ড. মোহাম্মদ আমীন
“ওমর নেই”, ওমরের পড়ার রুমে প্রবেশের আগে ভেসে এল তানজিমা ম্যামের গলা। বাইরে বাতাস, আকাশে মেঘ, বৃষ্টি হতে পারে শীঘ্রি। শহুরে গাছের ধুলোমাখা পাতাগুলো উৎসবের অপেক্ষায়।
কোথায় গেছে?
আমার ছোটো বোনের বাসায় গেছে।
তাহলে আমি যাই?
অপেক্ষা করতে বলেছে। সে পথে। যানজটে আটকা পড়েছে মনে হয়। আপনাকে না পেলে কান্নাকাটি করবে। জানেন টিচার— সে খালার বাড়িতে যাওয়ার

সময় পর্যন্ত বই নিয়ে গেছে। আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব।
ওমর অনেক বদলে গেছে। যতই গল্প করি, যতই প্রেমপত্র লিখে দিই না— লেখাপড়ায় ওমরকে এমন কুশলী ভালোবাসায় মোহগ্রস্ত করে রেখেছিলাম যে, সে নিজের অজান্তে ধীরে ধীরে বইয়ে ডুবে গেছে। এক নেশা থেকে আরেক নেশায় ফেলে দিয়েছি। এখন তাকে পড়াতে কষ্ট হয় না। সে পড়ে স্কুল আর আমি পড়ি বিসিএস। ওমরকে পড়ানোর চেয়ে আমার পড়াটা প্রধান হয়ে গেছে।
আপনি আমার ওমরকে নতুন জীবন দিলেন।
পড়ানো শুরু করার আগেই আমি সব ছাত্রছাত্রীকে আমার অনুগত করে নিই। ম্যাম, চারা রোপণের আগে কৃষক জমিকে যেমন উপযুক্ত করে সাজিয়ে নেয়। রূক্ষ জমিতে কি ফসল ফলে? আগাছাই হয়।
আগে সবসময় কী যেন চিন্তা করত ছেলেটা। সামান্য কারণে রেগে গিয়ে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে দিত। সামনে কেউ গেলে অহেতুক অপমান করত। এখন আমার ছেলে, সোনার ছেলে হয়ে গেছে। নিহা নিশাতের জন্য হাতের কবজি পর্যন্ত কেটে ফেলেছিল। অনেক বাজে অভ্যাস ছিল। এখন সব আনন্দ অন্যান্য জায়গা হতে বইয়ের পাতায় এসে জড়ো হয়েছে। কয়েক মাস আগেও আমাদের সহ্য করতে পারত না। একসঙ্গে খেতেও বসত না। এখন একসঙ্গে খায়, গল্প করে, হাসে; গায়— অভিমান করে। কী যে ভালো লাগে!
আমি বললাম, প্রথম কয়েকদিন আমাকে যত তাড়াতাড়ি তাড়াতে পারত তত খুশি হতো। এখন কীভাবে বেশিক্ষণ আটকে রাখা যায় সেই চেষ্টায় সে করে। উত্তম কর্ষণ ঊষর জমিকেও উর্বর করে দিতে পারে। ওমর তো জৈনিকভাবেই মেধাবী।
বুঝলেন টিচার, আগে বলত চকলেটের কথা, ইংরেজি আর হিন্দি সিনেমার সিডির কথা। এখন বলে বইয়ের কথা। আগে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীতে তার আলমারি ছিল ভর্তি। এখন সেখানে বই কেবল বই। আগে শিক্ষকের কাছে যেতে বললে ভয়ে শিউরে উঠত।একসময় নিহা নিশাতের জন্য এমন উদগ্রীব হয়ে থাকত। এখন আপনার অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে থাকে। আপনার কাছে চির ঋণী হয়ে থাকলাম।
“ঋণী যদি হয়েই থাকেন শোধ করে দেবে একদিন”, আমার কথা মনে হলো তানজিমা ম্যামকে ধাক্কা দিয়েছে। মুখটা আকস্মিক ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আমার হাতে মাসিক বেতনের খামটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, রাখুন। আমি আপনার জন্য ছোলা-পিঁয়াজু করে নিয়ে আসি। বৃষ্টির সময় ভালো লাগবে।
ওমরের কতক্ষণ লাগবে আসতে?
আপনার কি কোনো কাজ আছে?
নেই।
তাড়া কীসের?
ওমর নেই, তাই অস্থির লাগছে।
ওমরেরও অমন অস্থির লাগে আপনার জন্য। আমি মাঝে মাঝে ভাবি— ওমর মেয়ে হলে আপনার কী অবস্থা হতো! আমরা কী ভাবতাম আপনাকে?
খামটা অন্যদিনের চেয়ে ছোটো মনে হচ্ছে। তানজিমা ম্যাম চলে যাওয়ার পর গুনে দেখলাম, চারখানা পাঁচশ টাকার নোট। চারশ টাকা বেশি।
জমিরকে বললাম, ম্যামকে একটু ডেকে দিন।
তিনি এসে বললেন, কিছু বলবেন?
চারশ টাকা বেশি দিয়েছেন।
এবার থেকে এটাই দেওয়া হবে।
দুই হাজার টাকা, বিশাল অঙ্ক, অনেক সরকারি অফিসারও তখন অত বেতন পেতেন না। আমি নিজের ভাগ্যে নিজেই হতবাক হয়ে গেলাম। কত সহজে আয় করা যায়।
পনেরো মিনিট পর ওমর এল। গাড়ি থেকে নেমে সোজা পড়ার রুমে, সরি, টিচার। দেরি হয়ে গেল।
তোমার একটা সুখবর আছে।
কী?
