ড. মোহাম্মদ আমীন
ণত্ব-বিধান/১
যুক্তব্যঞ্জনে ট-বর্গের পূর্বে মূর্ধন্য-ণ: তৎসম শব্দে সাধারণত যুক্তব্যঞ্জনে ট-বর্গের বর্ণগুলোর পূর্বে মূর্ধন্য-ণ বসে। অর্থাৎ যুক্তব্যঞ্জনে /ট ঠ ড ঢ ণ/ বর্ণসমূহের পূর্ববর্তী /দন্ত্য-ন/ পরিবর্তিত হয়ে /মূর্ধন্য-ণ/ হয়ে যায়। যথা:
১. ট: ণ্ট (ণ্+ট) : কণ্টক, ঘণ্ট, ঘণ্টা, নির্ঘণ্ট, নিষ্কণ্টক, বণ্টন;
২. ঠ: ণ্ঠ (ণ্ +ঠ) : অবগুণ্ঠন, উৎকণ্ঠা, কণ্ঠ, কুণ্ঠা, লণ্ঠন, লুণ্ঠন;
৩. ড: ণ্ড (ণ্+ড): কুণ্ডলী, কাণ্ড, খণ্ড, গণ্ডার, গণ্ডি, ঠাণ্ডা, দণ্ড, পণ্ডিত, ষণ্ড, ষণ্ডা, মণ্ডলী, প্রকাণ্ড, দণ্ড ভণ্ড।
৪. ঢ: ণ্ঢ (ণ্ + ঢ): ঢুণ্ঢি, ঢেণ্ঢন;
৫. ণ: ণ্ন (ণ্+ণ): অক্ষুণ্ণ, ক্ষুণ্ণ, বিষণ্ণ।
ণত্ব-বিধান/২: ঋ র ষ এর পর মূর্ধন্য-ণ
তৎসম শব্দে /ঋ, র/র-ফলা/রেফ, ষ/ক্ষ/ প্রভৃতি বর্ণ বা ফলা-সমূহের পরবর্তী /দন্ত্য-ন/ পরিবর্তিত হয়ে মূর্ধন্য-ণ/ হয়। যেমন:
১. ঋ, ঋ-কার এর পর মূর্ধন্য-ণ: ঋণ, ঋণী, ঘৃণা, তৃণ, মসৃণ, মৃণাল;
২. র-এর পর মূর্ধ

ন্য-ণ: অরণি, অরণ্য, অরুণ, অলংকরণ, আবরণ, আচরণ, আহরণ, উচ্চারণ, কারণ, করুণ, তরণী, তরুণ, তোরণ, ত্বরণ, দারুণ, ধরণী, ধারণ, ধারণা, পূরণ, পূরাণ, প্রেরণ, প্রেরণা, বরণ, বারণ, ব্যাকরণ, ভরণ, মরণ, রণ, শরণ, শরণার্থী, সাধারণ, সারণি, স্মরণ, হরিণ;
৩. র-ফলার পর মূর্ধন্য-ণ: আমন্ত্রণ, ঘ্রাণ, চিত্রণ, ত্রাণ, নিমন্ত্রণ, যন্ত্রণা, মন্ত্রণা, নিয়ন্ত্রণ, পরিত্রাণ, প্রণতি, প্রণীত, প্রাণ, প্রাণী, ব্রণ, ভ্রূণ, মিশ্রণ, মুদ্রণ, যন্ত্রণা, শ্রেণী, স্ত্রৈণ;
৪. রেফ-এর পর মূর্ধন্য-ণ: অর্থব, আকীর্ণ, উদ্গীর্ণ, কর্ণ, কীর্ণ, ঘূর্ণন, ঘূর্ণি, চূর্ণ, জীর্ণ, দীর্ণ, নির্ণয়, পর্ণ, পূর্ণ, পূর্ণিমা, বর্ণ, বর্ণনা, বিকীর্ণ, বিদীর্ণ, বিস্তীর্ণ, শীর্ণ, স্বর্ণ;
৫.মূর্ধন্য-ষ এর পর মূর্ধন্য-ণ: অণ্বেষণ, চূষণ, তোষণ, দূষণ, বিদূষণ, নিষ্পেষণ, পোষণ, পেষণ, বিশেষণ, বিশ্লেষণ, বিভীষণ, ভাষণ, ভীষণ, ভূষণ, শোষণ, কৃষাণ, পাষাণ, বিষাণ, আকর্ষণ, কর্ষণ, ঘর্ষণ, ধর্ষণ, বিকর্ষণ, বর্ষণ, এষণা, ঘোষণা, গবেষণা, বিষণ্ন;
