ড. মোহাম্মদ আমীন
তিনে দুয়ে দশ: অষ্টম পর্ব
৮
আমি কিছুটা বিব্রত। সে কারণে কিছুটা সংকুচিত। কিছুটা রোমাঞ্চিতও। নবম শ্রেণির একটা কিশোর যেভাবে আমাকে হেস্তনেস্ত করে চলেছে— তা ভাবতেই মনটা সংকুচিত হয়ে উঠে অপমানে, রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে নতুনে। যতই হোক, বেপরোয়া এই পিচ্চির

কুশলী বাহাদুরির কৃতিত্বটাই বা অস্বীকার করি কীভাবে?
নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে কষ্ট হচ্ছে খুব। এমন ভয়ংকর নতুন পরিবেশে সহজে খাপ খাইয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। খারাপ লাগছে; তবে তার চেয়ে লাগছে ভালো। বেয়াড়া হলেও ছেলেটি মেধাবী। প্রতিপক্ষের দুর্বল স্থান বের করে মোক্ষম সময়ে দ্রুত আঘাত করে কাবু করে ফেলার ভালোমন্দ সব কৌশল তার আয়ত্তে। জীবন-যুদ্ধে জয়ী হতে হলে এমন এমন কৌশল অনিবার্য। ইতিহাসে এসব লোকগুলোই বীর হয়ে শির। ছেলেটিকে গ্রন্থমুখী করাতে পারলে প্রশংসা অবধারিত।
ওমর বলল, টিচার, বিড়াল প্রথম রাতেই মেরে ফেলা উচিত।
কী?
বিড়াল। সুযোগ পেলে ম্যাও ম্যাও করে যে। প্রাচীনকালে বিড়াল দেবতার মতো পূজিত হতো। বিড়াল হত্যার একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। একবার এক লর্ডের ঘোড়ার পায়ের নিচে এক বিড়াল মারা যায়। লর্ড জানতেন না। ওই লর্ডকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে মারা হয়েছিল।জানেন?
জানি।
এখনও বিড়াল নিজেদের মানুষের গড ভাবে। কিন্তু আমরা তো ভাবি না। এজন্য বিড়াল ম্যাও ম্যাও করে তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।টিচার, ম্যাও ম্যাও মানে কী জানেন?
কী?
“একসময় আমি তোদের গড ছিলাম, হে মানুষ— ভুলিস না ভুলিস না।” টিচার, আপনি কুকুর না বিড়াল?
কী?
আই মিন কুকুর পছন্দ করেন না কি বিড়াল?
‘ওমর, আমি বললাম, “Dogs have owners, cats have staff. তোমার মধ্যে আমি আলোকিত মানুষের আলো দেখতে পাচ্ছি।
বেশি কথা বললে টিচার আপনাকে পস্তাতে হবে। তোষামোদ করছেন।
কী পড়বে?
পড়ার কিছু নেই।
মানে?
ক্লাসের বইয়ে নতুন কিছু নেই। সব পুরাণের মতো পুরান। একটা সিনেমা কয়বার দেখব?
আমি বললাম, এই পুরান থেকেই তোমাকে নতুন কিছু শিখতে হবে। পুরানই পুরাণ। পুরাণ, পুরানই থেকে যায়। তবে সব যুগের মানুষ পুরাণে নতুন কিছু খুঁজে পায়। এজন্য তোমার দৃষ্টিকে সৃষ্টির ইচ্ছা দিয়ে সাজাতে হবে। বই নয়, তোমার চোখকে নতুন আলোয়

