এবি ছিদ্দিক
ধর্ম-জাত নির্বিশেষে চান্দ্রমাস ও চান্দ্রদিবসের এক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাঙালিদের মধ্যে এর গুরুত্ব আরো বেশি। বাঙালি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ইদ-রোজা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজাপার্বণ, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পূর্ণিমার উৎসব, উপজাতিদের নানান উৎসব—

প্রায় সবকটির সঙ্গেই চান্দ্রমাস এবং নির্দিষ্ট চান্দ্রদিবস জুড়ে রয়েছে। এসবের প্রয়োজনে জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রতিটি চান্দ্রমাসকে ত্রিশটি দিনে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি চান্দ্রমাসের এই এক একটি দিনকে তিথি বলা হয়। অর্থাৎ, ত্রিশ তিথিতে এক চান্দ্রমাস। এই ত্রিশ তিথিকে আবার দুই পক্ষে বিভক্ত করা হয়। পনেরো চান্দ্রদিবস নিয়ে এক একটি পক্ষ। চান্দ্রমাসের প্রথম তিথি থেকে পঞ্চদশ তিথি পর্যন্ত হচ্ছে ‘শুক্লপক্ষ’ এবং ‘ষোড়শ’ তিথি থেকে ‘ত্রিংশ’ তিথি পর্যন্ত হচ্ছে ‘কৃষ্ণপক্ষ’।
‘শুক্ল’ অর্থ ‘শুভ্র’। চান্দ্রমাসের প্রথম পনেরো তিথিতে চাঁদের আকার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে অধিক পরিমাণে আলো ছড়িয়ে পৃথিবীকে আলোকিত (শুভ্র) করে বলে প্রথম পক্ষকে ‘শুক্লপক্ষ’ বলা হয়। শুক্লপক্ষের প্রথম দিনকে ‘প্রতিপদ’ বলা হয়। তার পরের দিনগুলো যথাক্রমে দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী নামে সংজ্ঞায়িত। শুক্লপক্ষের এই দিনগুলোতে চাঁদের আকার একটু একটু বৃদ্ধি পেয়ে পঞ্চদশ দিনে গিয়ে পূর্ণ রূপ লাভ করে। ‘√পৄ’ থেকে ‘পূর্ণ’ ও ‘পূর্ণি’, যার অর্থ ‘সম্পূর্ণ’। এই ‘পূর্ণি’-র সঙ্গে ‘মা’ যুক্ত হয়েই ‘পূর্ণিমা’-র সৃষ্টি। এখানে ‘মা’ হচ্ছে ‘চন্দ্রের পরিমাণ’। শুক্লপক্ষের পঞ্চদশ দিনে (রাতে) চাঁদ পূর্ণ পরিমাণে উদিত হয় বলে ওই তিথিকে ‘পূর্ণিমা’ বলা হয়। অপরদিকে ষোড়শ দিন থেকে দ্বিতীয় পক্ষ; অর্থাৎ, কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়। ‘কৃষ্ণ’ অর্থ ‘কালো’।
ষোড়শ তিথি থেকে চাঁদ ক্ষয় হতে শুরু করে এবং ত্রিংশ তিথিতে গিয়ে একেবারে বিলিন হয়ে যায়। ওই তিথিতে রাতের পৃথিবী কালো আঁধারে ছেয়ে যায় বলে এই পক্ষকে কৃষ্ণপক্ষ বলা হয়। কৃষ্ণপক্ষের প্রথম তিথি থেকে চতুর্দশ তিথির নাম শুক্লপক্ষের অনুরূপ (প্রতিপদ, দ্বিতীয়া … চতুর্দশী) হলেও শেষ তিথির নাম হচ্ছে ‘অমাবস্যা’। ‘অমা’ অর্থ ‘সঙ্গে’, ‘√বস্’ মানে ‘বাস করা’; ‘‘অমাবস্যা’ হচ্ছে ‘সঙ্গে বাস করা’। পৌরাণিক কাহিনিতে পাওয়া যায়— কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চদশ তিথিতে চাঁদ সূর্যের সঙ্গে একত্রে বাস করে বলে পৃথিবীর আকাশে উদিত হয় না, যার ফলে ওই তিথিতে পৃথিবী কালো আঁধারে ছেয়ে যায়। এবং এই কারণেই কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চদশ তিথিকে ‘অমাবস্যা’ বলা হয়।
পক্ষের তিথিসমূহকে আবার পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়:— ১. নন্দা; ২. ভদ্রা; ৩. জয়া; ৪. রিক্তা; এবং ৫. পূর্ণা। প্রথম তিথির সঙ্গে পাঁচ যোগ করে করে নন্দার তিথিগুলো, দ্বিতীয় তিথির সঙ্গে পাঁচ যোগ করে করে ভদ্রার তিথিগুলো, তৃতীয় তিথির সঙ্গে পাঁচ যোগ করে করে জয়া তিথিগুলো, চতুর্থ তিথির সঙ্গে পাঁচ যোগ করে করে রিক্তা তিথিগুলো এবং পঞ্চম তিথির সঙ্গে পাঁচ যোগ করে করে পূর্ণার তিথিগুলো পাওয়া যায়। অর্থাৎ—
১. নন্দা: প্রতিপদ, ষষ্ঠী (১ + ৫) আর একাদশী (১ + ৫ + ৫)।
২. ভদ্রা: দ্বিতীয়, সপ্তমী (২ + ৫) আর দ্বাদশী (২ + ৫ + ৫)।
৩. জয়া: তৃতীয়া, অষ্টমী আর ত্রয়োদশী।
৪. রিক্তা: চতুর্থী, নবমী আর চতুর্দশী।
৫. পূর্ণা: পঞ্চমী, দশমী, পূর্ণিমা ও অমাবস্যা।
সহায়ক গ্রন্থ: ১. বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান।
২. শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস: বাঙ্গালা ভাষার অভিধান।
৩. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়: বঙ্গীয় শব্দকোষ।
৪. কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।
[জ্ঞাতব্য: চাঁদের আরবি মাসের তারিখ এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের চান্দ্রদিবসের মধ্যে এক দিনের পার্থক্য রয়েছে। জ্যোতিষশাস্ত্রের দ্বিতীয় তিথি থেকে আরবি মাসের প্রথম তারিখ (দিন) শুরু হয়। ]
উৎস: তিথি, এবি ছিদ্দিক, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)।
শুবাচের ওয়েবসাইট: www.draminbd.com