৬. ষ্ণ (ষ+ণ) এর পর মূর্ধন্য-ণ: কৃষ্ণ, ঈষধুষ্ণ, উষ্ণ, শীতোষ্ণ, তৃষ্ণা, কৃষ্ণা, ক্ষয়িষ্ণু, বর্ধিষ্ণু, চলিষ্ণু, জিষ্ণু, বিষ্ণু, সহিষ্ণু, বৈষ্ণব, উষ্ণীষ ইত্যাদি;
৭. ক্ষ এর পর মূর্ধন্য-ণ: ঈক্ষণ, ক্ষণ, ভক্ষণ, রক্ষণ, লক্ষণ, শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ, নিরীক্ষণ, পরীক্ষণ, বিচক্ষণ, বীক্ষণ, দূরবীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, সংরক্ষণ, সমীক্ষণ, দক্ষিণ, প্রদক্ষিণ, দক্ষিণা, তীক্ষ্ণ, ক্ষীণ, ক্ষুণ্ণ।
ণত্ব-বিধান/৩: সাধিত শব্দে মূর্ধন্য-ণ
সাধিত শব্দে (উপসর্গ, সন্ধি বা সমাসযোগে গঠিত শব্দ) /ঋ র ষ ক্ষ/ এর পরবর্তী /দন্ত্য-ন/ সাধারণত অপরিবর্তিত থাকে। তবে বিশেষ নিয়মে /দন্ত্য-ন/ কখনও কখনও মূর্ধন্য-ণ হয়ে যায়।
(ক). /পরি- -প্র- নির-/ এ তিনটি উপসর্গের পর দন্ত্য-ন থাকলে তা মূর্ধন্য-ণ হয়ে যায়। যেমন: পরিণত, পরিণতি, পরিণয়, পরিণাম, পরিবহণ, প্রণত, প্রণাম, প্রণয়ন, প্রণিধান, প্রণিপাত, প্রণীত, প্রণোদিত, প্রবণ, প্রমাণ, প্রবাহিনী, প্রবীণ, নির্ণয়, প্রয়াণ এবং পরিণাম। ব্যতিক্রম: প্রনষ্ট, পরিনির্বাণ, নির্নিমেষ।
(খ). র, বা র-ফলার পর পরবর্তীপদে -অয়ন শব্দ থাকলে ঐ শব্দের /দন্ত্য-ন/ পরিবর্তিত হয়ে /মূর্ধন্য-ণ/ হয়। যেমন: উত্তরায়ণ, চান্দ্রায়ণ, নারায়ণ, পরায়ণ, রবীন্দ্রয়ণ ইত্যাদি।
(গ) /অপর-, পরা-, পূর্ব-, প্র-/ প্রভৃতি উপসর্গের পূর্বপদের পর /অহ্ন/ শব্দ যুক্ত হলে ণত্ববিধান অনুসাতে /দন্ত্য-ন/ এর স্থলে /মূর্ধন্য-ণ/ হয়। যেমন: অপরাহ্ণ, পরাহ্ণ, পূর্বাহ্ণ, প্রাহ্ণ ইত্যদি। তবে অহ্ন, চিহ্ন, জাহ্নবী, সায়াহ্ন প্রভৃতি বানানে হ-য়ে দন্ত্য-ন হয়।
(ঘ). সাধিত শব্দ হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু শব্দে /র/ এর প্রভাবে /দন্ত্র-ন/ পরিবর্তিত হয়ে /মূর্ধন্য-ণ/ হয়ে যায়। যেমন: অগ্রণী, গ্রামণী, গ্রামীণ ইত্যাদি। তবে অগ্রনেতা, অগ্রনায়ক প্রভৃতি শব্দে দন্ত্য-ন হয়।
(ঙ). কোন কিছুর নাম বুঝাতে এক শব্দ বলে বিবেচিত হলে সাধিত শব্দে ণত্ব-বিধান অনুযায়ী দন্ত্য-ন এর স্থলে মূর্ধন্য-ণ হয়। যেমন: অগ্রহায়ণ, শূর্পণখা ইত্যাদি।
