কীভাবে হলো দেশের নাম (ইউরোপ)
ড. মোহাম্মদ আমীন
ডেনমার্ক (Denmark)
ডেনমার্ক উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। এর সরকারী নাম কিংডম অব ডেনমার্ক। ভাইকিংয়েরা ১,১০০ বছর আগে ডেনিয় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এটি ইউরোপের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী রাজত্বের একটি। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ডেনমার্ক স্ক্যান্ডিনেভিয়ার একটি অংশ। বিগত শতকগুলোতে ডেনমার্কের রাজারা সমগ্র নরওয়ে ও সুইডেন বা এদের কিয়দংশ শাসন করেছেন। তারা দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ডও শাসন করেছেন। ভৌগলিকভাবে ডেনমার্ক উত্তরের স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোর সঙ্গে মহাদেশীয় ইউরোপের সেতুবন্ধন হিসাবে কাজ করে। ডেনমার্কের ম্যাপ অদ্ভুদ আকৃতির। মনে হবে, একটি মোটা মানুষের শরীর থেকে পচা চামড়া খসে পড়ছে একটি মাছ তার পায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং লোকটি একটি উদ্ভট-দর্শন ভূতের সঙ্গে কথা বলছে।
ডেনমার্ক নামের ব্যুৎপত্তিগত বিবরণ নিয়ে একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে। অনেকে বলেন, সম্ভবত দক্ষিণের শ্লেসভিগ অঞ্চলে অবস্থিত ড্যানিশ বন (The Danish forest) বা অগ্রযাত্রা (march) শব্দ হতে নামটির উদ্ভব। অনেকে বলেন, প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয়ান ডেন (dhen) শব্দের অর্থ ‘নিচু বা সমতল ভূমি’ এবং একই ভাষার শব্দ মার্জ (mereg-) হতে পরিবর্তিত শব্দ মার্ক (-mark) অর্থ প্রান্ত বা সীমান্ত বা চিহ্নিত বা নির্ধারিত। ব্যাখ্যামতে, প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপীয়ান উৎসের শব্দ ডেন ও মার্ক যুক্ত হয়ে ডেনমার্ক নামের উদ্ভব। যার অর্থ সমতল ভূমির দেশ বা সমতল ভূমির প্রান্ত বা সমতল ভূমির প্রান্ত। অনেকের মতে, মধ্যযুগের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান গ্রন্থে বর্ণিত পৌরাণিক রাজা ড্যান (Dan) হতে ডেনমার্ক নামের উদ্ভব। এর অর্থ ডেন রাজা এলাকা বা ডেন এর অধিভুক্ত এলাকা।
ডেনমার্কের মোট আয়তন ৪২,৯১৫.৭ বর্গকিলোমিটার বা ১৬,৫৬২.১ বর্গমাইল। গ্রিনল্যান্ডের আয়তন ২,১৬৬.০৮৬ বর্গকিলোমিটার এবং ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জের আয়তন ১,৩৯৯ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে ডেনমার্কের মোট জনসংখ্যা ৫৬,৯৯,২২০ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা ১৩২.৮। আয়তন বিবেচনায় ডেনমার্ক পৃথিবীর ১৩৩-তম বৃহত্তম দেশ। ডেনমার্কের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর কোপেনহেগেন। দাপ্তরিক ভাষা ডেনিশ এবং আঞ্চলিকভাবে স্বীকৃত ভাষা ফ্যারোস, গ্রিনল্যান্ডিক ও জার্মান। চার্চ অব ডেনমার্ক অধিকাংশ লোকের ধর্ম। সরকারিভাবে ডেনমার্কের নাগরিকদের ডেনিশ বা ডেন বলা হয়। সরকার ব্যবস্থা একক সংসদীয় রাজতন্ত্র। ১২১৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৫ জুন ডেনমার্কের পতাকা প্রথম গ্রহণ করা হয়।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবমতে, ডেনমার্কের জিডিপি (পিপিপি) ২৫৭.১৪৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৪৫,৪৩৫ ইউএস ডলার। অন্যদিকে জিডিপি (নমিনাল) ২৯১.০৪৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার এবং মাথাপিছু আয় ৫১,৪৫৪ ইউএস ডলার। মাথাপিছু আয় বিবেচনায় ডেনমার্ক পৃথিবীর ৬ষ্ঠ ধনী দেশ। মুদ্রার নাম ডেনিশ ক্রোন।