সজ্জিত করো প্রতিদিন— এটাই শিক্ষার কাজ। আলোকিত হও জ্ঞানে। দেখবে— পুরান বইও নতুন চিন্তায় ভরে উঠছে।পুরাণ পড়েছ?
আমার দাদু ছিলেন পুরাণ ভক্ত। দাদুর কাছে ভারতীয় পুরাণের অনেক কিছু শুনেছি:
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শ্বাশতী সমাঃ
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্॥”
বাহ্!
টিচার, পাম্পু দিয়ে লাভ নেই। যাই বলুন, পুরাণ আর ভালো লাগে না। নতুন কিছু দেখান। প্রথম শ্লোকটাই রক্ত-মৃত্যু আর বিরহ নিয়ে। অসহ্য।
চলো আজ গণিত করি।
নতুন হলে শুরু করুন। নইলে হোল্ড ইয়োর টাং অ্যান্ড লেট মি গো। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি আপনি বিদায় হোন।
তিনে দুয়ে কত?
পাঁচ।
আমি আজ তোমাকে শেখাব, তিনে দুয়ে দশ।
এটি নতুন। শুরু করুন।
তোমার কাছে তিনটা আপেল আছে, আমার কাছে দুটো। দুজনের মোট কয়টা আপেল?
পাঁচটা।
আমি আমার দুটো আপেল আমি তোমাকে দিয়ে দিলাম। তুমি তোমার তিনটা আপেল আমাকে দিলে। এখন দুজনের মোট কয়টা আপেল হলো?
পাঁচটা। টিচার, অঙ্কটি নতুন লাগছে। গো অ্যাহেড।
আচ্ছা, আমার কাছে থাকা সব আপেল তোমাকে দিয়ে দিলাম। তোমার কাছে কয়টা আপেল হবে?
পাঁচটা।
আমার কাছে কয়টা?
একটাও না।
আমি জিরো হয়ে গেলাম। তাই তো?
আমি হয়ে গেলাম হিরো। এভাবে একজন জিরো হয় আরেক জন হয় হিরো।
তবে কিছু কিছু জিনিস তুমি যত দেবে তত হিরো হবে, জিরো হবে না কখনো। আইনস্টাইনের যুগে আইনস্টাইন ছিল একজন। এখন তার জ্ঞান নিয়ে বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য আইনস্টাইন।প্রতিদিন হচ্ছে। এভাবে বাড়ছে আর বাড়ছে। আইনস্টাইন মরার পর জিরো হননি, এভাবে কালজীয় হিরো হয়ে গেছেন। ধরো, আমার কাছে তিনটা আইডিয়া আছে, তোমার আছে দুটো। দুজনের মোট কয়টা আইডিয়া হলো?
পাঁচটা।
তুমি তোমার দুটো আইডিয়া আমাকে দিয়ে দিলে। আমি আমার দুটো আইডিয়া তোমাকে দিলাম। তোমার কয়টা আইডিয়া হলো?
পাঁচটা।
কীভাবে? আপনার তিনটা আর আমার দুটো।
কিন্তু তুমি তো তোমার দুটো আমাকে দিয়ে দিয়েছ।
তা ঠিক, কিন্তু এ তো বস্তু না, আপনাকে দিয়ে দিলেও আইডিয়ার বিষয়টা আমার কাছেও রয়ে গেছে। দুই অদ্ভূতভাবে চার হয়ে গেল। দারুণ তো!
গুড। আমার কাছে কয়টা আইডিয়া হলো?
পাঁচটা।
তাহলে আমাদের মোট কয়টা আইডিয়া হলো?
ওমর হেসে বলল, আমার পাঁচ আর আর আপনার পাঁচ, মোট দশ।
নতুন কিছু হলো?
হলো।
কী?
তিনে দুয়ে দশ, দারুণ। এতদিন তিনে দুয়ে পাঁচ করেছি। তা কি ভুল ছিল?
এই প্রথম ওমর আমার কাছে পাঠবিষয়ক কিছু জানতে চাইল।
বললাম, না।
তাহলে, তিন যোগ দুই সমান দশ হলো যে?



অনেক বিষয় আছে যেগুলো শুদ্ধ হলেও সর্বত্র শুদ্ধ হয় না। এই যেমন, তোমার বাবা আমার বাবা না।
তাই তো।
আমরা এভাবে পড়ব। তুমি কিছু আমাকে দেবে, আমি কিছু তোমাকে দেব। তাহলে আমাদের যা ছিল তা ডাবল হয়ে যাবে। তুমি যত বেশি জনকে দেবে তত বেড়ে যাবে।
ঠিক আছে টিচার।
এবার তাহলে শুরু করো।
কোন বই নেব?
প্রথমে বাংলা ব্যাকরণ। তারপর গণিত।
আগে ব্যাকরণ কেন?
গ্রামার ইজ দা কনস্টিটিউশন অব নলেজ অ্যান্ড নলেজ ইজ দা কলেজ অব ল্যাংগুয়েজ।
গণিত দ্বিতীয় কেন?
ম্যাথম্যাটিক্স ইজ দা ফাদার অব সায়েন্স।
—————————————–
————————————————-
——————————————–