ণত্ব-বিধান/৪: বর্ণ-বর্গ ও মূর্ধন্য-ণ
একই শব্দের মধ্যে /ঋ, র, র-ফলা, রেফ, ষ, ক্ষ/ এর যে কোনটির পর যদি স্বরবর্ণ, ক-বর্গের ৫টি (ক খ গ ঘ ঙ), প-বর্গের ৫টি ( প ফ ব ভ ম), এবং (য য় হ ং) প্রভৃতি বর্ণের এক বা একাধিক বর্ণ থাকে তাহলে পরবর্তী /দন্ত্য-ন/ ধ্বনি /মূর্ধন্য-ণ/ হয়ে যায়। যেমন: অকর্মণ্য, আক্রমণ, আরোহণ, উৎক্ষেপণ, উপক্রমণিকা, কৃপণ, কৃপাণ, ক্ষেপণাস্ত্র, গ্রহণ, গৃহিণী, চর্বণ, তর্পণ, দর্পণ, দ্রবণ, দ্রাবণ, নিরূপণ, নির্বাণ, নিষ্ক্রমণ, পার্বণ, বৃংহণ, ব্রাহ্মণ, ভ্রমণ, ভ্রাম্যমাণ, ম্রিয়মান, রমণী, রামায়ণ, রুগ্ণ, রক্ষ্ণণ, শ্রবণ, শ্রাবণ, সন্তর্পণ, সংক্রমণ, সমর্পণ, সর্বাঙ্গীন, অর্পণ, প্রাঙ্গণ ইত্যাদি।

কোথায় কোথায় ণত্ব বিধান নিষেধ বা খাটে না
ত-বর্গযুক্ত দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- বৃন্ত, বৃন্দ, গ্রন্থ, আক্রান্ত, কর্তন।
বাংলা ক্রিয়াপদের অন্তঃস্থিত দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- ধরেন , মারেন, করেন, যাবেন, খাবেন, হবেন, নিবেন, দিবেন।
বিদেশি শব্দের দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- কোরআন, জার্মান, জবান, নিশান, ফরমান, রিপন।
সন্ধিতে পূর্বপদে ঋ, র, ষ থাকলেও পরপদে দন্ত্য-ন মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- মৃগনাভি, দুর্নাম, ত্রিনেত্র, মৃন্ময়।
পদের শেষের হসন্তযুক্ত ‘দন্ত্য-ন’ মূর্ধন্য-ণ হয় না। যেমন- কর্মন্, ব্রাহ্মন্।
এবার নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর খোজার চেষ্টা করুন
(১) তৎসম শব্দে ক্ষ-এর পর সাধারণত মূর্ধণ্য-ণ হয়। যেমন: ক্ষণ, ক্ষীণ, ক্ষীয়মাণ, ক্ষুণ্ন, ক্ষুণ্নমনা ইত্যাদি। ‘ক্ষুণ্ন’ ও ‘ক্ষুন্নিবৃত্তি’ ‘ক্ষুন্নিবারণ’ শব্দ-দুটোর বানান লক্ষ করুন। ‘ক্ষুণ্ন’ শব্দের বানানে /মূর্ধন্য-ণ ফলা/ কিন্তু ‘ক্ষুন্নিবৃত্তি’ ও ক্ষুন্নিবারণ শব্দের বানানে /দন্ত্য-ন/ এর দ্বিত্ব হয়েছে। কিন্তু কেন?

