ইউসুফ খান
টনক /টনোক্/ n. rigidity, firmness, firm attachment
‘সবাই কত করে বললো তাও শুনলে না, শেষে এতগুলো টাকা গচ্চা দিয়ে তবে তোমার টনকটা নড়লো’। ‘বন্যায় প্রতিবছর এত লোক মরে, তবুও সরকারের টনক নড়ে না’। ‘কপালে টনক নড়ে, হাতে হইতে হাতা পড়ে’
টনকো /টন্কো/ adj. rigid, firm, hard
‘বাপ্রে, দড়িটা ভীষণ টনকো, টেনে ছেঁড়া যাচ্ছে না একদম’। ‘পেয়ারা গাছের ডাল খুব টনকো হয়, সজনের ডাল একদম পটকা’। ‘বুড়োটা রোগা হলে কী হবে, ভীষণ টনকো, নৌকোটাকে ঝড়ের মধ্যে একাই টেনে নিয়ে গেলো’। ‘বুড়ি ভয়ানক টনকো, ছেলেরা এত রকম করে ভয় দেখালো, তাও কাউকে ভিটেটা লিখে দিলো না’। ‘টনক নড়া’ কথাটাতে ‘টনক’ মানে কী, এটা জানতে চেয়ে আমি একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। মানেটা এখন আমি নিজে এটুকু বুঝেছি:-
কোনও জিনিস থেকে ডং ডং করে আওয়াজ বেরোলে তা ডঙ্কা = ডঙ্কা; ঢং ঢং করে আওয়াজ বেরোলে ঢঙ্কা> ঢক্কা = ঢাক। ঘং ঘং করে আওয়াজ বেরোলে ঘংটা> ঘন্টা a gong ধ্বনি থেকে শব্দ এবং ভাষার জন্ম, এই থিওরি বেশ প্রচলিত। জীবন্ত সাঁওতালি ভাষায় এরকম ধ্বনি অনুকরণে তৈরি শব্দের

ছড়াছড়ি। যে জিনিস থেকে টং টং করে আওয়াজ বেরোয় তা টঙ্কা = টাকা। বাংলার প্রত্নরূপ কিছুটা পাওয়া যায় ওড়িয়া ভাষায়। ওড়িয়াতে টাকাকে এখনও টঙ্কা বলে। বাংলাতেও ছিলো টঙ্কা তঙ্কা। ধাতব মুদ্রার ধ্বনিকে তখন লোকে টং হিসেবেই শুনতো। টং টং আওয়াজ বেরোচ্ছে মানে তা ধাতব শক্ত hard strong rigid firm tough. যার মাথা ভরা বুদ্ধি, যেন মাথায় টোকা দিলে টং টং করে আওয়াজ হবে, তার টনটনে বুদ্ধি।
যার কোনও বিশ্বাসে rigidity আছে, দৃষ্টিভঙ্গিতে একাগ্রতা আছে, সেটাতে তার strong attention, firm attachment আছে। মানে, সেটাতে তার টনক আছে, এক ধেয়ানে সেটাতে আটকে আছে। চকিতে চেতনা ফিরে এলে তবে তার টনক নড়ে।
অন্ধকার চিরে যেমন হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে, নৈঃশব্দ্য ভেঙে যেমন ঘন্টি বেজে ওঠে, তেমনি করে কখনও সখনও অজ্ঞানতা ঠেলে আমাদের মাথায় চকিতে কিছু বুদ্ধি খেলে যায়। ফলে মাথার টনক নড়ে যায়। ঘন্টির আওয়াজের কাব্যিক নাম টিং টং টুং অনেক কিছুই হতে পারে। ইংরেজিতে একে বলে টিংকারিং tinker bell, হিন্দিতে বলে টনক্না, সংস্কৃতে বলে টঙ্কার। কান বাজা-কে ডাক্তারি পরিভাষায় ল্যাটিনে বলে tinnitus.
তাই হঠাৎ করে আমাদের মাথায় ভাবনার বিদ্যুৎ খেলে গেলে, ব্রেনের নিউরনে শিহরণ লেগে গেলে আমরা মনের কান দিয়ে টিং করে একটা কাব্যিক আওয়াজ শুনতে পাই। ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেসেজ ঢোকার আওয়াজের মতো। সেটাকে কমিকসে বাল্ব জ্বলা দিয়ে বোঝানো হয় আর অ্যনিমেশন কার্টুনে দেখা যায়, টম বা জেরির মাথার পাশে একটা বাল্ব জ্বলে ওঠে আর সঙ্গে টিং করে একটা আওয়াজও হয়। বাল্ব জ্বলার কোনও আওয়াজ নেই, কিন্তু ঘন্টি বাজার আওয়াজটা বাল্ব জ্বলার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। পৃথিবীতে বাল্বের আগেও ঘন্টি ছিলো, তাই বোধ হয় চকিতে মগজের তালা খুলে যাওয়ার সঙ্গে ঘন্টির অনুষঙ্গটা এসেই যায়। মাথার ঘন্টি বাজার আওয়াজ সাহেবরাও শুনতে পায়। লোকটাকে চিনতে পারছি না, কিন্তু লোকটার নামটা শোনার পর থেকেই ‘something is ringing in my mind’ কিংবা ‘do you hear a ringing sound in your brain’? এটাকেই আমরা বলি ‘টং করে আমার মাথার টনকটা নড়ে উঠলো’। ভাবনার একমুখীনতা নষ্ট হলো।
‘কপালে টনক নড়ে, হাতে হইতে হাতা পড়ে’ এটার মানে হতে পারে – ‘আমার আঁটকপাল, আমার ভাগ্য এক জায়গায় আটকে আছে, সেই টনকো কপালের টনকটা এতদিনে নড়ে উঠলো, এবার ভালো কিছু হতে চলেছে, তাই হাত থেকে হাতা পড়ে সেই শুভ লক্ষণের সূচনা দেখতে পাচ্ছি’। শব্দের উৎস থেকে সরে এলে, আমরা মানে বুঝতে না পেরে পরবর্তী সময়ে অনেক উল্টোপাল্টা ব্যাখ্যা করি, ব্যাখ্যা পড়ি। যেমন আঁটকুড়ো-কে অষ্টকুষ্ঠ, সাপের আঁচি-কে সাপের হাঁচি এরকম অজস্র উদাহরণ। একটা ডিকশনারিতে টনক নড়া-র মূল মানে ‘ললাটের শিরা কুঞ্চন’ দেওয়া হয়েছে, আমার মনে হয় সেটা ঠিক নয়।
আপনাদের মতামত চাই।
(ত্রুটি মার্জনীয়, শুদ্ধি প্রার্থনীয়)
উৎস: টনক ও টনকো ২, ইউসুফ খান, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
কলকাতা ২০২০ জুন ২০