আমার বেতন গত মাস থেকে চারশ টাকা বেড়ে গেছে। তোমার আম্মু বেতন দিয়ে গেলেন।
হুররে।
তোমার কমিশন এখন কত হলো।
আটশ টাকা। আমি কিন্তু গণিতে অনেক ভালো, তাই না টিচার?
বেতন বড়ার কথা না-বলেও পারতাম।
মিথ্যা বলা মহা পাপ, চরমতম অভিশাপ; মিথ্যা কথা যারা কয়, তারা কোনো মানুষ নয়; সত্যে যদি এত পাই, মিথে কেন বলব ভাই?
আজ কত তারিখ?
ওমর বলল, ত্রিশ তারিখ।
এ মাস কতদিনের?
ত্রিশ দিনেতে হয় মাস সেপ্টেম্বর,
এপ্রিল জুন আর সুইট নভেম্বর,
বাকি সব মাসে থাকে পুরো একত্রিশ,
ফেব্রুয়ারি আটাশ দিন, লিপইয়ার-উনত্রিশ।
কবিতা কী বলল?
একত্রিশ দিনে। কিন্তু কেন স্যার?

আমি হ্যান্ডব্যাগ থেকে খাম বের করে বললাম, নাও এখানে আটশ টাকা আছে। একটা পাঁচশ টাকার নোট আর তিনখানা একশ টাকা।
লজ্জায় চোখটা নিচু করে ফেলল ওমর। আগের মতো দ্রুত হাত এগিয়ে দিয়ে টেনে নিল না খাম। নিভু নিভু বাতির মতো লজ্জানত চোখে আমার দিকে তাকাল। খুব বেশি অপরাধ না করলে কোনো কিশোরে এমন দেখা যায় না।
নাও, কেউ দেখে ফেলবে।
সরি, টিচার। লাগবে না।
আমি অত টাকা দিয়ে কী করব?
এক মাসে যত টাকা আপনাকে দেওয়া হয়, আমি একদিনে তার চেয়ে অনেক বেশি দামের চকলেট খাই। একটা চকলেটের দাম একশ টাকা, দিনে বিশটা চকলেট খাই। বাবার হুকুমে সুইজারল্যান্ড থেকে আসে। এক ফোটা কোলেস্টেরল নেই।
আমি আবার বললাম, নাও।
লাগবে না স্যার।
আগে লাগত কেন?
তাস খেলতাম, নিহা নিশাতকে দিতাম। ভাড়া করে খারাপ ছবি দেখতাম। হুইস্কি খেতাম।
এখন?
ওইসব আর ভালো লাগে না।
নিহা নিশাত?
সে এখন আমার জন্য আগের মতো অনিবার্য নয়। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে বই। তার কথা এখন মনে পড়ে না। টিচার, আপনি বলেছেন—আমার সামনে বিশাল সমুদ্র।
বলেছি।
এটি পার হতে হলে শক্ত তরি লাগবে। বই আমার তরি।
আমি বুকশেলফগুলোর দিকে তাকালাম—বই আর বই; শুধু বই। এগারো মাস আগে এগুলো ক্রেস্ট আর ছবিতে ভর্তি ছিল। এখন একটা ক্রেস্টও নেই। ছবি দূরে থাক। সিডিগুলো ভাগাড়ে।
আপনি আমার পাঞ্জেরি, অধ্যয়ন আমার বাদাম।
বৃষ্টি আরও জোরে নেমেছে।শীত শীত করছে। অকাল বৃষ্টি। আমার ভালোই লাগে। সামনের মাসে তার ইয়ার ফাইনাল। তাড়াহুড়ো নেই। পরীক্ষার সব পড়া শেষ। ওমর মুখস্থ করে না, আত্মস্থ করে। তাই এখন চলবে অখণ্ড কথাধ্যয়ন। পরীক্ষার আগে পড়ার অতিরিক্ত চাপ নেওয়া উচিত নয়।ওমর আলমারি খুলে একটা চাদর জড়িয়ে দিল আমার গায়ে, “আপনার শীত করছে।”
একটা গান করো?
হারমোনিয়াম টেনে ওমর শুরু করল,
“নাইয়ারে নাইয়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাই চইলা
অচিনা সায়রের মাঝি সেই কথা যাও বইলা
কোন দূরে যাও চাইলা।
টিচার, আমার মাঝি কে জানেন?
কে?
আপনি।
আমি বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ওমরের চুল এলোমেলো করে দিলাম। ওমর হারমোনিয়াম ছেড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল, চুমো দেবেন না কপালে?
“সেলিমাকে পড়াতে যেতে হবে, দেরি হয়ে গেল এখন যাই”, ওমরের কপালে চুমো দিয়ে বললাম।
গাড়ি আসুক। বাবার গাড়ি আপনাকে দিয়ে আসবে।সেলিমাদের বাসা থেকে আপনার বাসায়।
দেরি হবে আমার।
হোক। চাদরটা নিয়ে যাবেন। ওটা আপনাকে দিলাম। অকালের বৃষ্টি, সর্দি হয়ে যেতে পারে। মনে করবেন না আবার দয়া করছি। আপনার সর্দি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হব আমি। ডিআইজির ছেলে, ব্যবসায়ীর নাতি, লাভ ছাড়া আমি কিছু বুঝি না।
As the dust settles, see my dreams,
All coming true
I depends on you.