ড. মোহাম্মদ আমীন
জগন্ময় মিত্র: সুরের সাগর গানের বিস্ময়
বাংলা গানের জগতে সুরসাগার এবং হিন্দি গানের জগতে জগমোহন নামে পরিচিত অসংখ্য কালজয়ী বাংলা গানের গীতিকার জগন্ময় মিত্র ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা আধুনিক গান, নজরুলসংগীত, ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুংরি, টপ্পা প্রভৃতি বিভাগে তাঁর বিচরণ ছিল সাবলীল। জন্মের মাসখানেক আগে তাঁর বাবা, যতীন্দ্রনাথ মিত্র, মাত্র ২৫ বছর বয়সে মারা যান। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে

তিনি এন্ট্রান্স পাশ করেন। তিনি ১০ বা ১১ বছর বয়সে প্রথম কেশব মুখোপাধ্যায়ের কাছে ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুংরি, টপ্পা ইত্যাদির তালিম নেন। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল মিউজিক অ্যাসোসিয়েশনের সংগীত প্রতিযোগিতায় তিনি ধ্রুপদ, টপ্পা, ঠুংরি, রাগ প্রধান বাউল ও কীর্তন— প্রতিটি বিভাগে প্রথম হন। কাব্য সংগীতে হয়েছিলেন তৃতীয়।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে জগন্ময় মিত্র প্রথম এইচএমভিতে গান রেকর্ড করার সুযোগ পান।প্রণব রায়ের কথায় কমল দাসগুপ্তের সুরে ‘প্রিয় হতে প্রিয়তর’ এবং ‘তোমার মতন কত না নয়ন’ গান দুটি তাঁকে প্রথম খ্যাতি এনে দেয়। এইচএমভিতে ‘যদি বাসনা মনে দিবে দহন জ্বালা’ গানটি জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠে শুনে কাজী নজরুল ইসলাম ভূয়শী প্রশংসা করেছিলেন। সে থেকে নজরুল ইসলামের সঙ্গে জগন্ময় মিত্রের আমরণ হৃদ্যতার সূচনা। নজরুল গীতি রেকর্ড করার পাশাপাশি, ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কয়েকটি রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করেছেন।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে পুজোর রেকর্ড ‘চিঠি’ গেয়েই গানের জগতে তিনি আরও স্থায়ী আসন গেড়ে নেন। তাঁর সাড়া জাগানো পুজোর গানের আরেকটি রেকর্ড ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘সাতটি বছর পরে’ নামে। গান দুটি, পরবর্তীকালে গীত ‘চিঠি – তুমি আজ কত দূরে’ গানটির সঙ্গে গড়ে তোলে এক অবিস্মরণীয় মরমি অনুভূতি।
১৯৪০, ১৯৫০ এর দশক জুড়ে ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘যাদের জীবন ভরা শুধু আঁখিজল’, ‘তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন’, ‘ভুলি নাই ভুলি নাই’, ‘মেনেছি গো হার’, ‘আমি স্বপন দেখেছি’, ‘স্বপন সুরভী মাখা’, ‘গভীর নিশিথে

ঘুম’, ‘প্রেমের তাজমহল’, ‘হৃদয় যেন কাহারে চেয়েছিল’, ‘তোমারে তো আজও ভুলি নাই’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারি করেছে’ এমন অসংখ্য কালজয়ী বাংলা গান গেয়ে জগন্ময় মিত্র বাংলা গানের জগতে কালজয়ী আসন প্রতিষ্ঠা করে নিতে সক্ষম হন।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জগন্ময় কলকাতা ছেড়ে স্থায়ীভাবে বোম্বাই (অধুনা মুম্বাই) চলে যান। কলকাতার চেতলার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে মুম্বাইয়ে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্যে জুহুতে একটি বাড়ি কিনেন। গান রেকর্ডিং বা সংগীতানুষ্ঠানের জন্য মাঝে মাঝে কলকাতা আসতেন। তবে স্থায়ীভাবে আর কলকাতা আসেননি। শুনুন তার কয়েকটি বিখ্যাত গান:
- চিঠি – তুমি আজ কত দূরে (১৯৪৮) – প্রণব রায় / সুবল দাশগুপ্ত
- সাতটি বছর আগে (১৯৪২) – প্রণব রায় / সুবল দাশগুপ্ত
- সাতটি বছর পরে (১৯৪২) – প্রণব রায় / সুবল দাশগুপ্ত
- জানি জানি গো (১৯৪২) – সুবোধ পুরকায়স্থ / কমল দাশগুপ্ত
- প্রেমের না হবে ক্ষয় (১৯৪১) – শৈলেন রায় / হিমাংশু দত্ত
- ভুলি নাই ভুলি নাই (১৯৪৪) – মোহিনী চৌধুরী / কমল দাশগুপ্ত
- তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন (১৯৪৪) – প্রণব রায় / কমল দাশগুপ্ত
- আমি স্বপন দেখেছি (১৯৫০) – চারু মুখোপাধ্যায় / জগন্ময় মিত্র
- ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে (১৯৪৬) – মোহিনী চৌধুরী / কমল দাশগুপ্ত
- মেনেছি গো হার মেনেছি (১৯৪৩) – সুবোধ পুরকায়স্থ / কমল দাশগুপ্ত
- গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায় (১৯৫১) – কাজী নজরুল ইসলাম / কমল দাশগুপ্ত
- স্বপন সুরভী মাখা (১৯৫০) – শৈলেন রায় / জগন্ময় মিত্র
- আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড় (১৯৫৫) – মোহিনী চৌধুরী / কমল দাশগুপ্ত
- যাদের জীবন ভরা শুধু আঁখিজল (১৯৫৫) – মোহিনী চৌধুরী / কমল দাশগুপ্ত
- প্রথম প্রদীপ জ্বালো (১৯৪৯) – কাজী নজরুল ইসলাম / কাজী নজরুল ইসলাম
- জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা (১৯৪৯) – কাজী নজরুল ইসলাম / কাজী নজরুল ইসলাম
জগনময় মিত্র ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ৮৫ বছর বয়সে মুম্বাই নগরীর জুহুর বাড়িতে মারা যান।
———————–