বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন
ড. মোহাম্মদ আমীন
প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৯৩ আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে ১১টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ১টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ একটি এবং নির্দলীয় প্রার্থী ৫টি আসনে জয়ী হয়। মোট সংগৃহীত ভোট ছিল ৫৪.৯%। এই নির্বাচনে মোট ১৫টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। বিরোধীদের মধ্যে জাতীয় লীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একজন করে এবং স্বতন্ত্র পাঁচজন প্রার্থী বিজয়ী হন। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান/মোহাম্মদ মনসুর আলী। এই সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর ছয় মাস।
দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই ব্রেুয়ারি বাংলাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২০৭টি আসন জয় লাভ করে। মোট ভোট সংগৃহীত হয়েছিল ৫১.৩%। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (মালেক) ৩৯, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২, জাসদ ৮, মুসলিম লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ ২০, ন্যাপ (মোজাফ্ফর) ১, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ২, বাংলাদেশ গণফ্রন্ট ২, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল ১, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১, জাতীয় একতা পার্টি ১ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসনে জয় পায়। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শাহ আজিজুর রহমান। বিরোধীদলীয় নেতা হন আসাদুজ্জামান খান। এ সংসদের মেয়াদ ছিল তিন বছর।
তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করে এবং ১৩টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্যান্য দল পায় ১১৫ আসন। তন্মধ্যে আওয়ামী লীগ ৭৬টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) পাঁচটি, ন্যাপ (মোজাফফর) দুটি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পাঁচটি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) তিনটি, জাসদ (রব) চারটি, জাসদ (সিরাজ) তিনটি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ১০টি, মুসলিম লীগ চারটি ও ওয়ার্কার্স পার্টি তিনটি আসন পায়। বাকি ৩২ আসনে নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন মিজানুর রহমান চৌধুরী। বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। এ সংসদের মেয়াদ ছিল ১৭ মাস।।
চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, জাতীয় আওয়ামী পার্টি (মুজাফ্ফর) এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি-সহ প্রায় সবকটি প্রধান দল এই নির্বাচন বর্জন করেছিল। নির্বাচনে মোট ছয়টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংসদীয় ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৫১টি আসন লাভ করে। ১৯টি আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেন সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ)। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী ২৫টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি ও ফ্রিডম পার্টি দুটি আসন লাভ করে। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন মওদুদ আহমেদ/কাজী জাফর আহমেদ এবং বিরোধীদলীয় নেতা হন আ স ম আব্দুর রব। এ সংসদের মেয়াদ ছিল দুই বছর সাত মাস।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর অর্ন্তবতীকালীন সরকারের অধীনে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। অংশ নেওয়া দলের সংখ্যা ছিল ২১। এ নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) পাঁচটি, জাসদ (সিরাজ) একটি, ইসলামী ঐক্যজোট একটি, জামায়াতে ইসলামী ১৮টি, সিপিবি পাঁচটি, ওয়ার্কার্স পার্টি একটি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি) একটি, গণতন্ত্রী পার্টি একটি ও ন্যাপ (মোজাফফর) একটি আসন পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী তিনটি আসনে জয়লাভ করেন। মোট ভোট গৃহীত হয়েছিল ৫৫.৪%। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন খালেদা জিয়া। বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। সংসদের মেয়াদ ছিল চার বছর আট মাস।
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করেছিল। নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৭৮টি আসন লাভ করে। ফ্রিডম পার্টি ১টি ও সতন্ত্র প্রার্থীরা ১০টি আসন পায়। এছাড়া ১০টি আসনের ফলাফল অসমাপ্ত থাকে এবং আদালতের রায়ে একটি আসনের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন, কর্নেল (অব:) ফারুক ও চীফ হুইপ ছিলেন খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি এ কে এম সাদেক। এই সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে মার্চ এবং অধিবেশন স্থায়ী ছিল ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত মাত্র চার দিন। ৩০শে মার্চ ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে মার্চ ষষ্ঠ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। সংসদ স্থায়ী ছিল মাত্র ১২ দিন। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে কমদিন স্থায়ী সংসদ।
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জুন বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৩০০টি সংসদীয় আসনের জন্য ২৮১জন স্বতন্ত্র প্রার্থী-সহ ৮১টি দল থেকে মোট ২৫৭৪ জন প্রার্থী প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। এটি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। মোট আটটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়লাভ করে। অন্য দলগুলোর মধ্যে বিএনপি ১১৬টি, জাতীয় পার্টি ৩২টি, জামায়াতে ইসলামী তিনটি, ইসলামী ঐক্যজোট একটি ও জাসদ একটি আসন পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেন একটি আসনে। এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ০.৬৭% এবং দলীয় প্রার্থীরা ৭৪.৮২% ভোট লাভ করে। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বিরোধীদলীয় নেতা হন খালেদা জিয়া। সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা অক্টোবর বাংলাদেশের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদের ৩০০টি সংসদীয় আসনের জন্য ৪৮৪জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ মোট ৫৪টি দল থেকে মোট ১৯৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিএনপি বাদে অন্য দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ৬২টি, জামায়াতে ইসলামী ১৭টি, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ১৪টি, জাতীয় পার্টি (না-ফি) ৪টি, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ১টি, ইসলামিক ঐক্যজোট ২টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ১টি আসন লাভ করে। বাকি ৬ আসনে জয়লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। খালেদা জিয়া তৃতীয় বারের মতো সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর বাংলাদেশে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারের অধীনে। সামরিক সরকার ২০০৭ সালের শুরুর দিকে জরুরি অবস্থা জারি করে যা ২০০৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তুলে নেওয়া হয়। মোট ১০টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়ে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলগুলোর মধ্যে বিএনপি ৩০টি, জাতীয় পার্টি ২৭টি, জাসদ তিনটি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ১টি, জামায়াতে ইসলামী ২টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) ১টি আসন পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থী পান ৪টি আসন। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বিরোধীদলীয় নেতা হন খালেদা জিয়া। সংসদের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে মোট ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়। ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলো। এ নির্বাচনে মোট ১৭টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। ভোট নেওয়া হয় ১৪৭টি আসনে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ৯৬টি, জাতীয় পার্টি ১২টি, ওয়ার্কার্স পার্টি চারটি ও জাসদ দুটি আসন পায়। আর ১৪ আসনে জয়লাভ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। আওয়ামী লীগ মোট ২৩৪টি আসন পায়। দলটি ১৪ জোটের শরিকদের নিয়ে সরকার গঠন করে। শরিকদের মধ্যে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ছয়টি, জাসদ (ইনু) পাঁচটি, জাতীয় পার্টি (জেপি-মঞ্জু) ২টি এবং তরিকত ফেডারেশন ২টি আসন পায়। জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বিরোধী দলের নেতা হন রওশন এরশাদ। সংসদের মেয়াদ ছিল ৫ বছর।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
২০১৮ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষণায় ২৩শে ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হলেও ১২ই নভেম্বর পুনঃতফসিলে তা পিছিয়ে ৩০শে ডিসেম্বর করা হয়। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা ঘরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। বিরোধী দলীয় নেত্রী হন রওশন এরশাদ।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক
সংবিধান সংশোধন : একনজরে প্রথম থেকে সপ্তদশ সংশোধন পর্যন্ত
জাতীয় সংসদ নির্বাচন : একনজরে প্রথম থেকে একাদশ নির্বাচন পর্যন্ত
বাংলাদেশের সকল জাতীয় দিবস/১
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম-এর আমলে বঙ্গভবন
ব্যাবহারিক প্রমিত বাংলা বানান সমগ্র