ড. মোহাম্মদ আমীন
ছড়া, সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা। বলা হয়— ছড়ার মাধ্যমে সাহিত্যের সূচনা।বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাগীতির প্রথম পদটি ছড়া। এটি ছড়ার মূলছন্দ স্বরবৃত্ত ছন্দ-সৌকর্যে রচিত। অনেকের মতে, পদটি বাংলা সাহিত্যের আদি ছড়া। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার বাংলায় প্রচলিত কিছু লৌকিক ছড়াকে প্রথম গ্রন্থভুক্ত করেন। ওই গ্রন্থের নাম ‘খুকুমণির ছড়া’।এর ভূমিকায় রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সর্বপ্রথম সাহিত্যের অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
ছড়া কী? সাধারণভাবে স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত মুখে মুখে উচ্চারিত ঝংকারনিনাদ পদ্যই ছড়া। ইংরেজি ভাষায় যাকে বলা হতো ননসেন্স রাইম। ননসেন্স বলার কারণ— ছড়ার প্রধান বিষয় ছিল ধ্বনিময়তা ও সুরঝংকার। অর্থময়তা নয়। তবে এখন এ দাবি কেউ আর স্বীকার করে না। ছড়া এখন ছন্দ-ঝংকারের সঙ্গে অর্থময়তাকেও দ্যোতিত করে। আমারমতে, ছন্দ মেনে অন্ত্যমিল, সহজবোধ বিষয়ে, সাবলীন শব্দচয়ন, রসাত্মক পরিবেশন, আকর্ষণীয় সুর, নিবিড় শব্দের গ্রাহী সমন্বয় সাধনে সহজ-সরল বা শিশু মনোপযোগিতার অকৃত্রিম ভাব – ছড়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একসময় ছড়াকে মনে করা হতো শুধুই শিশুসাহিত্য। তবে এখন আর তা মনে করা হয় না, বাংলাসাহিত্যে ছড়া তার নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্পাদিত কাব্যগ্রন্থে ছড়া সম্পর্কে বলেন, “সুদূর কাল থেকে আজ পর্যন্ত এই কাব্য (ছড়া) যারা আউড়িয়েছে এবং যারা শুনেছে তারা অর্থেও অতীত রস পেয়েছে। ছন্দতে ছবিতে মিলে একটা মোহ এনেছে তাদের মধ্যে। সেইজন্য অনেক নামজাদা কবিতার চেয়ে এর (ছড়া) আয়ু বেড়ে চলেছে।’ অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতে, ‘‘ছড়া যদি কৃত্রিম হয় তবে তা ছড়াই নয়, তা হালকা চালের পদ্য। তাতে বাহাদুরি থাকতে পারে, কারিগরি থাকতে পারে, কিন্তু তা আবহমানকাল প্রচলিত খাঁটি দেশজ ছড়ার সঙ্গে মিশ খায় না।”
বুদ্ধদেব বসু বলেছেন, ‘আধুনিক কবির হাতে ছড়া বের হতে পারে শুধু এই শর্তে যে, তিনি বক্তব্য কিছু দেবেন, অথচ সেটুকুর বেশি দেবেন না যেটুকু এই হালকা ছোট চটুল শরীরে ধরে যায়। একেবারে সারাংশ কিছু না থাকলে তা নেহাতই ছন্দের টুংটাং হয়ে পড়ে, মাত্রা একটু বেশি হলেও আর ছড়া থাকে না।’
কবিতা
এরিস্টটল বলেছেন, ‘‘কবিতা দর্শনের অধিক, ইতিহাসের চেয়ে বিস্তৃত।’’ রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘‘রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা।’’ জীবনানন্দ উপমাকে কবিতার প্রাণ মনে করেন। তাঁর ভাষায়, ‘‘উপমাই কবিতা।’’ মালার্ম মনে করেন, ‘‘শব্দই কবিতা।’’ রবার্ট ফ্রস্টের অভিমত, ‘‘ সেটুকুই বিশুদ্ধ কবিতা, যার ভাষান্তর সম্ভব নয়।’’ ম্যাকলিস বলেছেন, ‘‘কবিতা কিছু বোঝায় না; কবিতা হয়ে ওঠে।’’ শেলির মতে, ‘‘কবিতা হলো শ্রেষ্ঠ পরিতৃপ্তি প্রদানের লক্ষ্যে নির্মিত পরিতৃপ্ত মুহূর্তের সর্বশ্রেষ্ঠ বিবরণ।’’ বুদ্ধদেব বসুর মতে, “কবিতা আমরা বুঝি না, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের ‘বোঝায়’ না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ। ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণই এই যে তা ‘বোঝা’ যাবে না, ‘বোঝানো’ যাবে না।”
উপযুক্ত সংজ্ঞার্থ বিশ্লেষণে আমার অভিমত, শব্দ, উপমা, ছন্দ, বিষয়— সংক্ষেপে যা নিয়ে কবিতা তার সবটুকুই ব্যক্তি মনের প্রতিনিধি। এর ভাবানুভূতি সম্পূর্ণ নিজস্ব হয়ে সর্বজনীন পরিতৃপ্তে পরিব্যপ্ত। আমি যাকে কবিতা মনে করি সেটিই কবিতা। আমার কাছে যে কবিতাটি শ্রেষ্ঠ তা অন্য কারও কাছে হয়ে যেতে পারে নিকৃষ্ট। আমি যাকে কবিতা মনে করি সেটিই কবিতা, হোক সে সাহিত্যিক সংজ্ঞার্থে উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ, গল্প, নাটক বা অন্য কিছু। কবিতার সৃষ্টি ভালোবাসা বা তার বিপরীত বিষয় থেকে; আনন্দ বা তার বিপরীত অনুভূতি থেকে জাগ্রত, দর্শন থেকে উত্থিত। ব্যক্তি মনের দাগ যখন নিপুণ বিন্যাসে বাণীবদ্ধ হয় তখন সেই দাগটি কবিতা হয়ে ওঠে শব্দের বাগানে বাগেন মনোহর সজ্জায়।
——————–