ড. মোহাম্মদ আমীন

সংযোগ: https://draminbd.com/ডাগর-দিঘল-কথন-কী-মজা-তার-মর/
সংস্কৃত ‘দীর্ঘ’ শব্দ থেকে উদ্ভূত এবং বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ‘দিঘল’ শব্দের অর্থ- দীর্ঘ, আয়ত প্রভৃতি। আবার, বিশেষণ হিসেব ব্যবহৃত সংস্কৃত আয়ত(আ+√যম্+ত) শব্দের অর্থ বিস্তৃত, টানাটানা, প্রসারিত (আয়তলোচন)। নারীর লম্বা চুলের বৈশেষণিক শব্দ হিসেবে ‘দিঘল’ কাজল হয়ে বিশ্বের সব কৃষ্ণের অন্তরে মাতম তোলে। এই অর্থ নিয়ে কবি লিখেছেন : “কাজল কালো আঁখিরে তার দীঘল কালো চুল/সেই চুলে গাঁথা ছিল রক্তজবা ফুল।” আমি বলি, ‘‘ তোমার দিঘল চুলের কৃষ্ণমায়ায় হারিয়ে আমার নীড়/ ডাগর চোখে সাঁতরে মরি পাই না খুঁজে তীর।” কৃষ্ণচন্দ্র দে কী অপরূপ মমতায় ‘দিঘল’ শব্দে পৃথিবীর সব দরদ ঢেলে দিয়ে গেয়েছেন : “ওগো যামিনী তুমি দিঘল হয়ো/ মিনতি রাখো মম/আর মিলন ক্ষণ পোহায়ও নাকো/ আসিলে নিরূপম- – -।”
আয়ত শব্দের আর একটি অর্থ বিষম বাহুবিশিষ্ট সমচতুষ্কোণ; যেমন: আয়তক্ষেত্র। তবে আয়ত যখন সংস্কৃত ‘এয়োতি’ হতে সৃষ্ট হয় তখন এটি বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তখন শব্দটির অর্থ সধবা অবস্থা, সধবার লক্ষণ প্রভৃতি। তবে এই অর্থগুলো আমাদের আলোচ্য নয়। একসময় ‘দিঘল’ শব্দটির বানান ছিল দীঘল; যেমন: ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’।এটি খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের লেখা এবং ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত একটি কালজয়ী উপন্যাস।এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে মসিহউদ্দিন শাকেরে এবং শেখ নিয়ামত আলীর যৌথ পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্র। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি ছিল বাংলাদেশে সরকারি অনুদান-প্রাপ্ত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ছবিতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ডলি আনোয়ার, রওশন জামিল, জহিরুল হক, আরিফুল হক, কেরামত মাওলা এবং এটি এম শামসুজ্জামান।
দীঘল (দিঘল) শব্দের অর্থ যদি দীর্ঘ, বিস্তৃত, টানাটানা, প্রসারিত প্রভৃতি হয় তো “সূর্য দীঘল বাড়ী” কথার অর্থ কী? কথাটির শব্দভিত্তিক অর্থ হতে পারে সূর্যের দিকে বিস্তৃত বাড়ি, সূর্যের দিকে প্রসারিত বাড়ি। তবে ‘শব্দার্থ’ ও ‘পদার্থ’ কিংবা শব্দাদির সামষ্টিক অর্থ সবসময় অভিন্ন হয় না। তাই সূর্য দীঘল বাড়ী’ কথার অর্থ কেবল ‘সূর্যের দিকে বিস্তৃত/প্রসারিত’ বাড়ি নয়।এককভাবে দীঘল (দিঘল) শব্দের অর্থ যাই হোক না কেন, সূর্য দীঘল বাড়ী (সূর্য দিঘল বাড়ি) কথার অর্থ পূর্ব-পশ্চিম দিকে তথা সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত অভিমুখী বা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দিকে প্রসারিত/বিস্তৃত বাড়ি। এরূপ বাড়ি নিয়ে বিভিন্ন এলাকায়, বিশেষ করে শরীয়তপুর-মাদারীপুর অঞ্চলে একটা কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। সেটি হচ্ছে- এরূপ বাড়িতে বসবাসকারীর বংশ নির্বংশ হয়ে যায়। তাই কেউ এমন বাড়িতে থাকে না, প্রয়োজন হলে রাস্তায় পড়ে থাকে।
তদ্ভব ডাগর শব্দটিও সংস্কৃত ‘দীর্ঘ’ শব্দে থেকে সৃষ্ট। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে বাক্যে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত ডাগর শব্দটির অর্থ দিঘল, বড়ো, বিশাল, উৎকৃষ্ট, মূল্যবান, বয়স্ক। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল/ সে কি আমারি পানে ভুলে/পড়িবে না।”দীঘল শব্দটি বাংলা গানে যত মমতায় এসেছে, এনেছেন কবিরা, তা খুব কম শব্দের ভাগ্যে জুটেছে। গীতিকার শাহেদ আলী মজনু লিখেছেন :“শ্যামলা মায়ের ডাগর চোখে কী মায়া লুকানো/ কাজল খোঁপায় ও তার কাজল খোঁপায়/ পরাগ মাখা অনেক শরম জড়ানো। আর এক কবি লিখেছেন, কবি লিখেছেন : “শ্যামলবরন মেয়েটি ডাগর কালো আঁখিটি/ না না না তার নাম বলব না—।”
দিঘল ও ডাগর-এর পিতার নাম ‘দীর্ঘ’। পিতা অভিন্ন হলেও উভয়ের আচরণ, অর্থ, প্রয়োগ ও আলংকরিক দ্যোতনায় বিশাল পার্থক্য রয়েছে। পিতার সব সন্তান তো আর অভিন্ন আচরণের হয় না। দীঘল ও ডাগরের ক্ষেত্রে তা হয়েছে, তবে একই পিতার সন্তান হিসেবে কিছুটা মিল আছেই। যেমন থাকে, মানুষেও। ডাগর ও দিঘল শব্দকে মিলিয়ে নিলে ডাগর শব্দের অর্থ হয়, দীর্ঘ, বিস্তৃত, টানাটানা, প্রসারিত বড়ো, বিশাল, উৎকৃষ্ট, মূল্যবান এবং বয়স্ক।শব্দার্থ বিবেচনায় ডাগর শব্দটির মতো উৎকৃষ্ট এবং কাব্যে নারীর বৈচিত্র্যিক রূপায়নে ব্যবহার করা যায় এমন সহজবোধ্য ও সহজোচ্চারিত শব্দ খুব কমই আছে। হেমন্তের গলায় কী দারুণ ডাগরতায় ছলকে উঠেছে ডাগর শব্দের প্রসারিত দীঘলতা : “ডাগর ডাগর চোখে কেন কাজল দিলে–”।