বর্তমানে ডেনমার্ক জুটলান্ড উপদ্বীপের অধিকাংশ এলাকার উপর অবস্থতি একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। এছাড়াও ডেনমার্ক ডেনীয় দ্বীপপুঞ্জের বহু শত দ্বীপ নিয়ন্ত্রণ করে। জুটলান্ডের দক্ষিণ সীমান্ত জার্মানিকে স্পর্শ করেছে। এই সীমান্তের দৈর্ঘ্য মাত্র ৬৮ কিমি। দ্বীপসমূহের মধ্যে জেলান্ড দ্বীপটি সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ। ডেনমার্কের ৬০০ বছরের রাজধানী কোপেনহাগেনের বৃহত্তর অংশ জেলান্ডের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। স্কটল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমে ১৮টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত ফারো দ্বীপপুঞ্জ এবং উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অধীন। রাজনীতিকভাবে ফারো দ্বীপপুঞ্জ ও গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অংশ হলেও প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্কের ব্যাপারগুলো ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে এরা স্বশাসিত।
ডেনমার্ক ধনী ও অত্যন্ত আধুনিক একটি দেশ। এখানকার নাগরিকেরা ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু জীবনযাত্রার মান উপভোগ করেন। ডেনীয়রা তাদের সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহারে চাতুর্য ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। ফ্যাশন, শিল্পকারখানার ডিজাইন, চলচ্চিত্র ও সাহিত্য ডেনীয়রা অত্যন্ত দক্ষ। বিশ্বখ্যাত রূপকথার লেখক হান্স ক্রিস্টিয়ান আন্ডারসন এবং বিখ্যাত দার্শনিক সরেন কিয়ের্কেগর ডেনমার্কের অধিবাসী।
ডেনিশ অভিধানে প্লিজ বলে কোনো শব্দ নেই। ডেনমার্কের অধীনে ৪৪৩ নামের দ্বীপ আছে। তন্মধ্যে ৭৬টি দ্বীপে বসতি আছে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের জরিপমতে, ডেনমার্ক সবচেয়ে কার্যকর গণতান্ত্রিক এবং সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিবেচনায় এর স্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়। ইউনিসেফের হিসাবমতে, নেদারল্যান্ডস ও সুইডেনের পর শিশুদের কল্যাণ বিবেচনায় এর স্থান পৃথিবীতে তৃতীয়। কর্মসংস্থানের হিসাবে ডেনমার্কের স্থান ইউরোপে সর্বোচ্চ এবং কর্মসংস্থানের হার ৭৫%। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ হিসাবে খ্যাত। ডেনিশ রাজতন্ত্র হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম রাজতন্ত্র, যা অবচ্ছিন্নভাবে গত ১০০০ বছর চলে আসছে। ডেনমার্কে কারের সংখ্যা ১.৮ মিলিয়ন এবং বাইসাইকেলের সংখ্যা ৪.২। কোপেনহেগেনের অধিবাসীরা প্রতিদিন ১.১৩ মিলিয়ন কিলোমিটারের অধিক দূরত¦ তাদের বাইসাইকেলে যাতায়াত করে।
ডেনমার্কের তটরেখার দৈর্ঘ্য ১১,৭৭১ কিলোমিটার, যা চীনের মহাপ্রাচীরের চেয়ে অধিক। মাথাপিছু প্রতি ডেনিশের তটরেখার দৈর্ঘ্য ১.৫ মিটার। ডেনিশরা গড়ে ৩২ বছর বয়সে বিয়ে করে। এটি ইউরোপে সবচেয়ে অধিক বয়সের বিয়ে। এখানে বয়স ভালবাসায় কোনো বাধা নয়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ১০০ বছর বয়স্ক এক ডেনিশ, ৯৪ বছর বয়স্কা এক মহিলাকে ভালবেসে বিয়ে করে। সবচেয়ে কমবয়স্ক বর-কনের বয়স ছিল যথাক্রমে ১৯ ও ১৮। পর্নগ্রাফি ডেনমার্কে বৈধ, পেট্রল পাম্পেও পর্নগ্রাফি কিনতে পাওয়া যায়। ডেনমার্কের কোনো অংশই সমুদ্র হতে ৫০ কিলোমিটারের অধিক দূরে নয়। জার্মানি ছাড়া মূলত আর কোনো দেশের সঙ্গে ডেনমার্কের বাস্তব কোনো সীমান্ত নেই। যুক্তরাষ্ট্র ভার্জিনিয়া দ্বীপ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিয়দংশ ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে ডেনমার্ক থেকে ক্রয় করে।
সাইপ্রাস (Cyprus) : ইতিহাস ও নামকরণ
চেক রিপাবলিক (Czech Republic) : ইতিহাস ও নামকরণ
সূত্র: কীভাবে হলো দেশের নাম, ড. মোহাম্মদ আমীন, পুথিনিলয়, বাংলাবাজার, ঢাকা।
বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিষয়ক সকল গুরুত্বপূর্ণ সাধারণজ্ঞান লিংক