ড. মোহাম্মদ আমীন
জোড়কলম শব্দ মানে দুটো শব্দের অংশ ও তার অর্থ একসঙ্গে প্যাক-করা নতুন শব্দ। যে দুটি শব্দ নিয়ে জোড়কলম শব্দ গঠিত হয় তাদের প্রথমটির শেষাংশ ও দ্বিতীয়টির প্রথমাংশ ছেঁটে ফেললে যা থাকে তার একত্রীকরণে শব্দটি তৈরি হয় । অনেকটা গাছের অঙ্গজপ্রজননের জোড়কলম পদ্ধতির মতো, হয় তো গাছের অঙ্গপ্রজননের এই ধারনা থেকেই জোড়কলম শব্দ নামের উৎপত্তি । সুকুমার রায় এ রকশ মিশ্র শব্দকে খিচুড়ি শব্দ বলেছেন। এরূপ জোড়কলম বা খিচুড়ি শব্দের পুরোতঠাকুর হচ্ছেন চার্লস ডজজন বা Lewis Carroll (1832-1898). ইংরেজিতে শব্দগুলোকে portmantue বলা হয়। নামটিও দিয়েছেন ক্যারল। তাঁর ব্যবহৃত কিছু জোড়কলম শব্দের নমুনা দেখন :
slithy = slimy + lithe
mimsy = miserable + filmsy
frumious = furious + fumy
snark = snake + shark
ক্যারলের একটি গল্পে গাছের ডালে উপরে পা নিচে-মাথা হয়ে ঝুলছে কয়েকটি মানুষ। ক্যারল গাছটির নাম দিয়েছিলেন manypeeplia upsidownia. upsidownia = upside + down + ia). ইংরেজিতে এরূপ প্রচুর শব্দ আছে। একটি শব্দের প্রথম অংশের সঙ্গে অন্য একটি শব্দের শেষাংশ জুড়ে দিয়ে একটি নতুন শব্দ গঠন করা হয়েছে। উদাহরণ :
breakfast+lunch=brunch
motorist + hotel = motel
oxford + cambridge = oxbridge
camera+ recorder= camcorder
fantastic+fabulous= fantabulous
smoke+fog=smog
car+hijack= carjack
floating + hotel = floatel
export + import = exim
animation + electronics = animatronics
teacher+entrepreneur = teacherpreneur
Battery+ Rickshaw= Battericshaw
তেমনি E-mail, adugram (adult program) , netizen (network + citizen) এরূপ অনেক শব্দের উদাহরণ টানা যায়।
বাংলা ভাষায় বেশ কিছু জোড়-কলম শব্দ আছে। যেমন : ভাশুর(>ভ্রাতৃশ্বশুর), পশুরি (>পাঁচসেরি), ভাজ (>ভ্রাতৃজায়া), আমৈল্যা (আম+ বেল+ইয়া), গুমুট (গুল্ম +উট [আগাছা]), দাঙ্গামা (দাঙ্গা + হাঙ্গামা),বাংলা + ইংলিশ = বাংলিশ, বাবু + ইংলিশ = বাবুংলিশ, ধোঁয়া +কুয়াশা=ধোঁয়াশা, চা + কফি = চাফি, জল+রঙ=জল্রঙ, ফাগুন+দিনে=ফাগুনে প্রভৃতি। ইন্দো-ইউরোপিয়ানকে অনেকে বলেন ভারপিয় (ভারত + ইউরোপীয়)। বৈদিকে যুগেও এরূপ জোড়কলম বা খিচুড়ি শব্দের ব্যবহার ছিল। যেমন “ শ্যাব + শ্বেত = শ্বেত, পৃষৎ + উদর = পৃষদুদর>পৃষোদর, বারিবাহক> বলবাহক>বলাহক প্রভৃতি। হিন্দির একটি জনপ্রিয় জোড়কলম শব্দ দুধাঁড়ী = দুধ + হাঁড়ী। ইংরেজরা যতই বিচক্ষণ হোক না, কেন আমাদের মতো হতে পারবে না কখনও।যেখানে কলা আর কৌশল একত্রে প্রয়োগ হয় সেখানে কলার ক আর কৌশলের ল নিয়ে বাঙালি বানিয়েছি কল। কী অদ্ভুত জোর-মিলন।
সুকুমার রায়ের ‘খিচুড়ি’ নামের ছড়ায় এমন আরও কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন- হাতি + তিমি = হাতিমি, সিংহ + হরিণ = সিংহরিণ, বক + কচ্ছপ = বকচ্ছপ, গিরগিটি + টিয়া= গিরগিটিয়া ।
সুকুমার রায়ের ছড়াটি দেখুন :
হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল “হাঁসজারু” কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে – “বাহবা কি ফুর্তি !
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি ।”
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা-
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা ?
ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,
চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি !
জিরাফের সাধ নাই মাঠে ঘাটে ঘুরিতে,
ফড়িঙের ঢং ধরি’ সেও চায় উড়িতে।
গরু বলে “আমারেও ধরিল কি ও রোগে?
মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?”
হাতিমির দশা দেখ, – তিমি ভাবে জলে যাই,
হাতি বলে, “এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই।”
সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট।
হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট।
ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন জনের সৃষ্ট জোড়কলম শব্দগুলোর অধিকাংশই অভিধানে স্থান পেয়েছে। কিন্তু আমাদের বাংলা ভাষায় যেখানে অভিধানে শব্দ-গ্রহণ বা শব্দ-বর্জনের কোন নিয়মিত কার্যক্রম দূরে থাক, অনিয়মিত কার্যক্রমই যেখানে দেখা যায় না; সেখানে জোড়কলম শব্দগুলোই বা কীভাবে অভিধানে উঠবে! তবে তাতে বাংলাভাষীর কিছু যায় আসে না, ভাষা অভিধানের ধার ধারে না; বরং অভিধানকেই ভাষভাষীর শব্দ নিয়ে চল হয়।
গবেষণা, প্রাতিষ্ঠানিক অধ্যয়ন, মাতৃভাষা জ্ঞান, প্রাত্যহিক প্রয়োজন, শুদ্ধ বানান চর্চা এবং বিসিএস-সহ যে-কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটি লিংক :