হয়। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে দেশটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদান করে।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, চেক রিপাবলিকের জিডিপি (পিপিপি) ৩২৫.২৮৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং সে হিসাবে মাথাপিছু আয় ৩০,৮৯৫ ইউএস ডলার। অন্যদিকে জিডিপি (নমিনাল) ১৮০.৭৮৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ১৭,১৭১ ইউএস ডলার। মাথাপিছু আয় বিবেচনায় চেক প্রজাতন্ত্র পৃথিবীর ৪১-তম ধনী দেশ। মুদ্রার নাম চেক করুনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দেশটি সোভিয়েত প্রভাবাধীন ছিল। ১৯৯০-এর দশকে এর অর্থনীতি বেসরকারীকরণ করা হয়। বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্র ইউরোপের ইউরোপের একটি অন্যতম শিল্পোন্নত দেশ। ঐতিহ্যবাহী চেক দ্রব্যের মধ্যে আছে সূক্ষè স্ফটিক এবং বিয়ার। পর্যটন দেশটির আয়ের অন্যতম উৎস। পর্যটকেরা প্রাগের স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হন। চেক প্রজাতন্ত্রের মধ্যভাগে অবস্থিত প্রাগ (চৎধযধ প্রাহা) দেশের বৃহত্তম শহর ও রাজধানী। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি চেক প্রজাতন্ত্রের বর্তমান পতাকাটি গ্রহণ করা হয়। এটি প্রথম গৃহীত হয়েছিল ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মার্চ।
চেক প্রজাতন্ত্রকে দুর্গের শহর বলা হয়। অনেক দুর্গ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও এখনও ২০০ দুর্গ অক্ষত রয়েছে। দুর্গের ঘনত্ব বিবেচনায় বিশ্বে এর অবস্থান প্রথম। ১৮ একর আয়তনের প্রাগ দুর্গ পৃথিবীর প্রাচীনতম দুর্গ হিসাবে স্বীকৃত। এজন্য চেক প্রজাতন্ত্র বিশ্ব দুর্গের রাজধানী বলা হয়। পুরো চেক প্রজাতন্ত্র চারিদিকে প্রায় পাহাড় দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে দেশটি। চেক প্রজাতন্ত্রের লোকেরা প্রচুর বিয়ার পান করে। প্রতিবছর একজন চেক গড়ে ১৬০ লিটার বিয়ার পান করে। অসাধারণ স্পা সুবিধার জন্যও চেক প্রজাতন্ত্র বিখ্যাত। ১৯% চেক দাবি করেন যে, তারা ঈশ্বরে বিশ্বাসী। বাকিরা কোনো ঈশ্বর বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের ধার ধারেন না।
চেকরা অসুস্থদের প্রতি খুবই যত্নশীল। এখানে জনপ্রতি হোস্টেল-বেডের সংখ্যা ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বাধিক। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে অটো উইচটারল (Otto Wichterle) নামের এক চেক বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সফ্ট কন্ট্রাক্ট লেন্সের আবিষ্কারক। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে চেক রিপাবলিক সুগার কিউব আবিষ্কার করে। রুটি ও লবণ দিয়ে এরা অতিথিদের স্বাগত জানায়।
রিপোটার্স উইথআউট বর্ডার এর জরিপ অনুযায়ী চেক প্রজাতন্ত্র পৃথিবীর ১৬৮টি দেশের মধ্যে ৫ম উত্তম দেশ। চেকরা খুব পরিশ্রমী। ১৩৪৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিষ্ঠিত প্রাগ এর চার্লস ইউনিভার্সিটি পূর্ব ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্য ইউরোপের বৃহত্তম গাড়ি প্রস্তুত কোম্পানি স্কোডা অটো চেক রিপাবলিক-ভিত্তিক। ৬টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ এখানে রয়েছে ৪৬টি বিমান বন্দর।
গত একশ বছরে বর্তমান চেক রিপাবলিক যথাক্রমে চেকোশ্লাভাকিয়া, জার্মানি, পোলান্ড, নাজি নিয়ন্ত্রিত বোহেমিয়া ও মোরাভিয়া এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপূর্বে এটি পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য, বহেমিয়া রাজ্য এবং মোরাভিয়ার অংশ ছিল।
বুলগেরিয়া (Bulgaria) : ইতিহাস ও নামকরণ
সাইপ্রাস (Cyprus) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক