জাতীয় পতাকার সূচনা
জয়বাংলা বাহিনীর পতাকা থেকে বাংলাদেশের পতাকার উদ্ভব। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জুন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি “জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে “ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী” গঠন করা হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জয়বাংলা বাহিনীর পতাকা তৈরীর লক্ষ্যে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ১১৬; বর্তমান ১১৭-১১৮ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম, ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ( বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। সভায় কাজী আরেফের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে বাংলাদেশের হলুদ রঙের মানচিত্র খচিত করে পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।
প্রথম জাতীয় পতাকার দর্জি
কামরুল আলম খান (খসরু) প্রস্তাবিত ও গৃহীত নকশা অনুযায়ী ঢাকা নিউ মার্কেটের এক বিহারি দর্জির দোকান থেকে বড়ো এক টুকরো সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে আনেন। ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়েদ-ই- আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল)এর ৩১২ নম্বর কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নিয়ে ট্রেসিং পেপারে মানচিত্র আঁকেন। শিবনারায়ণ দাশ মানচিত্রটি লাল বৃত্তের মাঝে এঁকে দেন।
প্রথম জাতীয় পতাকা
১৯৭১ খিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যে পতাকা ব্যবহার করা হতো, সেটার মাঝখানে লাল বৃত্তের ভেতর হলুদ রঙের একটি মানচিত্র ছিল। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জানুয়ারি বাংলাদেশের পতাকা থেকে মানচিত্রটি সরিয়ে ফেলা হয়।
প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। উত্তোলন করেন ছাত্র নেতা আ.স.ম. আবদুর রব। তিনি সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২রা মার্চ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দিবস পালিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর পতাকা উত্তোলন
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে মার্চ তাঁর বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। দিনটি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবস।
নতুন জাতীয় পতাকার প্রস্তাব
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ণ দাশের ডিজাইনকৃত পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলে পটূয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
বর্তমান জাতীয় পতাকার গঠন
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্যবহৃত পতাকার উপর ভিত্তি করে এই পতাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রথমে নির্মিত পতাকার মাঝকানের লাল বৃত্তে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল, পরে মানচিত্রটি বাদ দেওয়া হয়। লাল বৃত্তটি একপাশে এমনভাবে চাপানো হয়েছে, যতে পতাকা উড়লে পতাকার মাঝখানের লালবৃত্তটি দেখা যায়। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাপানের জাতীয় পতাকার সাথে মিল রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের সবুজের স্থলে, জাপানি পতাকায় সাদা।
পতাকা থেকে মানচিত্র সরিয়ে ফেলার কারণ
প্রথমত পতাকার উভয় পাশে সঠিকভাবে মানচিত্রটি ফুটিয়ে তোলার অসুবিধা এবং দ্বিতীয়ত দেশের আকার-আয়তন পরিবর্তনশীল। দেশের আকৃতি পরিবর্তন হলে মানচিত্রও পরিবর্তন কার প্রয়োজন হয়ে যায়। যা জাতীয় পতাকার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের স্থায়িত্বের প্রতিকূল।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অন্তর্নিহিত দর্শন
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত। সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক। বৃত্তের লাল রং উদীয়মান সূর্য এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জানুয়ারি সরকারিভাবে গৃহীত হয়।
জাতীয় পাখি ফুল ফল মাছ বৃক্ষ পশু ব্যক্তিত্ব পোশাক
বাংলাদেশের বাইরে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল কলকাতার পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন অফিসে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়
আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে মার্চ।
জাতীয় প্রতীক
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক প্রতীক গ্রহণ করা হয় । জাতীয় প্রতীকের ডিজাইনার পটুয়া কামরুল হাসান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী : “প্রজাতন্ত্রের জাতীয় প্রতীক হইতেছে উভয় পার্শ্বে ধান্যশীর্ষবেষ্টিত, পানিতে ভাসমান জাতীয় পুষ্প শাপলা, তাহার শীর্ষদেশে পাটগাছের তিনটি পরস্পর-সংযুক্ত পত্র, তাহার উভয় পার্শ্বে দুইটি করিয়া তারকা।” রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় প্রতীক ব্যবহার করার অধিকারী।
বাংলাদেশের মনোগ্রাম
বাংলাদেশের মনোগ্রাম হচ্ছে Ñলাল রঙের বৃত্তের মাঝে হলুদ রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র। বৃত্তের ওপর দিকে লেখা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, নিচে লেখা সরকার এবং বৃত্তের দুপাশে দুটি করে মোট ৪টি তারকা। সরকারি অফিস, নথি,স্মারক, চিঠিপএ ইত্যাদি কাজে বাংলাদেশের মনোগ্রাম ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামের ডিজাইনার এ এন এ সাহা।
মানচিত্র
যিনি প্রথম সারা পৃথিবীর মানচিত্র আঁকার চেষ্টা করেছেন, তার নাম অ্যানাক্সিম্যান্ডার। তবে তার ম্যাপে সারা পৃথিবী নয়, কেবল ভূমধ্যসাগর আর কৃষ্ণসাগরের চারপাশের এশিয়া, ইউরোপ আর আফ্রিকা অবস্থান দেখানো ছিল। তাঁর এই মানচিত্র হেক্টিয়াস অফ মিলেটাস আরও উন্নত করেন। তিনি তার ম্যাপে ভারত ও মিশরের অবস্থানও দেখিয়েছিলেন। আলেকজান্ডারের আমলে তার পুরো সাম্রাজ্যের একটি মানচিত্র আঁকেন এরাতোসথিনেস। মানচিত্রে প্রথম বিশাল চীনের অবস্থান নির্ণয় করেন মেরিনাস অফ তায়ার। তবে, মানচিত্র অঙ্কনে ক্ষেত্রে আধুনিকতার পথিকৃত বলা হয় গণিতজ্ঞ, জ্যোর্তিবিদ ও ভুগোলবিদ টলেমিকে। বাংলার প্রথম মানচিত্র আঁকেন ব্রিটিশ সার্ভেয়ার, মেজর জেমস রেনেল।