(২) ‘অন্তঃস্থ- র’ বর্ণের পর সাধরণত ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়। যেমন: করণ, বরণ, ধারণ ইত্যাদি। কিন্তু ‘ধরণ’ ও ‘দরুন’ বানানে দন্ত্য-ন কেন?
(৩) তৎসম শব্দের বানানে ‘রেফ’-এর পর ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়। তাই বানানে সাধারণত ‘রেফ’-এর পর দন্ত্য-ন দেখা যায় না। কিন্তু অহর্নিশ, দুর্নাম, দুর্নিবার প্রভৃতি শব্দের বানানে ‘দন্ত্য-ন’ কেন?
(৪) আমরা জানি ‘র’-বর্ণের পরস্থিত তৎসম শব্দের বানানে সাধারণত ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়। কিন্তু, দুর্নীতি, দুরপনেয়, দুর্নাম, দুর্নিবার, দুরন্বয় ইত্যাদি তৎসম শব্দ হওয়া সত্ত্বেও ‘র’- বর্ণের পর ‘দন্ত্য-ন’ কেন?
৫. তৎসম শব্দে র, ঋ বা ক্ষ প্রভৃতির পর ‘মূর্ধন্য-ণ’ হয়। গণক, গণনা, গণিত, গণৎকার, গণনীয়, গণ্য, গণশক্তি, গণনায়ক প্রভৃতি শব্দে র, ঋ, ক্ষ বা তাদের কোনো কার-চিহ্ন নেই; তবু বানানে মূর্ধন্য-ণ কেন?
(৬) অর্চনা, দর্শন, প্রার্থনা, রচনা, রটনা প্রভৃতি তৎসম শব্দ। শব্দের গঠন বলছে, ণত্ববিধি অনুযায়ী এসব শব্দের বানানে ‘মূর্ধন্য-ণ’ হওয়া উচিত । কিন্তু ‘দন্ত্য-ন’ কেন?
(৭) ব্রাহ্মন্ ও শ্রীমান্ তৎসম শব্দ।এজাতীয় তৎসম শব্দের বানানে ণত্ব-বিধি অনুযায়ী মূর্ধন্য-ণ হওয়ার কথা, কিন্তু ‘ব্রাহ্মন্’ ও ‘শ্রীমান্’ বানানে দন্ত্য-ন কেন?
৮. ‘অগ্রহায়ণ’ ‘ণ’ হওয়ার কথা না। তারপরও বানানে মূর্ধন্য-ণ। অন্যদিকে ‘অঘ্রান’ শব্দের বানানে ‘ণ’ হওয়ার কথা, কিন্তু দন্ত্য-ন; কেন?
(৯). আক্রমণ বানানে ‘মূর্ধন্য-ণ’, কিন্তু আক্রান্ত শব্দের বানানে দন্ত্য-ন কেন?
(১০) কর্নেল, ওয়ারেন্ট, কারেন্ট প্রভৃতি শব্দের বানানে ‘দন্ত্য-ন’ কেন?
উত্তরগুলো জানা থাকলে ভালো।জানা না থাকলে এই লিংকে ক্লিক করুন: নত্ববিধি কত সহজ : কেন বানানগুলো এমন : প্রশ্নোত্তরে ণত্ববিধি। উত্তর পেয়ে যাবেন।
বাংলা বানান কোথায় কী লিখবেন এবং কেন লিখবেন/১
কি না বনাম কিনা এবং না কি বনাম নাকি
মত বনাম মতো : কোথায় কোনটি এবং কেন লিখবেন
ভূ ভূমি ভূগোল ভূতল ভূলোক কিন্তু ত্রিভুবন : ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