ঢেঁকি ধান ভানা বা শস্য কাঁড়ানোর জন্য ব্যবহৃত কাষ্ঠনির্মিত একটি সরল যন্ত্রবিশেষ। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, ঢেঁকি হিন্দি শব্দ এবং বাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হিন্দি ঢেংকি থেকে উদ্ভূত ঢেঁকি অর্থ— (ধান ভানা বা শস্য কাঁড়ানোর জন্য ব্যবহৃত) পায়ের চাপ দিয়ে চালানো হয় এমন মুষলযুক্ত কাঠের সরঞ্জমাবিশেষ; নারদমুনির বাহন এবং বিশেষণে (আলংকারিক)— নির্বোধ (বুদ্ধির ঢেঁকি)। অনেকের মতে, ঢেঁকি দেশি (সাঁওতালি) শব্দ।
যে ঘরে ঢেঁকিতে ধান ভানা হয় তাকে বলা হয় ঢেঁকিশাল। ঢেঁকি, ঢেঁকিশাল বা যেখানে যাক না, তার কাজ ধানভানা। এজন্য বাংলা

প্রবাদে বলা হয়, ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। ধান ভানা ছাড়া আর কোনো কাজ সে করতে পারে না। তাই ঢেঁকি শব্দের আরেক অর্থ বোকা; বুদ্ধির ঢেঁকি। যত বোকাই বলা হোক না, ঢেঁকি কিন্তু পৌরাণিক কাহিনিমতে, নারদ মুনির বাহন। অত বোকা হলে নারদ মুনি কি ঢেঁকিকে তাঁর বাহন করতেন?
এক খণ্ড পাথরের চটান বা কাঠখণ্ডে ছোটো গর্ত খুঁড়ে মুষলের সাহায্যে ধানাভানা বা শস্য কাঁড়ানো হয়। মুষলটির মাথায় লোহার পাত জড়ানো থাকে। ৪/৫ হাত লম্বা একটি ভারি কাঠের আগায় মুষলটি লাগিয়ে দেওয়া হয় । ভারি কাঠের গোড়ার দিকটি একটা আড়কাঠির সাহায্যে দুটি শক্ত খুঁটির উপর রাখা থাকে। সাধারণত ঢেঁকির দুটি অংশ। (বিস্তারিত)
একটি ঢেঁকি সাধারণত ৫ থেকে ৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতো। এর সামনের অংশে একজন ফাঁকে ফাঁকে হাত দিয়ে শস্য নেড়ে দেয়। পেছনের অংশে দুজন অথবা একজন পা দিয়ে ঢেঁকি নিচের দিকে আঘাত করে। ফলে মুষল ওপরের দিকে উঠে যায়। ছেড়ে দিলে মুষল নিচে পড়ে শস্যে আঘাত করে। এভাবে মুষলের চাপে ধান, চাল কিংবা গম ভানা হতো।
ধান ভানা বা শস্য কাঁড়ানোর কাজ অত সহজ নয়। তাই শক্ত কাঠ দিয়ে ঢেঁকি বানানো হতো। সাধারণত বাবলা, তেঁতুল, গাব কিংবা কড়ই-জাতীয় শক্ত গাছ দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করা হতো। আমড়া গাছ নরম। তা দিয়ে ঢেঁকি তৈরি করলে কাজ হতো না। তাই অপদার্থ, অথর্ব প্রভৃতি অর্থে বলা হয়— আমড়া কাঠের ঢেঁকি বা আমড়া গাছের ঢেঁকি। ঢেঁকি নিয়ে বাংলায় আরও অনেক প্রবাদ প্রবচন রয়েছে। যেমন: ঢেঁকি গেলা, বুকে ঢেঁকির পাড় প্রভৃতি। ঢেঁকি নিয়ে রয়েছে অনেক চমৎকার ছড়া-প্রবচন:
“চিরা কুটি, বারা ভানি,
হতিনে করইন কানাকানি।
জামাই আইলে ধরইন বেশ
হড়ির জ্বালায় পরান শেষ।”
ঢেঁকিতে ধান ভানার কাজটি সাধারণত মহিলার করতেন। শস্য কোটার জন্য ঢেঁকির গর্তে শস্য ঢেলে দিয়ে এক জন বা দুই জন মিলে ঢেঁকির গোড়ায় পা দিয়ে একই সময়ের ব্যবধানে তালে তালে একটির পর একটি চাপ দিয়ে যায়। মুষলের সমব্যবধানের উত্থান-পতনের আঘাতে সৃষ্টি হয় অপূর্ব তাল। মুষলের এই উত্থান-পতনের তালে তালে গাওয়া হয় নানা ঢেঁকিসংগীত:
‘ও ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া
আমি নাচি, তুমি নাচ হেলিয়া দুলিয়া
ও ধান ভানিরে……।
ধান বেচিয়া কিনমু শাড়ি
পিন্দিয়া যাইমু বাপর বাড়ি
স্বামী যাইয়া লইয়া আইব
গরুর গাড়ি দিয়া
ও ধান ভানিরে…।’
ঢেঁকি ছাটা চালে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন থাকে। তাই এ চালের চাহিদা প্রচুর। একসময় আমাদের দেশের প্রায় প্রতিটি কৃষক পরিবারে ঢেঁকি ছিল। ভোর হতে না হতেই ঢেঁকি দিয়ে ধান, চাল ও গম ভানা শুরু হতো। ঢেঁকির ধাপুর-ধুপুর শব্দ এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ত অনবদ্য এক চেনা সুর।এখন ঢেকির ব্যবহার খুব একটা চোখে পড়ে না। যান্ত্রিক সভ্যতার ভিড়ে ঢেঁকির ব্যবহার প্রায় বিলুপ্ত পথে।
উৎস: ড. মোহাম্মদ আমীন, বাংলা ভাষার মজা, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.
বাকি অংশ ও বিস্তারিত: ঢেঁকি: ও ধান ভানিরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া
লিংক: https://draminbd.com/ঢেঁকি-ও-ধান-ভানিরে/
পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. ড. মোহাম্মদ আমীন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.